প্রতিশ্রুতি হোক কিংবা রাজধর্ম, পালন না করাটাই মোদি সরকার প্র্যাকটিস করে ফেলেছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির ইস্তাহার (সঙ্কল্পপত্র) প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং দলের তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহ। ইস্তাহারে ৭৫টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেখানে পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রসঙ্গে যে লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— প্রতিটি পরিবারের জন্য পাকাগৃহ নির্মাণ, সব বাড়িতেই থাকবে পাকা শৌচাগার ও পরিস্রুত পানীয় জলের সংযোগ, প্রতিটি গরিব পরিবারের জন্য রান্নার গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবস্থা করা, নিশ্চিতভাবে সব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান এবং সব নাগরিকের অন্তত একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকবে। কেন্দ্রীয় সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেসের (আইআইপিএস) সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে, দেশের ১৯ শতাংশ পরিবারে শৌচাগার নেই এবং ৪০ পরিবার রান্নার গ্যাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আরও পড়ুন-মণিপুর নিয়ে উত্তাল কাঁথি
প্রযুক্তি-নির্ভর ইভিএম যন্ত্র প্রায় তার জন্মলগ্ন থেকেই অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি ছিল, ভোটযন্ত্র বা ইভিএম-এ কোনও কারচুপি হলে তা ধরা পড়বে ভিভিপ্যাট মেশিনে। ইভিএম-এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া এই যন্ত্রকে আসলে দ্বিতীয় ধাপের পর্যবেক্ষণ বলা যায়। ২০১৯ সালে সর্বশেষ লোকসভা ভোটের পর তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে দাঁড়িয়ে আইন মন্ত্রকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, দেশের কোনও কেন্দ্রে কি ইভিএম এবং ভিভিপ্যাটের মধ্যে হিসেবে গরমিল ঘটেছে? জবাবে তৎকালীন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছিলেন, এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে লোকসভায় জানাবেন। তারপর চার বছর যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। সেই রবিশঙ্কর প্রসাদও আর আইনমন্ত্রীর পদে নেই।
আরও পড়ুন-করমণ্ডল বিপর্যয়ের দু’মাস পার, এখনও এইমসে দাবিহীন ২৯ দেহ!
তিনি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গ-ভ্রমণে এসেছিলেন। কিন্তু সংসদে তোলা সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গিয়েছে! সেই প্রশ্নের জবাব আজও দেয়নি মোদি সরকার। গত লোকসভা ভোটে একাধিক রাজ্যে ট্রাকে করে ইভিএম পাচারের ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ। শাসকদলের বিরুদ্ধে ইভিএম বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। কারচুপি আটকাতে ইভিএম-এ কোনও প্রার্থীর ভোট প্রাপ্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে ভিভিপ্যাট স্লিপে ভোট প্রাপ্তির হিসাব। অন্তত ৫০ শতাংশ বুথে ইভিএম ও ভিভিপ্যাট স্লিপ মেলাতে হবে। বিরোধীদের এই সঙ্গত দাবি সত্ত্বেও কেন্দ্র মাত্র দুই শতাংশ বুথে তা মিলিয়ে দেখার ব্যবস্থা করে। এই অবস্থায় ইভিএম সংক্রান্ত সংশয়গুলি দূর করতে নির্বাচন কমিশনের লিখিত বক্তব্য জানতে চায় বিরোধীরা। কমিশন কোনও বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়াই যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। কমিশনের মতো কেন্দ্রীয় সরকারও এই প্রশ্নে কার্যত চুপ! অথচ বছর ঘুরলেই আরও একটি লোকসভা ভোট হতে চলেছে দেশে।
অর্থাৎ, সংসদের ভেতরে হোক কিংবা ভোট প্রচারের মঞ্চে, সর্বত্র মোদিবাবুদের প্রতিশ্রুতি পালনে ভূমিকা একই রকম। প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করাটাই এই সরকারের দস্তুর।
আরও পড়ুন-মণিপুর নিয়ে উত্তাল কাঁথি
গত ২০ জুলাইয়ের ঘটনা। মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানোর এক সীমাহীন লজ্জার ভিডিও সামনে আসতেই কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ। নিন্দার ঝড় ধেয়ে এসেছিল পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেদিনই বাধ্য হন ঘটনাটির নিন্দা করতে। কিন্তু তার মধ্যে তাঁর রাজধর্ম পালনের কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায়নি; বরং তাঁর অতি-সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া সকলকে অবাকই করেছিল। মোদিজির ছবি দেওয়া পোস্টারে মণিপুরবাসীরা লিখেছিল, ‘এই ব্যক্তিটিকে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগেই শেষবার দেখা গিয়েছিল। তার পর থেকে তাঁকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ এহ বাহ্য! কড়া প্রতিক্রিয়া আসে সুপ্রিম কোর্টের তরফে। দেশের শীর্ষ আদালত জানতে চায়, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কেন্দ্র এবং মোদি সরকার কী পদক্ষেপ করেছে?
আরও পড়ুন-রাষ্ট্রপতির কাছে ‘ইন্ডিয়া’: মণিপুর থেকে দুই নারীকে রাজ্যসভায় পাঠান, আর্জি জানাল তৃণমূল
ঘটনাটির উপর প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ অবিলম্বে রিপোর্ট তলব করে কেন্দ্র ও মণিপুর রাজ্য সরকারের কাছে। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘এই ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সরকার যদি কোনও পদক্ষেপ না করে সেক্ষেত্রে আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে পদক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।’ সুপ্রিম কোর্ট আরও মন্তব্য করে, ‘সরকারের উচিত অবিলম্বে পদক্ষেপ করা। গণতন্ত্রে এই ধরনের ঘটনা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কয়লাকে হাজারবার ধুলেও তার কালো দূর হয় না। কথাটি মোদি সরকারের জন্যই যেন প্রাচীনকালে কেউ উচ্চারণ করেছিলেন। শীর্ষ আদালতের তিরস্কার, পরামর্শ, নির্দেশ প্রভৃতি কোনও কিছুতেই মণিপুর পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রতিনিধি দলের মণিপুর পরিদর্শন রুখতেই ব্যস্ত ছিল বিজেপি। তাই, গত সোমবার প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় কেন্দ্রকে ফের ভর্ৎসনা করে বলেছেন, ‘অন্য রাজ্যকে টেনে মণিপুরের পরিস্থিতি ঢাকবেন না।’ আর মঙ্গলবার সেই রেশ টেনে তাঁরই নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ সরাসরি জানিয়ে দিল, ‘তদন্তটাই দায়সারা হচ্ছে। সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে মণিপুরে। আইন-শৃঙ্খলার অস্তিত্বই নেই। এটা স্পষ্ট, পুলিস ওই রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।’
আরও পড়ুন-একদিন এগোল ভারত-পাক ম্যাচ
কী বলছেন দেশের প্রধান বিচারপতি তাঁর আসনে বসে, আর একবার শুনে নেওয়া যাক।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘৪ মে ঘটনা ঘটল। অথচ, এফআইআর দায়ের হল ১৮ মে। একটা বিষয় স্পষ্ট— এফআইআর দায়ের করার ক্ষেত্রে ঢিলেমি হয়েছে। একই অবস্থা তদন্ত প্রক্রিয়াতেও। দেরিতে এফআইআর দায়ের, কোনও গ্রেপ্তারি নেই, এমনকী বয়ানও রেকর্ড করা হয়নি! বোঝাই যাচ্ছে, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা এবং সাংবিধানিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এদিন শুনানির শুরুতে মণিপুর সরকার আদালতকে জানায়, মে মাসে রাজ্যে অশান্তি ছড়ানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৬ হাজার ৫২৩টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে ১১টি নারী-নিগ্রহ সংক্রান্ত। কেন্দ্র ও মণিপুর সরকারের তরফে সওয়াল করতে উঠে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা জানান, ইতিমধ্যেই এক নাবালক-সহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-সবে বরাত-করম পুজোতেও ছুটি ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী
এরপরই আদালত পাল্টা বলে, ‘ওই সাড়ে ৬ হাজার এফআইআরে কতজনের নাম রয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? এই সবই সরকারকে জানাতে হবে।’ অন্যদিকে, এদিন সকালেই সর্বোচ্চ আদালত সিবিআইকে মণিপুরের দুই নির্যাতিতার বয়ান রেকর্ড করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। মণিপুর-কাণ্ডের তদন্তে পর্যবেক্ষক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়ে এক দল গঠনের আভাসও এদিন দিয়েছে আদালত।’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মঙ্গলবারই মণিপুর নিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে চিঠি লিখেছেন দিল্লির মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়াল। গত সপ্তাহে মণিপুর এসে রিপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন স্বাতী। সেটাই রাষ্ট্রপতিকে পাঠিয়ে তিনি অবিলম্বে রাজ্যের বীরেন সিং সরকারকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছেন। তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে মণিপুর পুলিসকে ছেঁটে ফেলার আর্জিও জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু চোরা কি কখনও ধর্মের কাহিনি শোনে না শুনতে চায়? এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি।