এই ক’দিন ধরে কী দেখছি আমরা? দেখছি, মাস লিডার আর নেতা-নেতা ভান-করা ন্যাতাদের ফারাক।
একজন মাস-লিডার, অর্থাৎ জননেতা, জননেত্রীর আমজনতার উপর বিপুল প্রভাব। তাঁর আহ্বানে, জনসভায় লক্ষ মানুষের সমাগম হয়ে যায়। সাধারণত এই অংশের নেতা-নেত্রীরা সাধারণ, গরিব অথবা মধ্যবিত্ত পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে উঠে আসেন সংগ্রাম, পরিশ্রমের সিঁড়ি দিয়ে। এর ফলে তাঁদের ভারতের মতো একটি জটিল এবং বহুধা বিভক্ত সমাজ-সংস্কৃতির জনমানস সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি হয়। অর্থাৎ, একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষ প্রতিদিন ঠিক কী চায়, তাদের অভাব এবং আকাঙ্ক্ষা কী, এসব নিয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকে এই মাস-লিডারদের। যে কোনও সময় তাঁরা মানুষের সঙ্গে মিশে যান।
আরও পড়ুন-চরের বাসিন্দাদের সুবিধা দিতে উদ্যোগী রাজ্য সরকার
মানুষের কাছে নিজের উচ্চমার্গের ইমেজ বজায় রাখার কোনও তাগিদ তাঁদের থাকে না। তাঁরা সচরাচর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেন। কখনও ঠিক বলেন, কখনও ভুল বলেন। কিন্তু প্রচণ্ড আবেগ নিয়েই রাজনীতিটা করেন। কোনও ক্যালকুলেটিভ কেরিয়ার হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যান না। পরবর্তীকালে সাফল্য পাওয়ার পর নিজের অর্জিত ভাবমূর্তিকেই সাকসেস ফর্মুলা হিসেবে তাঁরা বুঝে যান। এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেটাকে পুঁজি করে অগ্রসর হন। কেউ কেউ দীর্ঘ সাফল্য লাভ করেন। কেউ কেউ আবার বিচ্যুত হন সাফল্যসরণি থেকে। কিন্তু চিরকাল তাঁদের সঙ্গে থেকে যান তাঁদের প্রতি একান্ত মুগ্ধ অনুগামী অথবা জনতা। তাঁকে ওই জনতা শত ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও ‘আমাদের লোক’ হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে, আর একরকম রাজনীতিবিদ আছেন যাঁরা ইংলিশ স্পিকিং, আছে হাই প্রোফাইল শিক্ষাগত যোগ্যতা।
আরও পড়ুন-ব্লাড শুগারে নীরব মৃত্যুর হাতছানি, ৪ বছরে ডায়াবেটিস রোগী বেড়েছে ৪৪ শতাংশ
ধীরস্থির কথাবার্তা, পরিশীলিত শব্দচয়ন করেন। তাঁদের বক্তৃতায় আক্রমণাত্মক মেঠো ঝাঁজ নেই। আবেগের তুলনায় যুক্তি এবং নিজের রাজনৈতিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার সূক্ষ্ম ক্যালকুলেশন থাকে তাঁদের। অথচ ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে দেখা গিয়েছে আশ্চর্যজনকভাবে এই শ্রেণির মানুষের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক থাকে না। তাঁদের মেধা, শিক্ষা, প্রশাসনিক দক্ষতাকে কাজে লাগায় সংশ্লিষ্ট দল। বিনিময়ে তাঁদের বিধানসভা, লোকসভা অথবা রাজ্যসভায় জয়ী করিয়ে মন্ত্রী করে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করে দল। এই ইংলিশ স্পিকিং এলিট নাগরিক রাজনীতিবিদদের নিয়ে মুগ্ধতা আছে। কিন্তু তাঁদের একঝলক দেখার জন্য প্রবল গরমে কয়েকলক্ষ মানুষ হাজির হয়ে যাবে জনসভায় এরকম হয় না। অর্থাৎ এই রকম রাজনীতিবিদদের জনমোহিনী সম্মোহনী শক্তি নেই। একাই নিজেকে অথবা দলকে জিতিয়ে আনবেন সেই ক্ষমতা তাঁদের নেই।
আরও পড়ুন-বাংলায় লেখা হবে ওষুধের মাত্রা, নির্দেশিকা জারি করল রাজ্য সরকার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম শ্রেণির রাজনীতিক। তিনি আপন সম্মোহনী শক্তিকে ভোটব্যাঙ্কে পর্যবসিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য। এটা সর্বজ্ঞাত সত্য। পক্ষান্তরে, ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির নেতাদের ক্ষেত্রে সত্য হল একক ক্যারিশমার তুলনায় হিন্দুত্ব রাজনীতির উত্থান ছিল তাঁদের উত্থানের প্রধান অনুঘটক।
এটা পুনঃ পুনঃ প্রমাণিত। আরও একবার প্রমাণিত হল এবার।
আরও পড়ুন-প্রার্থী খুঁজতে নাজেহাল অবস্থা বিরোধী রাজনৈতিক দলের, পাহাড়ে ২২ বছর পর পঞ্চায়েত
মোদি মন্ত্রিসভার প্রত্যেক হাইপ্রোফাইল এলিট মন্ত্রীদের মন্ত্রক ভারত সরকারের সবথেকে ব্যর্থ বিভাগ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দেশের বেকারত্ব আর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ব্যর্থতা সর্বজনবিদিত। শিল্প ও বাণিজ্য কতটা ব্যর্থ তার প্রমাণ লাগাতার কয়েক বছর ধরে রফতানি ও শিল্পস্থাপনের হার সম্পূর্ণ তলানিতে। পেট্রোলের দাম আকাশছোঁয়া। বিদ্যুতের দাম দেশজুড়ে চরম আকার নিয়েছে। চিনের লাগাতার আগ্রাসন থেকে স্পষ্ট ভারতের বিদেশমন্ত্রকের দুর্বলতা। এবং রেল! বালেশ্বর দুর্ঘটনা এবং সাড়ে তিন লক্ষ শূন্যপদ পূরণ না হওয়া। সব ক্ষেত্রেই বোঝা যাচ্ছে রেলমন্ত্রীর অদক্ষতা কতটা!
আরও পড়ুন-পূর্ব মেদিনীপুরে বাড়ানো হচ্ছে ম্যানগ্রোভ
বারবার দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে ভারতীয় রেল। স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮১ সালে। বিহারে মানসী ও সারসার মধ্যবর্তী স্থানে। আটশোর বেশি যাত্রী বোঝাই একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে বাগমতী নদীতে পড়ে যায়। সে-সময় প্রবল ঝড়ও বইছিল সেখানে। ওই ঘটনায় সাড়ে সাতশোর বেশি যাত্রীর মৃত্যু হয়। গত শতকের শেষদিকে ফিরোজাবাদ (১৯৯৫), পাঞ্জাবের খান্না (১৯৮৮) এবং বাংলায় গাইসাল (১৯৯৯) রেল দুর্ঘটনাতেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়। রেল দুর্ঘটনায় লাগাম পরেনি বর্তমান শতকেও। গত দু’দশকে বড় রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা অন্তত ১৩। তাতে এক-একটিতে প্রাণহানির সংখ্যা ৫০ থেকে কয়েক শত। যেমন সদ্য ঘটে যাওয়া বাহানাগার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে পৌনে তিনশো। তবে বেসরকারি সূত্রে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। এই ঘটনায় জখম হয়েছেন নানা বয়সি সহস্রাধিক নরনারী। এই চিত্র এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, রেল পরিষেবার উন্নতি নিয়ে মোদি সরকার যতই লম্বা-চওড়া দাবি করুক না কেন, তা বাস্তবিকই ফাঁকা বুলি মাত্র। অতীতের একের পর এক দুর্ঘটনা থেকে রেল কর্তৃপক্ষ যে কোনও শিক্ষাই নেয়নি, তাও পরিষ্কার।
আরও পড়ুন-প্রার্থী না পেয়েই বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত গেল আদালতে
মোদিবাবুর সরকার বাহাদুর সদাই দাবি করেন, ‘সব ঠিক হ্যায়!’ কিন্তু বাহানাগা দুর্ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে, সবকিছু মোটেই ঠিক নেই। তাই, সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই নানাভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিরক্ত করার চেষ্টা করেছে। মাঠে নেমেছে ডবল ইঞ্জিন। ইডি আর সিবিআই। মাস লিডার হওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই জনবিচ্ছিন্নরা নানা খেলা খেলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
ন’বছর সরকার চালানো নরেন্দ্র মোদির কাছে আজ দেশ জানতে চায়, কেন তাঁর আমলে রান্নার গ্যাসের দাম ১৬৯, সর্ষের তেল ৫৮, আটা ৫৬, দুধের দাম ৫১ শতাংশ বেড়েছে? কেন ভারতে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলেছে? কেন বাড়ছে ধনী- দরিদ্রের ব্যবধান? ন’বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হল না কেন? কেন তাঁদের দৈনিক গড় আয় মাত্র ২৭ টাকা? সে প্রশ্ন উঠেছে।
আরও পড়ুন-বাংলা জুড়ে ভোট প্রস্তুতি
প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে, কেন তাঁর জমানায় দলিত আদিবাসী, এসটি, এসসি, মহিলা ও সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়েছে ২৩ শতাংশ? করোনায় মৃত ৪০ লক্ষ মানুষের পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হয়নি! এলআইসি’র মতো একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে মোদির ব্যবসায়ী বন্ধুর কাছে জলের দরে বেচে দেওয়া হল কেন? তার জবাব চায় মানুষ। প্রশ্ন রয়েছে, ভারত সীমান্তে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় অনুপ্রবেশ করা চিনের সঙ্গে ১৮টি বৈঠকের পরও কেন মিটল না সীমান্ত সমস্যা? কেন বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
কেন? কেন? কেন?
জনতার মন কি বাত না শুনতে পাওয়া মোদি এবার গণ গর্জনের স্বনন শোনার জন্য তৈরি থাকুন।