‘ওরা যত বেশি পড়ে। তত বেশি জানে৷ তত কম মানে!’ সেই কবে সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবি হীরক রাজার দেশে-তে হীরকরাজের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন এহেন সংলাপ। কালে কালে যত স্বৈরাচারী শাসক এসেছে,তাদের প্রধান লক্ষ্যই থেকেছে শিক্ষার পরিসরকে সংকীর্ণ করে দেওয়া৷ কারণ, স্বৈরাচারী শাসক বরাবর ভয় পায় শিক্ষাকে। মেধাকে। বর্তমান ভারতবর্ষে যে স্বৈরাচারী শাসকরা দিল্লির মসনদে বসে আছেন, তাঁরাও একইভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রটিকে ধ্বংস করে, শিক্ষায় গৈরিকীকরণ করার প্রচেষ্টায় রত হয়েছেন৷ ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসাইস্তক নরেন্দ্র মোদি পরিচালিত সরকার এবং আরএসএস জাতীয় ক্ষেত্রে নতুন পাঠ্যক্রম তৈরির চেষ্টায় রত। যে-যে বিষয় একজন পড়ুয়ার মাথায় ঢুকলে ভবিষ্যতে তা বিজেপি বা আরএসএসের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, সেই সমস্ত বিষয়গুলিকে সুচতুরভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যবাসীকে আগলে রাখেন মুখ্যমন্ত্রী
সম্প্রতি প্রকাশিত এনসিইআরটি-র নতুন পাঠ্যক্রমে বাদ গেছে পিথাগোরাসের উপপাদ্য, মোঘল ইতিহাস, ডারউইনের তত্ত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বাতিলের তালিকায় সবচেয়ে বেশি ‘কাটছাঁট’ করা হয়েছে সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে। বাদ গেছে ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গা, জরুরি অবস্থা এবং তাঁর প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস যেমন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, উত্তরাখণ্ডের চিপকু আন্দোলন, ১৯৭০-এর দলিত আন্দোলন। বুঝতে হবে, বিজেপি কেন বেছে বেছে এই সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসগুলিকে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিল। ছোটবেলা থেকেই যদি একটি ছাত্র বা ছাত্রী যদি দেশের এই বিখ্যাত আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হয়, তাহলে এই ছাত্রছাত্রীরাই ভবিষ্যতে আবারও এরকম আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে! তার চেয়ে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে দেওয়াটাই বিজেপির জন্য সুবিধাজনক পদক্ষেপ! সিবিএসসি-র ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ‘KEY ELEMENTS OF A DEMOCRATIC GOVERNMENT’-কে বাদ দিয়ে দিয়েছে নয়া সিলেবাস কমিটি! কারণ, বিজেপির মতে, একটি গণতান্ত্রিক সরকার এবং তার কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা জানার কোনও প্রয়োজন নেই আজকের ছাত্র-ছাত্রীদের! জানলেই তো হীরকরাজকে প্রশ্ন করতে শিখবে এই পড়ুয়ারা! অতএব বাদ!
আরও পড়ুন-মণিপুর নিয়ে নীরব মোদি, কথা উনি কোনও দিনই রাখেন না
হীরকরাজ প্রশ্ন শুনতে ভয় পান! প্রশ্ন করলেই হীরকরাজের অনুগামীরা কাউকে ‘আরবান নকশাল’ বা কাউকে ‘আন্দোলনজীবী’ বলে দাগিয়ে দেন! তাই, সিলেবাসটাই আমূল বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। এনসিইআরটি-র যে সিলেবাস কমিটি, তার ২৫ জনের মধ্যে ১৭ জনই প্রত্যক্ষভাবে সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত! এবিভিপির প্রাক্তন সভাপতি থেকে অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শিক্ষক মহাসঙ্ঘের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত সেই কমিটি স্বাভাবিকভাবেই যে তাদের গৈরিক ইতিহাসকে চাপিয়ে দেবে, তা বলাই বাহুল্য! সেই ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে যেমন যন্তরমন্তর ঘর বানিয়েছিলেন হীরকরাজ, আর সেই যন্তরমন্তর ঘরে পুরে দিয়ে মগজধোলাই হত, তেমনি মগজধোলাই চলছে প্রতিমুহূর্তে! সেটা কখনও নয়া পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে বা ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’র ফেক নিউজের মাধ্যমে! আরএসএস চায়, ‘এক দল, এক নেতা, এক ভাষা’র এক ভারতবর্ষ তৈরি করতে! যে ভারতবর্ষে অনবরত ঘৃণার চাষ হয়।
আরও পড়ুন-নবান্ন থেকে দ্বারকা নদীর উপর নবনির্মিত সেতু উদ্বোধন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
যে ভারতবর্ষে নগ্ন করে আদিবাসী মহিলাকে রাস্তায় ঘোরানো হয় আর তাঁর পিছনে জান্তব উল্লাস করে কয়েকশো উন্মত্ত জনতা! ভাবতে অবাক লাগে, আজ এই দেশে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে একজন কর্তব্যরত আরপিএফ কনস্টেবল গুলি করে খুন করছেন ৪ জন মানুষকে! শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, প্রকাশ্যে বলছেন, ‘যদি ভারতবর্ষে থাকতে হয়, তাহলে মোদি যোগী এই দুজনের মতো করেই থাকতে হবে!’ সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে! এই যে ঘৃণার বাতাবরণ, এই যে অন্য ধর্মের প্রতি তীব্র অসূয়া, ২০১৪-পরবর্তী ভারতবর্ষে এটাই এখন ‘নিউ নর্ম্যাল’! এই বিদ্বেষী মনোভাব, এই জাতিদাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টিই হয় শিক্ষার অভাব থেকে। একজন শিক্ষিত মানুষ কখনওই হাতে বন্দুক নিয়ে রাস্তায় নেমে দাঙ্গা বাধাবেন না। বরং সে, যুক্তিনিষ্ঠভাবে কোনও ঘটনাকে বিচার করবেন। পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। আর এই যুক্তিনির্ভরতাই বিজেপির রাজনীতির বিপরীতে অবস্থান করে! স্বাভাবিকভাবেই, তার্কিক বাঙালিকে ভয় পায় বিজেপি। ভয় পায় বাঙালির মেধা, বাঙালির শিক্ষা, বাঙালির বৌদ্ধিক মননকে!
আরও পড়ুন-৬-৭ মাস ভোটের বাকি, বিজেপি শুরু করেছে দাঙ্গা
বাঙালি জাতির বিজ্ঞানচর্চা, বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতি সাহিত্যচর্চা তো আজকের হীরকরাজের মাথাব্যথার কারণ বটেই। যে মাটিতে জগদীশচন্দ্র বোস, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহার মতো বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানচর্চা করেছেন সেখানকার শিক্ষিত সমাজ যে বিজেপির শিক্ষায় গৈরিকীকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। বিজেপি নিজেরাও বাঙালির ইতিহাস নিয়ে ঈর্ষান্বিত! কারণ, আন্দামান সেলুলার জেলের বন্দিদের তালিকায় চোখ বোলালে দেখা যায়, ৫৮৫ জন দেশপ্রেমিকের নাম, সেখানে ৩৯৮ জনই বাঙালি। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন সেলুলার জেলে যান, তখন সেখানে শুধুমাত্র সাভারকারের ছবির সামনে বসেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেই সাভারকার যিনি সেলুলার জেলে বন্দি থাকাকালীন বারবার ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দেন! নিজের পূর্ববর্তী কাজের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন, সেই সঙ্গে পরবর্তী জীবনে ব্রিটিশ-বিরোধী সমস্ত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার কথা চিঠিতে লেখেন!
আরও পড়ুন-মণিপুর নিয়ে উত্তাল কাঁথি
সেই সাভারকারের নামেই আন্দামানে বিমানবন্দরের নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী! ভাবলে এখনও রোমাঞ্চিত লাগে, এই আন্দামান সেলুলার জেলেই বন্দি ছিলেন বাঙালি বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো। যিনি সেই ১৯০৬ সালে জার্মানি থেকে বোমা তৈরির কৌশল শিখে ফিরেছিলেন কলকাতায়। হেমচন্দ্র কানুনগো, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উল্লাসকর দত্তদের ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ হয় আলিপুর বোমা মামলায়। আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হয় তাঁদের৷ কিন্তু, আজকের ‘গৈরিক ইতিহাসে’ ব্রাত্য হয়ে যান বাংলার এই বিপ্লবীরা আর বীরের সম্ভাষণ দেওয়া হয় মুচলেকা দেওয়া সাভারকারকে! এভাবেই ইতিহাসের গৈরিকীকরণ চলছে দেশ জুড়ে৷ যেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের কাঠামোকে ধ্বংস করে আরএসএসের হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের ছক কষছে হীরকরাজেরা! নানাভাবে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ, ইতিহাসকে মুছে ফেলে নিজেদের মতো ইতিহাস রচনা বা দেশের বিজ্ঞান চেতনাকে ধ্বংস করা। স্রেফ নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে আগামী কয়েকটা প্রজন্মকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চাইছে বিজেপি।
আরও পড়ুন-রাষ্ট্রপতির কাছে ‘ইন্ডিয়া’: মণিপুর থেকে দুই নারীকে রাজ্যসভায় পাঠান, আর্জি জানাল তৃণমূল
এই অন্ধকার সময়ে প্রমিথিউসের মতো আলোর সন্ধান ফের একবার বাংলা দিয়েছে। বাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে দেশের ২৬টি রাজনৈতিক দলের ‘ইন্ডিয়া’কে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে এ-দেশের কোটি কোটি মানুষ। ‘ইন্ডিয়া’ই একমাত্র পারে এই স্বৈরাচারী শাসককে ভারত-ছাড়া করতে। আকাশে-বাতাসে অনুরণন হচ্ছে হীরক রাজার দেশে ছবিরই আরেক বিখ্যাত সংলাপ, ‘‘অনাচার করো যদি, রাজা তবে ছাড়ো গদি! যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারি। করিবে শোষণ পাপ, ক্ষমা চেয়ে নাহি মাপ! নাহি কোনো পরিত্রাণ। হীরকের রাজা শয়তান”!