সন্তানের নিউমোনিয়া রুখবেন মা-ই

পরিসংখ্যান বলছে প্রতি ৫০ সেকেন্ডে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় একটি শিশুর। এই রোগে শিশু-মৃত্যুর হারই সবচেয়ে বেশি। সেই মৃত্যু রুখতে প্রথম প্রয়োজন মায়েদের সচেতনতা। শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধে মায়েদের ভূমিকা কী? কীভাবে তিনি নিজের সন্তানকে সুস্থ এবং সুরক্ষিত রাখবেন সেই বিষয় আলোচনা করলেন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডাঃ অর্পণ চক্রবর্তী। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

নিউমোনিয়া রোগের প্রতিরোধ এবং প্রতিকার নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা যদিও বছরে একটা দিনে সম্ভব নয় তথাপি বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসের একটা গুরুত্ব রয়েছে। ২০১৯-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব জুড়ে এই রোগে শিশু এবং বয়স্ক মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের। যদিও এই রোগের শিশু-মৃত্যুর হারই সবচেয়ে বেশি। বিশেষত নিউমোনিয়া পাঁচবছর বয়সের মধ্যের শিশুদের জন্য লাইফ থ্রেটনিং একটি রোগ। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এবং ইউনিসেফ নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ার জন্য গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানকে একত্রিত করেছে। শিশুকে মাতৃস্তন্যপান এবং পাশাপাশি পরিপূরক আহার প্রদান করলে তবেই এর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব এমনটাই মনে করা হচ্ছে। নিউমোনিয়া একটি জটিল সংক্রমণ যা ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোকে আক্রমণ করে। যে সংক্রমণ ফুসফুস থেকে দ্রুত সারা শরীরে ছড়ায়। নিউমোনিয়া ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক তিনটে সংক্রমণেই হতে পারে। কাজেই এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য যেমন রোগ প্রতিরোধ পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলা এবং চিকিৎসার উন্নতীকরণ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস করা। শিশুদের মধ্যে রোগের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তার পরিবারের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। বিশেষত শিশুটির মায়ের। মায়েরা কীভাবে শিশুর দেখভাল, যত্ন করবেন, কী কী করবেন না, কোন টিকা দেওয়া বিশেষভাবে জরুরি, কী দেখে বুঝবেন আপনার শিশুটির নিউমোনিয়া হয়েছে, কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন জেনে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন-ফের ধর্ষণ করে খুন উন্নাওতে, দলিত ছাত্রীর বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার

নিউমোনিয়া কী
ফুসফুসের লোয়ার রিসেপিরেটরি ট্র্যাক্টে যে সংক্রমণ হয় তাকেই নিউমোনিয়া বলে। নিউমোনিয়াকে আগে আমরা জানতাম ‘অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন’ বা এআরআই বলে জানতাম। এই এআরআই এবং ডায়রিয়া দুটোই ছিল যে কোনও শিশুদের জন্য জীবন হানিকর একটি রোগ। কিন্তু ওআরএসের আবিষ্কারের পর ডায়রিয়া মানুষের করায়ত্ত। ডিহাইড্রেশন সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা হয়ে গেছে। ফলত নিউমোনিয়া হল এখন পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের জন্য লিডিং কজ অফ ডেথ। এটা কিন্তু সারা বিশ্বে। পরিসংখ্যান বলছে পাঁচবছরের নিচে যেসব শিশুর মৃত্যু হয় তার মধ্যে কুড়ি শতাংশ শিশুর নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হয়। এই কুড়ি শতাংশ মৃত্যুহারের মধ্যে তিন চতুর্থাংশ ঘটে এশিয়া এবং আফ্রিকার মতো ডেভেলপিং কান্ট্রিগুলোয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে পাঁচবছরের মধ্যে দুবছরের নিচে শিশু-মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ন’মাস, ছ’মাস, তিনমাস— এই বয়সঃসীমা বিপজ্জনক নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে। এক বছরের নিচে বয়স এমন তিরিশ শতাংশ বাচ্চার নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ তো গেল মর্টালিটি রেট। এরপর যদি কতজন আক্রান্ত হচ্ছে তাদের কথা ধরি তাহলে সেই সব শিশুর মধ্যে দশ শতাংশর জীবন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। চাইল্ডহুড নিউমোনিয়ার জন্য কিন্তু আমরাই অর্থাৎ এই সমাজ দায়ী কারণ এখানে যে পরিসংখ্যান তার চেয়ে অনেকটা কম আমেরিকার মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলোয়। তাহলে প্রশ্ন আসে এর কারণ কী?

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামের প্রতিবাদী মঞ্চে বিরোধী দলনেতাকে ধুয়ে দিল তৃণমূল

শিশুর নিউমোনিয়ার কারণ
লো বার্থ ওয়েট বেবি বা যেসব শিশুর জন্মের সময় ওজন খুব কম থাকে তারা ভীষণ নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়। সেই শিশুর ওজন কম যে কোনও কারণেই হতে পারে, যেমন অপুষ্টি। শিশুর অপুষ্টি হতে পারে বা মায়ের কোনও অপুষ্টিজনিত সমস্যা থাকতে পারে।
কেন অপুষ্টি
এই ৬ মাস ৩ মাস বা ৯ মাস বয়সি শিশুর ম্যাল নারিশমেন্ট বা আন্ডার নিউট্রিশনে ভোগে। সেটা কেন হয়? কেন তাদের এই অপুষ্টি? তার প্রধানত কারণ মায়েদের ব্রেস্ট ফিড না করানো। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং যে শিশু করে তাঁদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম হয়। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং অর্থাৎ জন্মানোর প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিচ্ছু খাবে না। এই ব্রেস্ট মিল্কে শুধু নিউমোনিয়া নয় যে কোনও সংক্রমণ কম হয়। যে শিশু এই সময় পুরো ফিড করে তাদের শরীরে একটা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায় যা সাধারণ জ্বর, ডায়রিয়া, পরিবেশে যেসব কমন ইনফেকশনগুলো সেগুলো প্রতিরোধ করতে পারে।
পরিবেশ
শিশুর নিউমোনিয়ার জন্য পরিবেশের ভূমিকা রয়েছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খুব ঘিঞ্জি বস্তি এলাকায় একই ঘরে দশজন থাকছে সেখানে যেসব শিশু জন্মের পর থাকে তাঁদের সমস্যা হয়। এরা নিউমোনিয়াপ্রবণ হয়।
অপরিচ্ছন্নতা
শিশুর নিউমোনিয়ার অপর কারণ ইনডোর এয়ার পলিউশন। বাড়ির এসিটা পরিষ্কার হয় না, কার্পেটটা নোংরা, বাড়িতে পোষ্য আছে কিন্তু তাকে পরিষ্কার করা হয় না— এর থেকেও সেই বাড়ির শিশুটির নিউমোনিয়া হতে পারে।
টিকাকরণ না হওয়া
পরবর্তী হল ইমিউনাইজেশন বা ভ্যাকসিনেশন বা টিকাকরণ। তালিকা অনুযায়ী তো আর সব ভ্যাকসিন দেওয়া হয় না যে ক’টা দেওয়া হয় তার মধ্যে শিশুর জন্য মিজলস বা হামের টিকা নেওয়াটা খুব জরুরি। যে শিশু এই টিকা কোনও কারণে নেয়নি বা সচেতনতা নেই তাঁদের চাইল্ডহুড নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

আরও পড়ুন-এবার স্ক্রাব টাইফাস আতঙ্কে জলপাইগুড়ি

মা কী করে বুঝবেন
এবার একজন মা কী করে বুঝবেন যে তাঁর শিশুটির নিউমোনিয়া হয়ে গেছে।

প্রথম লক্ষণ হল ধুমজ্বর, কাশি-সর্দি। এটা তো কমন ভাইরাল ফিভারেরও সিম্পটম তাহলে আলাদা কোনটা? এর সঙ্গে দেখা যাবে শিশুটির শ্বাস নেবার যে রেট তার পরিবর্তন হয়েছে। যেমন ধরুন আমরা যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক তাঁরা ১২ থেকে ১৬টা শ্বাস নিই মিনিটে। একটি শিশু তার বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন নাম্বারে শ্বাস নেয়। এক মাসের নিচে যাদের বয়স তারা একটু বেশি শ্বাস নেয় মোটামুটি মিনিটে পঞ্চাশটা। মা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন শিশুটি এর চেয়ে অনেক বেশি শ্বাস নিচ্ছে যেন মনে হচ্ছে হাঁপাচ্ছে এটা হল প্রথম লক্ষণ যে চাইল্ডহুড নিউমোনিয়া হয়েছে। ৬ মাসের শিশু যার চল্লিশটা শ্বাস নেবার কথা সে হয়তো নিচ্ছে বাষট্টিটা শ্বাস। এটার উপর ভিত্তি করেই নব্বই ভাগ নিউমোনিয়া ডায়গনোসিস হয়। যদি এমনটা বোঝেন তাহলে সতর্ক হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যদি বোঝেন বাচ্চা যে শ্বাসটা নিচ্ছে সেটা খুব কষ্ট করে অর্থাৎ স্ট্রাগলিং ব্রিদিং। বুকটা উঠছে কিন্তু বুকের যে শেষপ্রান্ত যেখানে পেট শুরু হচ্ছে অর্থাৎ বুকের ও পেটের সংযোগস্থল পাঁজরের নিচটা ভিতর দিকে ঢুকে ঢুকে যাচ্ছে, একে বলে চেস্ট ইনড্রয়িং। তার মানে ধরে নিতে হবে শিশুর অ্যাবনর্মাল ব্রিদিং হচ্ছে অর্থাৎ তার ফুসফুসের অবস্থা ঠিক নয়, একটা মেজর নিউমোনিয়ার দিকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-সেতু মেরামতিতে তৎপর তৃণমূল সরকার, এবার সাঁতরাগাছি সেতুর মেরামতিতে ছাড়পত্র

তৃতীয়ত, আমরা শ্বাস নিই মূলত ডায়াফ্রাম দিয়ে। আশি শতাংশ কাজ ডায়াফ্রাম করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডায়াফ্রাম ওই শ্বাসবায়ুকে সাপোর্ট করতে পারছে না। অনেক মাসল রয়েছে শরীরে যেগুলো দিয়ে শ্বাস নিতে হচ্ছে। শিশুটি যখন শ্বাস নিচ্ছে তার নাকের পাটার অংশ ফুলে ফুলে উঠছে। একে অ্যালিন্যাজাল ফ্লেয়ারিং বলে। তার মানে নর্মালভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। বড় বড় করে শ্বাস নিতে হচ্ছে।
চতুর্থত, গ্রান্টিং অর্থাৎ টেনে টেনে শ্বাস নেওয়া, হাঁসফাঁস করা। খুব রেস্টলেস বা ভীষণ অস্থির, অশান্ত হয়ে পড়ছে। মায়ের কাছে থাকা সত্ত্বেও একটানা কেঁদে চলেছে, আছাড়ি-পিছাড়ি ভাব, শোয়ালে শুচ্ছে না।
এর সঙ্গে পুওর ফিডিং অর্থাৎ শিশুটির হঠাৎ দুধ বা অন্য খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, বমি করছে— তার সঙ্গে জ্বর আবার ডায়রিয়াও থাকতে পারে। এগুলো হল নিউমোনিয়ার অব্যর্থ লক্ষণ। মাকে যদি বুঝতে হয় আমার বাচ্চার সাধারণ ঠান্ডা লেগেছে, সর্দিগর্মি নাকি নিউমোনিয়া তাহলে এই লক্ষণগুলো খেয়াল করতে হবে।

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে শহিদ তর্পণ মঞ্চে রাতের অন্ধকারে আগুন লাগালো বিজেপির গুন্ডারা

এবার মা কী করবেন
এবার জ্বরটা মাপতে হবে প্রথমেই সেই সঙ্গে দেখতে হবে স্যাচুরেশন কত। কোভিড-পরবর্তীতে স্যাচুরেশন মাপার মেশিন এখন ঘরে ঘরে। যদি কোনও কারণে দেখা গেল স্যাচুরেশন ৯৫-এর কম। তখন বুঝতে হবে লাং-এর উপর প্রভাব পড়ছে। যত স্যাচুরেশন কমবে তত ইনফেকশন ছড়াবে তাই সতর্ক হতে হবে সঙ্গে সঙ্গে।
মা-ই প্রথম বলবে যে তার বাচ্চা ঠিক নেই। কারণ অনেক সময়ই এমনটা হয় যে শিশুকে যখন ডাক্তার দেখানো হয়েছে তখন বা সেদিন পর্যন্ত তার শুধু আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট সংক্রমিত ছিল। বাড়ি ফিরে আসার চব্বিশ ঘণ্টা পর নিউমোনিয়া শুরু হল তাহলে তখন কে জানবে? তখন এই সব সিম্পটমগুলো দেখে মা-নিজেই বুঝবেন যে বিষয়টা সিরিয়াসের দিকে গড়াচ্ছে। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
বেশিরভাগ চাইল্ডহুড নিউমোনিয়ার কারণ হল ভাইরাল। রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস এর জন্য দায়ী। এই ক্ষেত্রে নেবুলাইজেশন, সাপোর্টিভ কিছু ম্যানেজমেন্ট দিয়ে শিশু সুস্থ হয়ে যায়। আর কিছু ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রয়েছে যেমন স্টেপ্টোকক্কাস নিউমনি, হিমোফিলাস ইত্যাদি। এ-ছাড়া ইদানীং এসছে কোভিড নাইনটিন ভাইরাস যা ছোটদের নিউমোনিয়া করতে পারে। এগুলোর জন্য অ্যান্টিবয়োটিই একমাত্র ওষুধ।

আরও পড়ুন-টুইটারের ‘ব্লু টিক’ পরিষেবার জন্য প্রতি মাসে দিতে হবে ৭১৯ টাকা!

নিউমোনিয়া খুব সাঙ্ঘাতিক হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং করাতেই হবে। যাদের কোনও বিশেষ কারণে সম্ভব নয় তাঁদের কথা আলাদা। ভ্যাকসিন শিডিউল ফলো করা। হামের টিকা খুব জরুরি সঙ্গে নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন নিয়ে নিতে হবে। লো-বার্থ ওয়েট হলে তাঁদের আরও বেশি যত্নের প্রয়োজন।
ঘর-বাড়ি পরিষ্কার, সঙ্গে শিশুকে পরিষ্কার রাখা। খুব বেশি লোকজনের মধ্যে না রাখা। শিশুর রিস্ক ফ্যাক্টর সরিয়ে ফেলতে হবে কারণ বাচ্চার সম্পূর্ণ দেখভাল মাকেই করতে হয়। পোষ্যকে আলাদা রাখলে ভাল এবং পরিষ্কার রাখতে হবে। করতে হবে নর্মাল পার্সোনাল হাইজিন মেন্টেন।
বাড়িতে কারও হাম, পক্স বা ঠান্ডা লেগেছে, সর্দি, জ্বর হয়েছে তাঁদের থেকে দূরে রাখতে হবে। গরুর দুধে অনেক শিশুর অ্যালার্জি হয় সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। যে শিশুর খাওয়া শুরু হয়েছে তাদের সুষম আহার করাতে হবে।

Latest article