কোথায় গেল সেই মহান বুলি ‘না খাউঙ্গা অউর না খানে দুঙ্গা’!
কোথায় গেলেন চরম দেশাত্মবোধের গ্যারান্টার, পরিবারতন্ত্রকে রেয়াত না করার গ্যারান্টার, আর দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের গ্যারান্টার?
ফুটো ফানুস আকাশে উড়িয়ে বোকা বানাচ্ছিলেন আর এক দশকের মধ্যে সব ফুস হয়ে গেল!
আরও পড়ুন-এবার শিল্প সম্মেলনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু
সৌজন্যে ক্যাগ রিপোর্ট।
ইউপিএ-২ সরকারকে হটাতে, ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর মুখ নরেন্দ্র মোদি আকর্ষক স্লোগান তুলেছিলেন, ‘ঘুষ খাবও না, কাউকে খেতেও দেব না।’ আর এখন শুনছি বদলে যাওয়া বুলি। ‘খাউঙ্গা অউর জরুর খানে দুঙ্গা।’ বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বিরুদ্ধে মোদির অন্যতম প্রধান অভিযোগ হল দুর্নীতি। তাঁর কথায়, দুর্নীতিবাজ দলগুলি সব একজোট হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি ব্যবস্থা নিলেই বিরোধীরা রে রে করে উঠছে।
আরও পড়ুন-ফিটনেসই চিন্তা জুয়ানের, সাদিকুদের মাথায় মুম্বই
আর নিজের বেলায়?
মোদি সরকারের নিজস্ব কেন্দ্রীয় সংস্থা কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, সংক্ষেপে সিএজি বা ক্যাগ এই সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। দোসর হয়েছে সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন, সংক্ষেপে সিভিসি। ক্যাগের নিশানায় একটি নয়, মোদি জমানায় ৮টি দুর্নীতি ও বেনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে অদূরদর্শিতারও অভিযোগ।
ক্যাগ আধার নথিভুক্তিকরণের কিট এবং নোটের (টাকার) সিকিওরিটি ম্যাগনেটিক থ্রেড— এই দুটি ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা জলে গিয়েছে বলে রিপোর্ট দিয়েছে।
আরও পড়ুন-রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের এলাকায় এখনই চালু হচ্ছে না মাসিক বিলের ব্যবস্থা, জানালেন বিদ্যুৎমন্ত্রী
দুর্নীতি নিয়ে সরব আরও এক কেন্দ্রীয় সংস্থা সিভিসি। কেন্দ্রীয় সরকারি মন্ত্রকের কর্মী ও আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করে এই কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এক বছরে সিভিসিতে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ২৫৩টি। মোট ১৬টি মন্ত্রকের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ। অভিযোগের বেশিটাই প্রধানমন্ত্রীর ডানহাত অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে রেল ও ব্যাঙ্ক। প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় অপর এক মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের রেল মন্ত্রক। আর, ঋণগ্রহণের নামে একাধিক ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে কয়েকজন শিল্পপতির বিদেশে গা-ঢাকা দেওয়ার ঘটনা। নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, যতীন মেহতা প্রভৃতির নাম নিয়ে হইচই সার হল গত পাঁচ বছর ধরে। মজার বিষয় হল, কর্মী ও আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সিভিসির সুপারিশ অনেকক্ষেত্রেই কার্যকর করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। আসলে কর্মী-আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আঙুল তুললে পাল্টা হিসেবে কেঁচো খুঁড়তে সাপও বেরিয়ে যেতে পারে। এই আতঙ্কেই হয়তো সিভিসি-র সুপারিশ কার্যকর না করে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রক।
আরও পড়ুন-সফল ল্যান্ডিং: চন্দ্রযান-৩ টিমকে শুভেচ্ছা, উচ্ছ্বসিত মুখ্যমন্ত্রী
এদেশে যা-ই ভাল হয়, সেটাই নাকি মোদিজির সাধের প্রকল্প। মোদিজি শুরু করেছিলেন ‘ভারতমালা’। তৈরি হবে রাস্তা, উড়ালপুল, সুড়ঙ্গ, এলিভেটেড করিডর, ওভারপাস, বাইপাস, রিংরোড। উদ্দেশ্য, যানজট ছাড়াই এক জায়গা থেকে অন্যটিতে পৌঁছে যাওয়া। হিসেব ছিল, দেশ জুড়ে মোট ৮৩ হাজার ৬৭৭ কিমির উপর এই কাজ হবে। আর তাতে খরচ হবে সাড়ে ১০ লক্ষ কোটি টাকা। সোজা হিসেবে প্রতি কিলোমিটারে খরচ প্রায় ১২ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে ধরে নেওয়া যাক, সেটাই বেড়ে হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। অন্তত সরকারি হিসেব এটাই। কিন্তু ক্যাগ বলছে, দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরিতে কিলোমিটার পিছু খরচ হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-চাঁদের মাটি ছুঁল চন্দ্রযান-৩: সফল অবতরণ বিক্রমের, চতুর্থ স্থানে ভারত
শুধু ভারতমালায় তো দুর্নীতির ম্যারাথন থেমে নেই! এরপর আসছে আয়ুষ্মান ভারত। এ-ও প্রধানমন্ত্রীর সাধের এক প্রকল্প। ক্যাগ এক্ষেত্রে কী কী বলেছে দেখা যাক : ১) ২০টি ভুয়ো ফোন নম্বরে আয়ুষ্মান ভারতের কার্ড করিয়েছেন ৫০ হাজার, ২) মারা যাওয়ার পরও ৮৮ হাজার ৭৬০ জন রোগী চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছেন। আবার সরকার সেই চিকিৎসার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচও করেছে। ৩) প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষের ফোন নম্বর ৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯। ৪) কোনও কোনও পরিবারের সদস্যের সংখ্যা ২০১।
বিজেপির আইটি সেলের মুখপাত্র সাফাই দিচ্ছেন, সড়ক পরিবহণমন্ত্রী অস্বীকার করছেন এবং সর্বত্র যুক্তিটা এক— ক্যাগ হিসেবে ভুল করেছে। এমন কিছুই হয়নি। টুজি দুর্নীতি, কয়লা কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা নিয়ে কীসের ভিত্তিতে যেন বিজেপি মার-মার কাট-কাট বাধিয়ে দিয়েছিল? সেটাও কিন্তু ক্যাগের রিপোর্ট। সেটা এখন ভুলব কী করে?
আরও পড়ুন-রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের এলাকায় এখনই চালু হচ্ছে না মাসিক বিলের ব্যবস্থা, জানালেন বিদ্যুৎমন্ত্রী
২০১২ সাল। ওই বছরের ক্যাগ রিপোর্ট। তৎকালীন গুজরাত সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতার অভাব বাজেট ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছিল ক্যাগ। টেন্ডার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, উন্নয়নমূলক কাজের এস্টিমেট তৈরিতে ঢিলেমি, জমি না পাওয়া—এই সবকিছুকেই দায়ী করেছিল ক্যাগ। আর সেই সময় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী কে ছিলেন? উত্তরও জানা— নরেন্দ্র মোদি।
তিনি সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার স্বপ্ন দেখান, নতুন ভারতের স্লোগান তোলেন, পাকিস্তানকে কচুকাটা করার হুমকি দেন, আর বিরোধীদের তাচ্ছিল্য করেন। কিন্তু ক্যাগ রিপোর্ট নিয়ে তাঁকে মুখ লুকোতে হয়।
আরও পড়ুন-ধূপগুড়ি উপনির্বাচন: সৌজন্যের রাজনীতি দেখাল তৃণমূল, প্রয়াত বিজেপি বিধায়কের বাড়িতে ঘাসফুল-প্রার্থী
১৫ অগাস্ট নরেন্দ্র মোদি এক হাজার বছরের গোলামির অবসান এবং এক হাজার বছরের গৌরবের শুভ সূচনার কথা বলেছেন। স্পষ্টতই, দুই সহস্রাব্দ ঠিক সেই জায়গায় মিলিত হয়েছে, যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন কথাটি তিনি বলেছেন। তাঁর কথাটি সত্য হলে ভাষণটি আগের কয়েকটি ঘটনার মতোই যুগান্তকারী— আপেল পতন, পরমাণু বিভাজন অথবা চাঁদে মানুষের অবতরণের মতোই ঘটনা। এ তো গেল মোদিজির স্বভাবসুলভ আত্মপ্রচার। অচ্ছে দিন, ১৫ লক্ষ টাকার খোয়াব, কৃষকের আয় দ্বিগুণ, পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতির মতো বিশুদ্ধ মিথ্যাচার। এর সঙ্গে রয়েছে বিরোধীদের উপর আক্রমণ। এই দেখতে দেখতে বিগত একদশক চোখে সয়ে গিয়েছে। মাঝে-মাঝেই রিপিট টেলিকাস্ট! চোখের পলকে আলোচনা ছাড়াই একটার পর একটা বিল পাশ, আইন প্রণয়ন বিগত ন’বছরে জলভাত। এই যদি অচ্ছে দিনের নমুনা হয়, তবে আমাদের দেশের আগামী গভীর অন্ধকারে ঢাকা।