‘বিশ্বগুরু’র ভজনা যত বাড়ছে, আলো বোধ করি ততই ক্রমে ক্রমে কমছে। কেন্দ্রীয় সরকারের (India- Modi Government) শিক্ষানীতি দেখলে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যায়। উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণে ভারতে ইতিহাসকে গৈরিক বর্ণে রঞ্জিত করার তাবৎ আয়োজন জোরকদমে চলছে। উদ্দেশ্য নাকি, ভারতকে ‘জ্ঞানসমৃদ্ধ দেশ’ বা ‘নলেজ কান্ট্রি’ হিসেবে তুলে ধরা।
লক্ষ্যের কথা শুনলে, জানলে মনটা বেশ নেচে ওঠে। ভারতীয় মাত্রই এমনটা হয়। কিন্তু কেবল আপন দেশের পিঠ চাপড়ালেই এই উদ্দেশ্য পূরণ হবে! তেমনটা কিন্তু মনে হয় না। সর্বজনীন জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে, সবাই যে পথে হাঁটছে তার উল্টো পথ ধরলে এমন আন্তর্জাতিক গরিমা অর্জন প্রকল্প অধরাই থেকে যাবে, এমন আশঙ্কা কিন্তু ক্রমবর্ধমান। সঙ্গত কারণেই এই আশঙ্কার মেঘ জমছে। মিশরের হায়েরোগ্লাফি হোক কিংবা গ্রিসের ত্রিকোণমিতি কিংবা ইউরোপের সাংকেতিক ভাষা, এসবের মূলে ছিল একটাই উদ্দেশ্য। মানুষের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সেগুলো প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর করা। এক প্রজন্মের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা উত্তর পুরুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
সপ্তদশ শতাব্দীর জর্মানি পেয়েছিল এক চিন্তাবিদকে। নাম গটফ্রায়েড উইলহেম লেইবনিজ। তিনি এক ‘বিশুদ্ধ’ ভাষার কথা বললেন। যে ভাষা বিষয় নিরপেক্ষ। এই চিন্তাপ্রবাহেই গা ভাসিয়ে, যখন ইউরোপ ল্যাটিন থেকে অন্যান্য আধুনিক ইউরোপীয় ভাষার উদ্দেশ্য, পরিবর্তনের লক্ষ্যে এগোতে চেয়েছিল, তখন তারা বিজ্ঞানের কথা, বৈজ্ঞানিক চিন্তা বোঝানের জন্য প্রতীক ব্যবহারকেই শ্রেয় পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এভাবেই ইউরোপ সর্বজনবোধ্য বিজ্ঞান ভাষ্য রচনা ও অন্যকে প্রদানের সামর্থ্য অর্জন করেছিল।
১৫৮২ নাগাদ দেখা দিলেন জিওর্দানো ব্রুনো। তিনি বললেন। জ্ঞানসমুদ্রের অজস্র তরঙ্গকে যদি একটি তার দিয়ে গাঁথা যায়, তবে এমন একটা জ্ঞানভাণ্ডার সৃজিত হবে যাকে দেশ কাল নিরপেক্ষভাবে সার্বজনীন বিজ্ঞান বা ইউনিভার্সাল সায়েন্স বলে লোকে মেনে নেবে। আর এই ধরনের প্রতীকের সাহায্যে জ্ঞানের অপরিমেয় বিস্তার মানব মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র পরিসরে আটকে রাখা সম্ভব হবে।
প্রায় একশো বছর পর, ১৬৭৫ নাগাদ, লেইবনিজ বললেন ‘লজিক্যাল ক্যালকুলি’র কথা। বললেন, ‘existere nihil alluid esse quam harmonicum esse’ অর্থাৎ, বাকি সবকিছুর সঙ্গে মানাতে না পারলে অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না। অসমাঞ্জস্যপূর্ণ কোনও কিছু জগতে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় না।
ব্যবধান এক শতাব্দীর। তার মধ্যেই এতকিছু! বিবিধ ধ্যানধারণার মধ্যে সমন্বয় করে সেগুলো মানবমস্তিষ্কে ঢুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমন্বয় বা সামজ্ঞস্য সাধনের প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতার বার্তা। এ-জন্যই পণ্ডিতেরা বলেন, রেনে দেসকার্তেস (১৫৯৬-১৬৫০) যদি ইউরোপীয় দর্শনকে যৌক্তিক তত্ত্বের ভিত্তি দান করে থাকেন তবে ব্রনো, লেইবনিজ প্রমুখ চিন্তাবিদেরা যুক্তির ভিত্তিভূমিতে জ্ঞানকে ধরে রাখার বিষয়টাকে নিশ্চিত করেছিলেন। ইউরোপের এইসব ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা ভারতেও (India- Modi Government) মান্যতা অর্জন করেছিল। উন্নততর বিদ্যা অর্জনের লক্ষ্যে, উন্নততর জ্ঞানগর্ভ সামর্থ্য অর্জনের তাগিদে শিক্ষাকে সর্বজনীন করার বাসনায়, জ্ঞানের বিস্তার ও প্রসৃতির উদ্দেশ্যে, এদেশেও গুরুকুলভিত্তিক খুদে খুদে টোল ছেড়ে চালু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। শ্রুতিনির্ভর বৈদিক যুগ লিপি প্রণয়নের পথ বেয়ে আপন অভিজ্ঞতাকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে অনেক আগেই স্মৃতির ওপর জোর দিয়েছিল। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো ঘোষণা করেই দিলেন, স্মৃতি ভ্রংসাৎ বুদ্ধিনাশ-এর কথা। অর্থাৎ, মানববুদ্ধি শেষ বিচারে স্মৃতিনির্ভর একটা বিষয়।
আরও পড়ুন-বিরোধী নেতার কুরুচিকর মন্তব্য, প্রতিবাদের ঝড় উঠুক
যুগযুগ ধরে ভারতবর্ষ এই স্মৃতির ওপর নির্ভর করেই আপন জ্ঞানপ্রদীপের শিখা উজ্জ্বল করেছে। সুভাষিত বচননির্ভর বিদ্যা ভারতে যেভাবে বিস্তারলাভ করেছে, অন্য কোথাও তেমন দৃষ্টান্ত বিরল।
সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপ যেভাবে জ্ঞান সঞ্চয় ও জ্ঞানের হস্তান্তরের কথা বলেছিল, সেটার সঙ্গে ভারতে স্মৃতিশাস্ত্রের গুরুত্ববৃদ্ধি ও বিকাশের একটা মৌলিক পার্থক্য বর্তামান। ভারতবর্ষ জ্ঞানর বিস্তারে গুরুমুখীবিদ্যা ও গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আস্থা রেখেছিল। সেই পরম্পরায় লিঙ্গ ও জাতিবৈষম্য একটা বড়সড় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল। গুরু অর্জুনকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন না একলব্যকে শিষ্যত্ব দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, সেটা পুরোপুরি গুরুরই সিদ্ধান্ত ছিল। ইউরোপের শিক্ষা কাঠামোয় এই বিভেদ বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করতে পারেনি। অর্থাৎ দু’হাজার বছর আগেকার ভারতে জ্ঞানের প্রসৃতির আঙিনাটি নারী-পুরুষ ও উচ্চনিম্ন বর্ণবিভাজনের কারণে যেভাবে ধীরে ধীরে সর্বজনীন হয়ে ওঠার সুযোগ হারিয়েছিল, ইউরোপে তেমনটা ঘটেনি।
এ-কারণেই জগতের যাবতীয় জ্ঞানের ভাণ্ডারটি ভারতে সর্বজনীনভাবে আয়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। একটা সময়ের পর থেকে বিশ্বজনীন জ্ঞানচর্চার নিরিখে ভারত ইউরোপের থেকে পিছিয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পশ্চাৎ-অপসরণ প্রকট।
সেই পিছিয়ে পড়ার কারণে ইউরোপের সঙ্গে আপন ফারাক দূর করতে ভারত (India- Modi Government) তৎপর হয়েছে বিগত দুই শতাব্দী ধরে। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে প্রতীক ইত্যাদির ব্যবহারের সঙ্গে ভারতের পরিচিতি উনিশ শতকে আধুনিক যুগপুরুষদের আবির্ভাবের কারণে, তাঁদের উদ্যোগে, তাঁদেরই তৎপরতায়। একইভাবে শিক্ষাঙ্গনে নারীর প্রবেশ, মেয়েদের প্রথাগত শিক্ষালাভের অধিকার অর্জিত হয়েছে কঠিনতর লড়াইয়ের মাধ্যমে।
মুশকিল হল, দেড়শো বছর আগে, বহুবিধ সংগ্রাম ও সংস্কারের পথ ধরে আমরা শিক্ষার ক্ষেত্রে যা যা অর্জন করেছি, বর্তমান গেরুয়াপন্থীদের সনাতন বিদ্যাচর্চা আর হাতুড়ে অপবিজ্ঞানের জৌলুস প্রচারের সৌজন্যে সেসব আঁস্তাকুড়ে স্থান পেতে চলেছে। গেরুয়া শিবির কথায় কথায় পশ্চিমি শিক্ষার দূষণ নিয়ে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে। তহবিল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা গেরুয়াপন্থীদের প্রচারের যূপকাষ্ঠে শিক্ষাকে বলি চড়াতেও ইতস্তত করছেন না।
যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়, যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু পুরাতন, সেগুলোর হারনো গৌরবের খোঁজ করো, তবে তো আমরা এগিয়ে যাওয়ার পথটাই হারিয়ে ফেলব!
মোদি জমানায় শিক্ষাকর্তারা কি এই সহজ সত্যটা বুঝতে পারছেন না!