‘Macroeconomic policy can never be devoid of politics. It involves fundamental trade-offs and affects different group differently’ (সমষ্টিগত অর্থনৈতিক নীতি কখনও রাজনীতি-বহির্ভূত নয়। এটি মৌলিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং বিভিন্ন শ্রেণিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।)
নোবেল পুরস্কারজয়ী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগ্লিচ।
বাস্তব পরিস্থিতিও তাই। এ-বছর ১৩ এপ্রিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সম্মতি দিলে ভারত বাকি বিশ্বকে গম রপ্তানি করবে। ১২ মে কেন্দ্রীয় সরকার (Modi Government) ঘোষণা করল, ভারত ৯টি দেশকে গম রপ্তানি করবে। ১৪ মে একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে কেন্দ্র গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। সরকার থেকে বলা হল, উৎপাদন মার খাওয়ার জন্য গম রপ্তানি বন্ধ করতে হচ্ছে।
প্রকৃত সত্যটা কী?
চাষীদের কাছ থেকে সরকার যথেষ্ট পরিমাণে গম সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কি গম রপ্তানি বন্ধ করতে হল? অথবা গমের দামে রাশ টানতে কি গম রপ্তানি বন্ধ করা হল? তবে ঘটনা যে, গম রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় বিশেষ করে গম উৎপাদনকারীদের যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হল। গম রপ্তানির ফলে চাষিরা কিছুটা লাভের মুখ দেখেছিল।
অতীতে মনমোহন সিং সরকারের বিরুদ্ধে পঙ্গুত্বের অভিযোগ করতেন নরেন্দ্র মোদি (Modi Government)। এ-যাত্রায় গম রপ্তানির প্রশ্নে কার্যত কেঁচেগণ্ডূষে বিজেপি সরকার। বাস্তব তথ্যের আলোয় এবার বিচার করা যাক। একটি তালিকায় বিষয়টি দেখানো হল।
২০২০-’২১ অর্থবর্ষে ভারতে ১০৯৬ লক্ষ টন গম উৎপাদিত হয়েছে। ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে এটি বাজারজাত করা হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৭২ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি গম রপ্তানি করা হয়েছিল। ২ মিলিয়ন ডলারের বেশি (১৫,০০০ কোটি টাকার বেশি) বৈদেশিক মুদ্রা রোজগার হয়েছিল। নূন্যতম সহায়ক মূল্যে ৪৩৩ লক্ষ কুইন্টাল গম সংগ্রহ করা হয়েছিল সারা দেশে। গণবণ্টন ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার জন্য। ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে গম উৎপাদনের প্রাথমিক লক্ষমাত্রা ধার্য হয়েছিল ১১১৩ লক্ষ মেট্রিক টন। কিন্তু এই অর্থবর্ষে আশাতীত গরম আবহাওয়ার জন্য গম উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই লক্ষমাত্রা নেমে আসে ১০৫০ লক্ষ টনে। তথাপি এই উৎপাদন ২০২০-’২১ অর্থবর্ষের তুলনায় যথেষ্ট হ্রাস পায়নি। মাত্র ৫০ লক্ষ মেট্রিক টনের মতো হ্রাস পেয়েছে।
তৎসত্ত্বেও এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত কৃষকদের থেকে সরকার গম ক্রয় করেছেন মাত্র ১৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি করেছেন ১৪.৬৩ লক্ষ মেট্রিক টন। বাস্তব অবস্থা তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, ৫০ লক্ষ মেট্রিক টনের মতো গম কম উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও সরকার সংগ্রহ করেছেন ৪৩৩ লক্ষ মেট্রিক টনের পরিবর্তে মাত্র ১৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০২১-’২২ সালের সংগ্রহের মাত্র ৪৩ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রায় ২৫০ লক্ষ টন সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। অন্যদিকে ৭২ লক্ষ টন গম রপ্তানির পরিবর্তে সরকার মাত্র ১৫ লক্ষ টনের মতো রপ্তানি করেছে। অর্থাৎ ২০২১-’২২ সালের তুলনায় ২০ শতাংশের মতো রপ্তানি করেছে সরকার। তথ্যে আরও স্পষ্ট যে ৪৬ লক্ষ টনের মতো উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় গত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে সরকার ৬০ লক্ষ টন গম রপ্তানি কম করতে চলেছে এবং ২৫০ লক্ষ টন গম কৃষকদের থেকে কম সংগ্রহ করেছে। তাই সরকারের বক্তব্য এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত।
উৎপাদন কম হওয়ায় গম রপ্তানি বন্ধ করতে হয়েছে, বক্তব্যটি অসত্য। আসল সমস্যা হল সরকার চাষীদের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ গম কিনতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি সরকার ঠিক পরিমাণে গম সংগ্রহ করত, রপ্তানি বন্ধ করার প্রয়োজন হত না। সরকারের (Modi Government) এই সিদ্ধান্ত কৃষক-বিরোধী। এতে চাষিরা বিশ্ববাজারে বেশি দামে গম বিক্রির সুযোগ হারাল।
কার্যত কৃষকদের দু’দিক থেকে মারল মোদি সরকার। এক, ন্যূনতম দামে সরকারি সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হল। দুই, গম রপ্তানি বন্ধ হওয়ার ফলে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল কৃষকরা।
আরও পড়ুন: বিরোধী-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের গুলিতে জখম ২ তৃণমূলকর্মী, বনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ, গ্রেফতার ৫
সরকারি তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, সরকার গত এপ্রিলে প্রায় ২০০ লক্ষ টন গম মজুত রেখেছে। যার ফলে গণবণ্টনে ব্যাঘাত ঘটবে না। কিন্তু কৃষকদের ক্ষতি করা হল কেন?
কার্যত দাম নিয়ন্ত্রণে ও চাহিদায় হ্রাস টানতে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে গম ক্রয় বন্ধ করে দিল। সরকারি তথ্যেও দেখা যাচ্ছে গত এক বছরে গমের দাম শতকরা ১৯.৩ শতাংশ বেড়েছে। কৃষকদের হাতে অর্থ পৌঁছে না দিয়ে, কৃষকদের ক্ষতি করে, চাহিদার হ্রাস ঘটিয়ে সরকার দামের স্তর নিয়ন্ত্রণ করতেই একদিকে সরকার গম ক্রয় বন্ধ করল এবং অন্যদিকে গম রপ্তানিও বন্ধ করে দিল।
সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধিতেও দেশের অবস্থা খুবই খারাপ তা সরকারি তথ্যে স্পষ্ট। মোদির আমলে ভোগমূল্য সূচক গত ৮ বছরে সর্বাধিক। গত এপ্রিলে এই সূচক ৭.৮ শতাংশ। ২০১৪ সালের মে মাসে এটি ছিল ৮.৩৩ শতাংশ। এপ্রিল মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্য সূচক ৮.৩৮ শতাংশ। সাধারণ মানুষ বাঁচবে
কী করে?
একদিকে আমানতি জমার বাৎসরিক সুদ শতকরা ৪ শতাংশ বা তার কম, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি ৭.৮ শতাংশ। কার্যত আমানতি জমার প্রায় দ্বিগুণ মূল্যস্তর। এমনকী পাইকারি মূল্যস্তর প্রায় ১৫ শতাংশ যা ১৭ বছরে সর্বাধিক।
মোদি জমানার আগে, একটা সময় মুদ্রাস্ফীতির হার দুই অঙ্কে পৌঁছলেও স্থির আমানতি জমা ও সুদের তারতম্য খুব কম ছিল। সাধারণ মানুষের এত দুর্ভোগ ঘটেনি। এমনকী অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার স্থিরপুঁজি গঠনের অনুপাত জাতীয় আয়ের সাপেক্ষে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটেনি। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ মানুষ এরকম ভোগান্তি আগে কখনও ভোগেনি। এমনকী পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম এমন জায়গায় পৌঁছেছে যা আগে কখনও হয়নি। সুতরাং গমের উৎপাদন মার খাওয়ার অজুহাতে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা।
মোদ্দাকথা, মোদি সরকারের আমলে গত ৮ বছরে ভারতের গরিব ও নিম্নবিত্তরা কার্যত সর্বস্বান্ত। এটাই যেন মোদি সরকারের অহংকার।
সুকান্ত ভট্টাচার্য ঠিকই লিখেছিলেন ‘দরিদ্রদের রক্ত ক’রে শোষণ/ বিরাট অহংকারকে করো পোষণ।’