বাতাসের মধ্যে থাকা কিছু গ্যাসীয় উপাদান পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী, এই গ্যাসগুলোকে আমরা গ্রিন হাউস গ্যাস বলি, এর মধ্যে যেমন আছে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) বা নাইট্রাস অক্সাইড, তেমনই আছে বিষাক্ত গ্যাস মিথেন (CH4)-ও। এই গ্যাসগুলো পৃথিবীকে যেন এক প্রকাণ্ড গ্রিন হাউস বানিয়ে রেখেছে, যার ফলে সূর্য থেকে আসা তাপ আটকে পড়ে গরম করে তুলছে এই গ্রহকে। এই গ্যাসগুলো যেমন আমাদের টিকে থাকবার জন্যে দায়ী, আবার অন্যদিক থেকে এগুলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মাশুলও গুনতে হচ্ছে সেই আমাদেরই। আমাদেরই দোষে আজ এগুলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফল আমরা টের পাচ্ছি নানাভাবে।
আরও পড়ুন-ফের রেল দুর্ঘ.টনা, লাইন.চ্যুত আজমের-শিয়ালদা এক্সপ্রেস
এমনিতেই গোটা বিশ্বের আবহাওয়ায় যে বড়সড় পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে আর সেটাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খারাপের দিকে, এটা আমরা বুঝছি গত কয়েক দশক ধরেই। বড় মাপের সব ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প আর তাপপ্রবাহে কাহিল হয়ে পড়ছে বহু দেশ, আমাজনের মতো অরণ্য গরমে দিশাহারা। এইরকমভাবে যদি পৃথিবীর বুকে সংকট চলতেই থাকে, তাহলে আগামী দিনে আরও কত বড় মাপের বিপদ আসতে চলেছে, তা সহজেই অনুমান করা চলে। আর সেটা যে আমাদের পক্ষে সুখের হবে না, তাও আমরা বুঝতে পারছি ভালই।
আরও পড়ুন-ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র ইস্যু নিয়ে কড়া পদক্ষেপ, নিয়োগ হচ্ছে বহু আধিকারিক
এর জন্য মূল দায়ী কিন্তু এই গ্যাসগুলোই। আবার এগুলোর মধ্যেও সবচেয়ে বেশি দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড। যেটা আমাদের শ্বাসবায়ু থেকে বেরিয়ে বাতাসে মেশে। গাছেরা আবার এই গ্যাসই গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষের সময়, সেটাই টিকিয়ে রাখে ভারসাম্য। তাই এই গ্যাসের পরিমাণ না কমাতে পারলে পৃথিবীকে বাঁচানো মুশকিলের হয়ে যাচ্ছে।
বিকল্প উপায় : মিথেন কমানো
কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও আরও কয়েকটা গ্যাস বিশ্ব-উষ্ণায়নের জন্য দায়ী, যার মধ্যে মিথেনের দিকে গবেষকদের চোখ পড়েছে এবার। কার্বন আর হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি এই গ্যাসের তাপ ধারণ ক্ষমতা CO2-এর চেয়ে অনেক বেশি, তাই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যও মিথেন ওই গ্যাসের চেয়ে প্রায় কুড়ি গুণ বেশি দায়ী। আর সম্প্রতি এই গ্যাস বাতাস থেকে কমানোর উপায় বের করে এই সমস্যার সমাধানের দিকে হাঁটবার কথা ভাবছেন ওঁরা।
আরও পড়ুন-অ্যাডিনোভাইরাস নিয়ে রাজ্যকে সতর্ক করল আইসিএমআর
এর পেছনে কারণ একটাই— মিথেন গ্যাসের বাতাসের টিকে থাকবার সময়কাল CO2-এর চেয়ে অনেক কম। একটা মিথেনের অণু যেখানে টিকে থাকে প্রায় বারো বছর সেখানে CO2 টিকে থাকে শয়ে-শয়ে বছর। মিথেনকে বাতাস থেকে কমিয়ে ফেলতে পারলে আরও লাভ, কারণটা একটু আগেই বলেছি— এই গ্যাস বাতাসকে গরম করে অনেক বেশি পরিমাণে।
কিন্তু কাজটা করা যাবে কী করে? মিথেন পৃথিবীতে মূলত পাওয়া যায় চাষের জমি থেকে, নানা ধরনের প্রাকৃতিক গ্যাসে, কয়লাখনির মধ্যে, বা গরুর দেহ-নিঃসৃত গ্যাসে। আর এই সব ক্ষেত্র থেকে এই গ্যাসের নিঃসরণ যদি কমানো যায়, তাহলে সেটা আমাদের পক্ষে যথেষ্ট কাজের হবে। আবার অনেকে বলছেন যে এইভাবে মিথেনের পরিমাণ কমানো সহজ কাজ না। কারণ গরুর সংখ্যা আমরা চাইলেও কমাতে পারব না, বা চাষের কাজও কমিয়ে দেওয়া যাবে না। সুতরাং এমন উপায় ভাবতে হবে, যাতে বাতাসের মধ্যে ইতিমধ্যেই জমে যাওয়া মিথেনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলা যায়, সরাসরি।
আরও পড়ুন-৩২ বছরে প্রয়াত ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান নীল নন্দা
ঠিক কতটা পরিমাণ মিথেন বাতাসে আছে, সেটা জানা রয়েছে বিজ্ঞানীদের। শিল্প বিপ্লব (যখন থেকে কলকারখানার দাপট শুরু হল) হওয়ার আগে বাতাসে মোট যতটা মিথেন ছিল, আজ তার পরিমাণ তিনশো কোটি মেট্রিক টন বেশি। আর এই বিপুল পরিমাণ মিথেন বেড়েছে শেষ দুশো বছরের কিছু বেশি সময়কালে। এই মিথেন যদি বাতাস থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কমে যাবে অর্ধেক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যা পৃথিবীর অসুখ সারবার দিকে বড় একটা পদক্ষেপ।
কীভাবে কমানো যাবে মিথেন?
উপায় ভাবা হয়েছে কয়েকটা, তবে সেগুলো এখনও রয়েছে গবেষণার পর্যায়ে, মানে সেগুলোকে এখনও কাজে লাগানো শুরু হয়নি ব্যাপকভাবে। যেমন একটা উপায় ওঁরা ভেবেছেন যে কয়লাখনির মধ্যে ‘মিথানোট্রফ’ জাতীয় এমন কিছু ব্যাকটিরিয়া রাখবার ব্যবস্থা হবে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো মিথেনকে বাতাস থেকে টেনে নিতে পারে। এমনিতে এখন ওই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা যা, তাতে বাতাসের বিপুল মিথেনকে টেনে নেওয়া ওদের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়, তাই ওদের প্রচুর পরিমাণে সংখ্যা-বৃদ্ধি করতে হবে আগে। আবার এটাও মাথায় রাখা দরকার যে এমনিতে মিথেনকে বাতাস থেকে টেনে নেওয়া খুব কঠিন কারণ বাতাসে এই গ্যাসের পরিমাণ CO2 –এর চেয়ে অনেক কম। যেখানে প্রতি দশ লক্ষ বাতাসের অণুর মধ্যে চারশোটা CO2 অণু, সেখানে ওই পরিমাণ বাতাসে মিথেন মাত্র দুটো! এই পরিস্থিতিতে ওই বিশেষ জাতের ব্যাকটিরিয়া যে কাজটা করতে পারে, তা সত্যিই কঠিন একটা কাজ। মাইক্রোবায়োলজিস্ট থেকে শুরু করে প্রকৃতিবিদ বা রসায়নবিদ— সকলেই এখন উঠেপড়ে লেগেছেন এই ব্যাকটিরিয়াদেরকে কীভাবে নানা পরিস্থিতিতে সংখ্যা-বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
আরও পড়ুন-ঘোড়ায় চড়ে মন্দিরে চু.রি যোগীরাজ্যে
এঁদের গবেষণা সফল হলে শিল্পক্ষেত্রে, বা অন্যত্রও, মিথেন থেকে তৈরি করা যাবে মিথানল যা দিয়ে আবার পরে তৈরি করা হবে প্লাস্টিক বা বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি গবেষক অরুণ মজুমদার যেমন কাজ করছেন এক ধরনের অণুঘটক নিয়ে, যারা এই মিথেন থেকে মিথানল তৈরির কাজে সাহায্য করবে। অণুঘটক হল এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা কোনও বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, নিজেরা যদিও বিক্রিয়ার পর অপরিবর্তিত থাকে। এই ধরনের গবেষণা সফল হোক, আমরা অবশ্যই চাই। পৃথিবীর জ্বর সারুক, আমরাও তাহলে এক সুস্থ পরিবেশ রেখে যেতে পারব আগামী প্রজন্মের জন্য।