‘‘একালে চলে না সোনার প্রদীপ আনা,
সোনার বীণাও নহে
আয়ত্তগত।
বেতের ডালায় রেশমি-রুমাল-টানা
অরুণবরণ আম এনো গোটাকত।’’
আরও পড়ুন-আমপাতা জোড়া জোড়া
ভোজনরসিক রবি ঠাকুরের আমপ্রীতির কথা কে না জানেন? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরও আমের প্রতি ছিল ভীষণ টান। আসলে আম নিয়ে বাঙালির আবেগ বরাবরই সীমাহীন। আম শুধু খাদ্য হিসেবেই বাঙালির রসনাকে দ্রবীভূত করেনি, বরং আমাদের দৈনন্দিন রীতিনীতি, শাস্ত্রাচার, লোকাচার ও শিল্পেও আম মিশে গিয়েছে প্রগাঢ়ভাবে। প্রায় তিন হাজার বছর আগের ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’-এ এই মহার্ঘ ফলটির উল্লেখ পাওয়া যায়। পুজোর মঙ্গলঘট যেমন আমপল্লব ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমনই ফুলিয়া থেকে বিষ্ণুপুর পুজোর শাড়ি মানেই রংবাহারি আমকলকার নকশা। শোনা যায়, ভাল জাতের আম এনে পাতার বিছানায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই আম পাকিয়ে নিজের হাতে বঁটিতে কেটে সবাইকে খাওয়াতেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ছুরি দিয়ে আম কেটে তৃপ্তমুখে অতিথিদের পরিবেশন করতেন রবীন্দ্রনাথ। মুর্শিদাবাদ আমের জেলা। এখানে রয়েছে বিশেষ এক সম্প্রদায়, এঁরা মূলত রাজস্থানের ওসোয়াল জৈন বংশোদ্ভূত বণিক, ১৮ শতকের গোড়ার দিকে এঁরা ভাগ্যান্বেষণে চলে আসেন তদানীন্তন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে। ‘শহরওয়ালি’ নামে পরিচিত এই সম্প্রদায়ের আম নিয়ে আবেগ ও শৌখিনতা হার মানাবে সারা বিশ্বের আমপ্রেমীদের। আম নিয়ে মুঘল সম্রাট ও নবাবদের ছিল অপার মুগ্ধতা। শুধু আকবরের জমানাতেই মুর্শিদাবাদের আমবাগানে ছিল দুষ্প্রাপ্য ২০০ রকমের আমের প্রজাতি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মুর্শিদকুলি খাঁ গড়ে তুলেছিলেন দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির আমের বিশাল বাগান। আবার, বিভিন্ন ফুল ও ফলের সঙ্গে আমের সংকর ঘটিয়ে স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় অনেক নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করেছিল ‘শহরওয়ালি’ সম্প্রদায় ।
আরও পড়ুন-ছোট্ট-ছোট্ট গল্প থেকে ভালবাসা সৃষ্টি হয়…
কোহিতুর, বিমলি, সারাঙ্গা, কালাপাহাড়, রানিপসন্দ, শাহদুল্লা, দমদমমিসরি ইত্যাদি বিখ্যাত কিছু আম্রপ্রজাতির নাম। এমনকী জিয়াগঞ্জের উৎকৃষ্ট আমের ভেট প্রতিবছর পাঠানো হত বাকিংহাম প্যালেসে, রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য। কোন আম কখন পাকবে, আর কোন আমের স্বাদ সবচেয়ে ভাল হবে তা আম বিশেষজ্ঞদের নখদর্পণে। মোলামজাম, আনানাস, চম্পা, গোলাপখাস অথবা চন্দনকোসা স্বাদে ও ঘ্রাণে অসামান্য। এ-ছাড়াও বিখ্যাত ভবাণী ও মোহনভোগ আম। গরমের মরশুম এলেই জৈন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে চলতে থাকে আমের উৎসব। তখন সকাল থেকে রাত্রি সব খাবারেই থাকে আম। জৈন, মুঘলাই, বাঙালি, রাজস্থানি আর ব্রিটিশ প্রভাবিত এই খাবারগুলোতে কাঁচা ও পাকা আমের ব্যবহার হয় বিভিন্নভাবে। শহরওয়ালি সম্প্রদায়ের বানানো ‘কাঁচা আমের ক্ষীর’ বিশ্ববিখ্যাত।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
‘‘… ফুল ফোটাবার কাল থেকে ফল পেকে যাওয়া পর্যন্ত আগাগোড়া মাধুর্য এ জগতে কেবলমাত্র আম্রবৃক্ষেই প্রকটিত”, একথা লিখেছেন সুকুমার সেন। রবি ঠাকুর তাঁর কৈশোরে লিখেছেন, ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলি দলি …’ ,আর পরবর্তীকালে লিখেছেন,
‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল , ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।’
নজরুল ইসলাম লিখেছেন গান ‘আগের মতো আমের ডালে বোল ধরেছে বউ…’, এছাড়াও অন্য একটি গানে তাঁর বন্ধুর সঙ্গে আম কুড়ানো খেলার মধুর স্মৃতি স্মরণ করেছেন।
আরও পড়ুন-দুর্ঘটনায় শোকপ্রকাশ বিরাটদের
আম উপমহাদেশীয় ফল। এর আদি নিবাস দক্ষিণ এশিয়া। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা’। পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ প্রজাতির আম আছে। সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য উপপ্রজাতি। আমের প্রায় কয়েকশো জাত আছে। আমের বিভিন্ন নামকরণের ইতিহাস ভীষণ আকর্ষণীয়।
মালদহের ফজলু বিবির বাড়ির আঙিনায় থাকা গাছের আমের নাম রাখা হয় ‘ফজলি’। ভারতের এক খোঁড়া ফকিরের আস্তানায় পাওয়া আমগাছের আমের নাম রাখা হয় ‘ল্যাংড়া’। মালদার এক কৃষক মাটির হাঁড়ি দিয়ে ফিল্টার বানিয়ে আমগাছে জল দিতেন। এক রাতে ওই হাঁড়িটি ভেঙে ফেলেন কয়েকজন। আর সেই বছর নাকি গাছে বিপুল পরিমাণ আম ধরে। সেই থেকেই আমের নামকরণ করা হয় ‘হাঁড়িভাঙা’। এছাড়াও হিমসাগর, গোপালভোগ, খিরসাপাত আম জগদ্বিখ্যাত। ভারত ও বাংলাদেশের বিখ্যাত আম ‘আলফানসো’।
পর্তুগিজ এক সামরিক বিশেষজ্ঞ আলফানসু ডি আলবাকারকির নামানুসারেই নাকি এই আমের এমন নাম।
আরও পড়ুন-সভা করে কৃতজ্ঞতা সরকারি কর্মীদের
‘বোম্বাই’ আমের উৎপাদন বেশি হয় কিন্তু বিহারে। দশেরি ও নিলম জাতের দুটি আমের সংকরায়ণে এসেছে স্বনামধন্য ‘আম্রপালি’। চোষা আম আকারে খুব ছোট্ট। মির্জাপসন্দ ও সুবর্ণরেখা আম খ্যাতনামা। তোতাপুরি, কারাবাউ, কলাবতী, অরুণা, মল্লিকা, সূর্যপুরি, বারোমাসি, মিশ্রিদানা প্রভৃতি আমও বাঙালির যথেষ্ট প্রিয়। বৈশাখ মাসে আমের কথা এলেই মনে পড়ে কল্যাণী দত্তের লেখা ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইটির কথা। সেখানে আম নিয়ে একটি দীর্ঘ অধ্যায় রয়েছে।
আম খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসতেন কবি ভারতচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্ত, হেমচন্দ্র, ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো বিদ্বজ্জনেরা। রায়গুণাকরের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ সুন্দর বিয়ের পরে যখন কাঞ্চিপুরে ফিরে যেতে চাইলেন, তখন বিদ্যা বললেন, ‘জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা আম এ দেশে বিস্তর, সুধা ফেলে খেতে আশা করে পুরন্দর।’ এখানে যে আমের কথা বলা হয়েছে তা পঞ্চাশ বছর আগে কালীঘাট বাজারে আসত, রমরমিয়ে বিক্রিও হত।
আরও পড়ুন-‘মর্মান্তিক! জীবনে এতবড় রেল দু.র্ঘটনা দেখিনি’
বাঙালি বরাবরই আমপাগল। পাকা ও কাঁচা সব আমই তাদের চাই। আম বাঙালির রক্তে-মাংসে-মজ্জায়। বাঙালির চাই আমপোড়া শরবত, আমচুর, আম-দুধ, আম-ডাল, আম-দই, আম-টক, আম-চাটনি, আমসত্ত্ব, আমের আচার, আমজেলি, আম আইসক্রিম, আম্রভোগ, আমলুচি, আম সন্দেশ আর আম কুলফি। নুন-লঙ্কা মাখা কুচি কুচি কাঁচা আমের অপার্থিব আস্বাদ ছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই বাঙালির কাছে। আম বাঙালির প্রাণ, বাঙালির আত্মা। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই অমৃত ফলটি পরিমিত পরিমাণে খেতে পারলে তার চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। অনেকেই জানেন আম দিয়ে শোল মাছের ঝোলের অপূর্ব স্বাদ। আবার অনেকেই জানেন না যে আম দিয়ে বানানো যায় সুস্বাদু চপ।
আমের সঙ্গে বৈরিতা জলের। আমের শত্রু করলা। আমের সঙ্গে ঠান্ডা পানীয়ের যোগে হয় বিষক্রিয়া। ঝালমশলাযুক্ত খাবারের সঙ্গে আম খেলে হতে পারে বিপদ। এই ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত সকলেরই।
আরও পড়ুন-পরিস্থিতি জানতে নবান্নের তরফে কন্ট্রোল রুমে নজর
মালদার আম জগৎজোড়া নাম। বাংলার গর্ব। ‘আম’ শব্দের অর্থ রসদ। ফলের রাজা আম। রাজলক্ষ্মী, মোহনবাসি, বেগমবাহার, রাখালভোগ, মহানন্দা, বৃন্দাবনী, সিন্ধু, ফালুয়া, রত্না, কিসানভোগ, মাধুরী, বাতাসা, জামাইপছন্দ, গোল্লাছুট, গোলাপখাস, গৌড়মতি, আলমশাহি, রসখাজা ইত্যাদি আমগুলিও বিশিষ্ট জাতের এবং জনপ্রিয়।
সেরা পাঁচটি আম বাছতে গেলে আলফানসো, ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর ও আম্রপালির নাম আসবেই। আলফানসো সবচেয়ে দামি ও জনপ্রিয়। ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ। ইংরেজিতে ‘ম্যাঙ্গো’ শব্দটি সম্ভবত তামিল ‘ম্যানকেই’ কিংবা ‘মানগা’ শব্দ থেকে এসেছে। পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্য করতে এসে মানগা বা ম্যাংগা শব্দটি গ্রহণ করে। আর ব্রিটিশরা ১৫ ও ১৬ শো শতকে ভারতের দক্ষিণে ব্যবসা করতে এসে ‘ম্যাঙ্গো’ শব্দটি বলতে শুরু করে।
মিশর, ব্রাজিল, পশ্চিম আফ্রিকা, পেরু, থাইল্যান্ড ও চিন-সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই নানা জাতের আম উৎপন্ন হয়। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আম উৎপন্ন হয় ভারতে।
এখানে বছরে ১৮ মিলিয়ন টন আম উৎপন্ন হয় যা বিশ্বের মোট আম উৎপাদনের ৪০ শতাংশ। ভারতে প্রথম আমের জন্ম হয় প্রায় ৫০০০ বছর আগে। হিমালয় পর্বতের পাদদেশে ভারত এবং মায়ানমারে প্রথম বন্য আম উৎপন্ন হয় বলে মনে করা হয়। আমের উদ্ভব এশিয়ায়, কিন্তু বর্তমানে সারা বিশ্ব জুড়েই আম দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রাচীন যে আমগাছের সন্ধান পাওয়া গেছে সেটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর। মধ্য ভারতের কান্দেশে আছে গাছটি, আর আশ্চর্যের বিষয় হল গাছটি এখনও ফল দিচ্ছে।
আরও পড়ুন-কুকীর্তি ঢাকতে বিরোধী দলনেতার মিথ্যাচার
আম ড্রুপ জাতীয় ফল। এই ধরনের ফল রসালো ও শাঁসযুক্ত এবং পাতলা আবরণে মোড়া থাকে, যার মধ্যভাগে থাকে ফলটির বীজ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আমগাছ খুব পবিত্র। আমে রয়েছে ২০টি ভিন্ন ভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ, যার মধ্যে অধিক পরিমাণ ভিটামিন এ, পটাশিয়াম ও ভিটামিন বি-এর একটি উপাদান ফোলাইট থাকে। আর থাকে প্রচুর আঁশ। হলুদ, সবুজ, লাল, সোনালি, কমলা-হলুদ ইত্যাদি নানা রঙের আম দেখা যায়। আমগাছের পাতা ও ছাল মানুষের ভীষণ উপকারে লাগে। আমের রূপ, রং, ঘ্রাণ, স্বাদ ও মিষ্টতায় আপামর বাঙালি তো বটেই, সারা পৃথিবী পাগল। ক্যানসার থেকে শুরু করে শরীরের ছোট ও বড় সব রোগের বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে আম। হার্ট থেকে চোখ, পাকস্থলী থেকে চামড়া, সবেতেই আমের পুষ্টিগুণ ভীষণ প্রয়োজনীয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমের কোন বিকল্প নেই। গরমকালে যখন প্রচণ্ড লু হাওয়ার দাপট দেখা যায় এবং ভয়ঙ্কর তাপপ্রবাহ চলতে থাকে, তখন আমপোড়ার শরবত শরীরে প্রতিরক্ষার কাজ করে। আম শরীরকে শীতল রাখতে সহায়তা করে। লু লেগে কারওর শরীর কাহিল হয়ে পড়লে তাকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য সারা শরীরে আমপোড়া মাখিয়ে স্নান করানো হয় এবং তাতে ফল মেলে অব্যর্থ।
আরও পড়ুন-গদ্দার নেতার মিথ্যাচারের জবাব তৃণমূলের
বিশ্বের সবচেয়ে দামি আমের অন্যতম ‘এগ অব দ্য সান’ বা সূর্যডিম আম। জাপানের মিয়াজাকি শহরে এই আমের চাষ হয়। তাই এর আরেক নাম মিয়াজাকি। এটি বিরল প্রজাতির আম। দেখতে অনেকটা ডায়ানোসরের ডিমের মতো। এই আমের রং জ্বলন্ত আগুনের মতো গাঢ় লাল। একটি মিয়াজাকি আমের ওজন সাধারণত ৩৫০ গ্রামের কাছাকাছি। এর স্বাদ ও মিষ্টত্বের কোনও তুলনা হয় না। এই আমকে বলা হয় লাখ টাকার আম। বিক্রিও হয় জোড়ায় জোড়ায়। আসলে এই আম চাষের পিছনে যে শ্রম ও সময় ব্যয় হয় এবং অতিরিক্ত যত্ন-সহ পরিচর্যা করতে হয় বলেই এই আমের এত দাম। প্রতি জোড়া আমের দাম বাংলাদেশি টাকার হিসেবে ১০০০০ থেকে তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
পরিশেষে উল্লেখ করতেই হয়, ‘আমটি আমি খাব পেড়ে’।
আরও পড়ুন-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহারে আপ্লুত কৃতীরা
বাঙালি শিশুর অক্ষর পরিচয়ের প্রায় শুরুতেই রয়েছে এই সেরার সেরা ফলটি। অ-এ অজগর তেড়ে এলেও, আ-এ আমটি পেড়ে খেতে হবেই। এখানে আম যেন পরিত্রাতার ভূমিকায়। জীবনের উষালগ্নে বাঙালি শিশুর মনোভূমে আমের যে মিষ্টি মধুর গোড়াপত্তন হয়, চিরদিন তা থাকে অটুট, অজর ও অক্ষয়।