সুস্মিতা নাথ: এ সপ্তাহে আমার ডিউটি মেল ওয়ার্ডে। টানা তিনদিন হল নাইট শিফট চলছে। চলবে আরও দু’দিন। রাত্রিকালীন মেল ওয়ার্ডটার একটা দুর্নাম আছে। দুর্নামটা পুরোটাই অপ্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহকে ঘিরে। এই ওয়ার্ডে ডিউটি করতে এসে আমাদের অনেকেরই নানা ধরনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। অনেকে তো সরাসরি ভূতও দেখেছে। আমার যদিও সাক্ষাতে তেমন কিছু দেখার অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু তাদের উপস্থিতি অনুভব করেছি অজস্রবার। নার্সের চাকরিতে এসব অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। তা ছাড়া আমাদের কাজটা এমন যে, রাত-দিন মৃত্যু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। অজস্র মানুষ শেষবারের মতো শ্বাস নিয়েছে এই হাসপাতালেই। কত অপমৃত্যু, কত আকস্মিক মৃত্যুও যে দেখলাম! ফলে হাসপাতাল চত্বরে বিদেহী আত্মারা ঘুরে-ফিরে বেড়াবে, এই তো স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন-কুচিপুড়ি নৃত্যে মাতিয়ে দিল ঋষি-কন্যা অনুষ্কা
সারা হাসপাতাল জুড়েই নানা অপ্রাকৃতিক ঘটনার কথা শোনা যায়। সব হয়তো সত্যি নয়, কিছু গুজব বা কল্পকাহিনিও আছে। কিন্তু যা রটে তার কিছু তো বটে। আর সে সব গল্প বা ঘটনার আধিক্য বেশি মেল ওয়ার্ডকে ঘিরেই। তবে এসব নিয়ে ভাবলে বা ভয় পেলে তো চাকরিই করতে পারব না। আমিও তাই ভাবি না। নয় নয় করে বারো বছর, অর্থাৎ একটা পুরো যুগ কাটিয়ে দিলাম এই হাসপাতালে, এই চাকরিতেই।
মূলত এ কারণেই অনেকের কাছে নাইট শিফট অপছন্দের। কিন্তু আমার জন্যে এটাই সুবিধাজনক। কারণ দিনের বেলায় বাড়িতে থাকতে পারলে ছেলে দুটোকে সঙ্গ দিতে পারি। আর রাতে তো ছেলেদের বাবা অর্থাৎ অভিই থাকে বলে নিশ্চিন্ত। অভির দশটা-পাঁচটার চাকরিতে শিফট খাটার ঝামেলা না থাকায় রক্ষে।
আরও পড়ুন-রাষ্ট্রসংঘে ইরানের বিরুদ্ধে ভোট দিল না ভারত
আজও যথারীতি ডিউটিতে এসেছি। এখন রাত বারোটা পেরিয়েছে। অনেকক্ষণ আগেই নিয়মমাফিক রাউন্ড সেরে এসে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছি। নার্সদের জন্যে বরাদ্দ এই চৌকো ঘরটার তিনদিকে তিনটে দরজা। বাঁদিকের দরজা খুললে একটা করিডর। করিডরের উল্টোদিকে মেল ওয়ার্ডের দরজা। ডানদিকের দরজাটা খুলেছে ওয়াশরুমের দিকে। আর সামনের দিকের দরজাটা খুললে এক লম্বা এবং প্রশস্ত বারান্দা। এই বারান্দার অপরপ্রান্তে আছে প্রসূতি বিভাগ। তার পাশাপাশিই ফিমেল ওয়ার্ড।
ডিউটির এই সময়টা অনেকে পারলে ঘুমিয়ে নেয়। কিন্তু কাঁধে কোনও দায়িত্ব থাকলে আমার ঘুম ঠিক আসে না। দশ নম্বর পেশেন্টের অবস্থা ভাল নয়। স্যালাইন সহ ওষুধ দেওয়া চলছে। সেজন্যে নির্দিষ্ট বিরতির পরপর দেখে আসতে হচ্ছে। কাজেই ঘুমোনো একেবারে অসম্ভব।
চেয়ারে হেলান দিয়ে তাই এক মনে মোবাইল ঘাঁটছিলাম। একটু হয়তো তন্দ্রা মতো এসেছিল, অমনি ঘোর কাটল দরজায় টক টক আওয়াজটা শুনে। আওয়াজটা আসছে বারান্দার দিক থেকে। এ আওয়াজ আমার পরিচিত। শুধু আমার নয়, যারা এখানে রাতের ডিউটি করেছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই পরিচিত। এও জানি, একটু পরেই সামনের দরজাটা নিজের থেকেই খুলে যাবে। আর দমকা হাওয়ার মতো একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে ঢুকবে। সঙ্গে ছেয়ে থাকবে মিষ্টি ধূপের গন্ধ। বড়জোর দু’-চার মিনিট। এরপর অবশ্য তেমন কিছু আর হবে না। তবে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে থাকবে অনেকক্ষণ।
আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে যৌথবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হত ৪ মাওবাদী
শব্দটা শুনে আমি অন্যমনস্ক হতে চাইলাম। মোবাইল ফোনে চোখ আটকে রেখে পরবর্তী ব্যাপারগুলোর অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করারও নেই। চেষ্টা করলাম যাতে চোখ কিছুতেই দরজার দিকে না-যায়। কিন্তু নাহ, এবার যেন খানিক ব্যতিক্রম ঘটছিল। দরজায় নক হয়েই চলল, কিন্তু আবজানো দরজা খুলল না। এবার মনে সন্দেহ হল, অন্য কেউ নয়তো? আমি দরজার দিকে ঘুরলাম। তখনই মৃদু স্বরে কেউ বলে উঠল, “দিদি আসব?”
এবার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর সারার অনুভূতি হল। নিশ্চয়ই কোনও রোগীর আত্মীয় হবে। কিছু কিছু ক্রিটিক্যাল রোগীর আত্মীয়রা হাসপাতালে থেকে যান। তাঁদেরই কেউ মনে করে আমি বললাম, -“আসুন। দরজা খোলাই আছে।”
আরও পড়ুন-চিনা টেলিকম সংস্থায় নিষেধাজ্ঞা বাইডেনের
দরজা ঠেলে ঢুকল কমবয়সি একটি বউ। মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগলেও সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম না। পরনে সবুজ ফুলছাপ সিন্থেটিক শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ। গোল মুখে দুই ভুরুর মাঝখানে সবুজ টিপ। নাকের পাশে একটা বড় কালো তিল। সামনের ছোট করে কাটা চুলগুলি গালের উপরে এসে রয়েছে। বউটি একটা ছোট্ট কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “দিদি এটা আমার হাজব্যান্ডের নম্বর। একটু ফোন করে দেবেন? আমার ফোনটা পাচ্ছি না বলে তাঁকে জানাতে পারছি না। বলবেন মেটারনিটিতে আছি।”
সামান্য একটু যে বিরক্ত হলাম না, তা নয়। মনে মনে ভাবলাম, এই নিশিরাতে বরকে ফোন করার কথা মনে পড়ল? তবে বিরক্তিটা মুখে প্রকাশ করলাম না। আমি আমার মোবাইলটা এগিয়ে ধরে বললাম, “এই নিন, আপনিই কথা বলে নিন।”
কিন্তু বউটি তা না করে শুধু বলল, “বাচ্চাকে একা রেখে এসেছি দিদি, আমি যাচ্ছি। আপনি খবরটা দিলেই হবে।”
আরও পড়ুন-প্রয়াত অভিনেতা বিক্রম গোখেল
তারপরেই সে চলে গেল। ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে গেল, বউটি কে। গেল পরশুর ঘটনা। সকাল সাড়ে সাত কি আট হবে, নাইট ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি একটা ছোটখাটো জটলা। একটি কমবয়সি বউ ফুটপাথের ধার ঘেঁষে পড়ে আছে। প্রায় অচেতন। কাছে যেতেই বুঝলাম, সে অন্তঃসত্ত্বা এবং অবস্থা সুবিধের নয়। জানা গেল, এক চলন্ত অটোর ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে সে। মহিলার পরিচয় জানা নেই। তবে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ভদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু সঙ্গে কোনও ব্যাগ বা মোবাইল ফোন পাওয়া গেল না। হয়তো ছিল, কিন্তু তার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কেউ নিশ্চয়ই সেসব নিয়ে পালিয়েছে। দেখে বুঝলাম, খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসার প্রয়োজন। সেজন্যে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ফোন করি। ওখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্স চলে আসে। তারপর অ্যাম্বুল্যান্সে তাকে উঠিয়ে আমি বাড়িতে রওনা হই।
এরপর অবশ্য বউটির কোনও খবর নেওয়া হয়নি। তালেগোলে ভুলেও গিয়েছিলাম। এখন বোঝা গেল, তার সন্তান হয়েছে। এবং সন্তানটি সুস্থও আছে। বউটিও যে সুস্থ, এও তো দেখেই বোঝা গেল। মনে মনে একটা স্বস্তি অনুভব হল। আমি এবার চিরকুটটা দেখে নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করি। ফোনটা পেয়ে বউটির স্বামী একেবারে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি যে কী খুশি হয়েছেন বলার নয়। ভদ্রলোক বললেন, দিন দুয়েক স্ত্রীর কোনও খবর না-পেয়ে ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটাচ্ছিলেন। কাটোয়ার থেকে হাওড়ায় বোনের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল তাঁর স্ত্রী। তারপরেই আকস্মিক নিখোঁজ হয়ে যায় সে। এরপর থেকে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় ভয়ঙ্কর এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল পরিবারের লোকেরা। পুলিশে মিসিং ডায়েরি থেকে শুরু করে আত্মীয়-বান্ধব সবার বাড়িতে খোঁজ করেছেন গত দু’দিনে। কিন্তু কোনও সন্ধান না-পেয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন ভদ্রলোক। এমন সময়ে স্ত্রী এবং নবাগত সন্তানের খবর পেয়ে তিনি যাকে বলে উচ্ছ্বসিত। ভদ্রলোক জানালেন, তিনি তখনই রওনা হচ্ছেন হাসপাতালের উদ্দেশে। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন রাখি।
আরও পড়ুন-ফ্ল্যাট কেনা মাত্রই এবার মিউটেশন
বাকি রাতটা স্বাভাবিক ভাবেই কেটে গেল। সকালে ডিউটি শেষ করে তখনও বেরোইনি, তখনই একটা ফোন এল। নম্বর না-চিনলেও গলা শুনেই বুঝলাম সেই বউটির স্বামী। ফোন তুলতেই হাউহাউ করে কেঁদেকেটে যা বললেন ভদ্রলোক, তাতে আমার সব গুলিয়ে গেল। আমি যারপরনাই বিভ্রান্ত।
ইতিমধ্যে মর্নিং শিফটের নীলাদি এসে গিয়েছিল। আমি তাকে দায়িত্বে রেখে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম প্রসূতি বিভাগের দিকে। আর ওখানে গিয়ে যা শুনলাম, তাতে আমি বাক্যহারা।
জানলাম, সেদিন অপারেশন করে বাচ্চাটিকে বাঁচানো গেলেও বউটিকে নাকি বাঁচানো যায়নি। তার পরিচয়ও পাওয়া যায়নি বলে লাশটা মরচুয়ারিতে রাখা হয়েছিল। বউটির স্বামী আসায় মৃতদেহ বের করে আনা হয়েছে। আমি সেই মুখটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। কাল রাতেই তো সে আমার কাছে এসেছিল! কপাল জুড়ে সবুজ টিপটা জ্বলজ্বল করছে। সামনের ছোট করে কাটা চুলগুলো গালের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ঠিক যেমন কাল রাতে ছিল। কে বলবে দু’দিনের বাসি মড়া? মনে হচ্ছে সদ্য ঘুমিয়েছে। এমনই সতেজ।
আরও পড়ুন-পর্তুগাল দলকে ডিনার রোনাল্ডোর
আমি স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি, এও সম্ভব! সন্তানকে বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদেই কি সে আমার কাছে এসেছিল? হয়তো তাই। যতই হোক মা তো। মরে গিয়েও তাই সন্তানকে জড়িয়ে আছে। এড়াতে পারেনি দায়িত্বও।