গত ১৪ জুন, ২০২৩-এ ভারতের ২২তম আইন কমিশন একটি জনবিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায় যে, কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রকের সুপারিশ মোতাবেক তারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি)-র বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় আগ্রহী। ঠিক তার অব্যবহিত পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে জোরদার সওয়াল করলেন।
আরও পড়ুন-রাজ্যের ৫০৯টি কলেজে স্নাতকে ভর্তির পোর্টাল খুলছে আজ মধ্যরাতের পর থেকেই
এ-বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের বিষয়টির মূলে ঔপনিবেশিক শাসন জমানায় ফিরে দেখতে হবে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার প্রজাবর্গের ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির প্রয়াস চালাচ্ছিল। ব্যক্তিগত আইনের পরিসীমায় নাক না গলানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশ যে আইনগুলি প্রণয়ন করে তাতে সম্প্রদায়গুলিকে নিজ নিজ ব্যক্তিগত আইন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করেছিল। ফলত, ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জনের পর সংবিধান প্রণয়নে উদ্যোগী হল ততদিনে তার বিবিধ সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের আইন প্রবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে দেড় শতাব্দীর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে গিয়েছে। গণপরিষদ অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করার বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষে ছিলেন সেই সকল সদস্য যাঁরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারের প্রয়োজনে এবং সকলের ক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগত আইনগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে, সেগুলো পুনর্নির্মাণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। পক্ষান্তরে আর এক দল সদস্য ভারতের বহুত্ববাদী ধারণাটিকে জোরদার করার প্রণোদনায় কোনও সম্প্রদায়ের ওপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়ার থেকে বিরত থাকার পক্ষে ছিল।
আরও পড়ুন-১০লক্ষ লোক নিয়ে গিয়ে বাংলার বকেয়া আদায় করে আনার চ্যালেঞ্জ অভিষেকের
সবকিছুকে একছাঁদে ফেলে দেওয়াটা অবাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত হবে, এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমাদের সংবিধান প্রণেতাগণ একটি নির্দেশমূলক নীতি শীর্ষক অংশ প্রণয়ন করেন যেগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎ যোগ্য নয় এবং মৌলিক অধিকারগুলোর থেকে স্পষ্টতই আলাদা।
সময়ে সময়ে বিষয়টি উঠে এসেছে। বিচার বিভাগের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে শীর্ষ আদালত এই মর্মে সতর্ক করেছে যে, ‘‘The desirability of uniform civil code can be hardly doubted but it can concretise only when social climate is properly built by the elite of the society and the statesmen, instead of gaining personal mileage, rise above and awaken the masses to accept the change.”
আরও পড়ুন-হুল দিবসের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর
এই সূত্র ধরেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিষয়টি ২১তম আইন কমিশন কর্তৃক পরীক্ষিত হয় যেখানে ২০১৬-র প্রস্তুত প্রশ্নাবলির ভিত্তিতে গণমত নেওয়া হয়। এরপর ২০১৮-তে পারিবারিক আইনে সংস্কারের বিষয়ে একটি পরামর্শদানকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারতের আইন কমিশন। ১৮৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির চেয়ে অন্যান্য আইন নিয়ে বেশি আলোচনা করেছে। ফলত এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, এই পর্যায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাঙ্ক্ষিত নয়, প্রয়োজনীয়ও নয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় অধিকাংশ দেশ আইনের পরিসরে ভেদাভেদ স্বীকারের পথে হাঁটছে এবং নিছক এই ভেদাভেদ কোনও পক্ষপাতিত্বের নির্দেশক নয়, বরঞ্চ একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের লক্ষণ।
আরও পড়ুন-মুখ্যসচিব পদে দ্বিবেদীর মেয়াদ বাড়ল ৬ মাস
তবু দেখা গেল সরকার বাহাদুর আবার এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা খুঁচিয়ে তুলতে আগ্রহী। কেন এমনটা করা হচ্ছে তার পক্ষে কোনও অকাট্য যুক্তি এখনও তাঁরা খাড়া করতে পারেননি। কিছু ধোঁয়াশাযুক্ত যুক্তি দর্শানোর চেষ্টা হয়েছে ‘কতিপয় বিষয়ের ও আদালতের রায়ের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বের প্রসঙ্গ টেনে’। শেষবার যখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা উঠেছিল তখনকার সঙ্গে এখনকার বিশেষ কোনও পরিবর্তন আছে কি? এটা কি সত্যিই সমানাধিকারের লক্ষ্যে, সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রণোদনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত না কি রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে অন্য বিষয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা?
আরও পড়ুন-মুখ্যসচিব পদে দ্বিবেদীর মেয়াদ বাড়ল ৬ মাস
এটা কি নানা বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতা থেকে নজর সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মেরুকরণের উদ্দেশ্যবাহিত সাম্প্রতিকতম প্রয়াস নয়?
এখানেও যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অগাস্ট ২০১৮-তে ২১তম আইন কমিশন তার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেটা প্রকাশিত হয় ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে, কয়েক মাস আগে। এবারও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আর এক বছরও বাকি নেই, তখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হল। এ-জন্যই প্রশ্ন উঠছে এটা সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত একটি পদক্ষেপ কি না।
আরও পড়ুন-অভিষেক আসছেন উন্মাদনা সালানপুরে
২০১৯ এবং ২০২৪ উভয় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ইস্তাহারে উল্লখিত বিষয়গুলির অন্যতম হল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। তবু, এক দশক ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই বিধি প্রণয়ন ও প্রবর্তনের লক্ষ্যে কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ মোদি সরকার করেনি। লক্ষণীয়, সাম্প্রদায়িক বিষে বিষাক্ত রাজনৈতিক আবহে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে জাতীয় সংহতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে নয়।
আরও পড়ুন-পাহাড়কে অশান্ত করার চক্রান্ত বিজেপির
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত আলোচনা তাই রাজনৈতিক বিতর্কের ঝড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে সরকার বাহাদুর ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, সর্বজনীন কল্যাণের অন্যতম উপাদান এটা। বলা হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে এটার দরকার। ভাবটা এমন যেন আমাদের যাবতীয় ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত আইন সংস্কার করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-আপত্তিকর বর্ধিত পার্কিং ফাইন হঠাৎ লাগু নিউটাউনে, খবর পেয়েই বাতিল করলেন মুখ্যমন্ত্রী
মিডিয়া হাউসগুলোও বারংবার আমাদের জাতীয় সমস্যাগুলো থেকে নজর সরিয়ে অন্য খবরে অনাবশ্যক গুরুত্ব আরোপ করে চলেছে। কোনও সম্প্রদায়কে বিশেষ তকমা না দিয়ে সকল সম্প্রদায়কে সমদৃষ্টিতে দেখার ভাবনার বিষয়টা জনগণের নজর থেকে সরে যাচ্ছে। সরকারের আলাপ-আলোচনা চালানোর ব্যর্থতা ও অনিচ্ছার বিষয়টাও আড়ালে চলে যাচ্ছে। শাসক গোষ্ঠী নিজেদের কেবল আগামী নির্বাচনী যুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্য পদক্ষেপ করছেন আর সেই লক্ষ্যে সময়বিশেষে প্রয়োজনমাফিক অস্ত্রসজ্জায় নিজেদের সজ্জিত করে চলেছেন।