যে মোয়ায় শীতের ছোঁয়া

নামে জয়নগরের মোয়া, জন্মভূমি বহড়ু। এই মোয়ায় লেগে রয়েছে শীতের ছোঁয়া। স্বাদ-গন্ধ অতুলনীয়৷ বাংলার মিষ্টির ইতিহাসে একটি ঐতিহ্যশালী মাইলস্টোন৷ লাভ করেছে জিআই স্বীকৃতি৷ তবে নানা কারণে এই মোয়া-শিল্পে দেখা দিয়েছে সংকট। পাশে দাঁড়িয়েছে রাজ্য সরকার। মরশুমি মোয়া হয়তো ভবিষ্যতে সারা বছর রসনার তৃপ্তি মেটাবে৷ লিখলেন নাজির হোসেন লস্কর

Must read

উত্তুরে হাওয়া৷ জমিয়ে শীত৷ বাঙালির চর্বচোষ্য খাওয়ার এই তো সময়৷ শাক–সবজি তো রয়েছেই, শীতের সময় নলেন গুড়ের মোয়া যেন প্রথম প্রেমে পড়া সেই মেয়েটি৷ লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট৷ সেই যে দেখা, সেই যে স্বাদ, জন্ম-জন্মান্তরেও ভোলা গেল না৷ জয়নগরের মোয়া বাঙালির যেন সেই মেয়েটি৷ যে একবার মুখে তুলেছে, প্রেমে পড়েছে৷ তারপর বারবার ছুটে যাওয়া৷ এ ‘ছেলের হাতে মোয়া’ নয়, এ আসলি মোয়া৷ না খেলে কিন্তু পস্তাতে হবেই৷

আরও পড়ুন-রসখ্যাপা ও গুড় সেবকের গুড়জালি

অবনী বাড়ি আছ? অবনীকে যে ভঙ্গিতে শক্তি ডেকেছিলেন, সেভাবেই কি জয়নগরের শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বাইরে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলতেন কবি? নাকি মোয়ার গন্ধে আপ্লুত দ্য গোল্ডেন ভয়েস হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শ্যামলের গাওয়া গানের কথায় বলে উঠতেন— এ সুযোগ পাবে না আর, বলো ভাই কী দাম দেবে…৷ আসলে জয়নগরের মোয়া একটা ব্র্যান্ড৷ সেই স্বাদ–গন্ধ কিংবা মখমলে নরম উপস্থাপনা একটা শিল্প৷ আর সেই কারণেই তো জিআই স্বীকৃতি৷ কিন্তু এরও একটা ইতিহাস আছে৷ সেই ইতিহাস কম আকর্ষণীয় নয়৷

আরও পড়ুন-যাত্রা উৎসবের উদ্বোধনে শিক্ষামন্ত্রী

বহড়ু থেকে জয়নগর
মোয়া নামের সঙ্গে জয়নগর জড়িয়ে থাকলেও, জন্মভূমি কিন্তু বহড়ু। এই গ্রামই হল মোয়ার আঁতুড়ঘর। বহড়ুর নাম নিতে হলে আরও কয়েকজনের কথা বলতেই হবে, যাঁরা এই মাটিরই সন্তান, ছোটবেলা কেটেছিল যাঁদের এই গ্রামকে ঘিরে৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নীলরতন সরকার, যতীন্দ্রনাথ সরকার কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়৷ যাঁরা বাঙালির আবেগ আর বহড়ুর কৃতী সন্তান৷ ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থে যে ‘বড়ুক্ষ’-র উল্লেখ আছে, তারই বর্তমান নাম হল বহড়ু। এই গ্রামের জনৈক যামিনী বুড়োই হলেন মোয়ার আবিষ্কর্তা। শোনা যায়, তিনি নিজের জমিতে কনকচূড় ধান ফলান। পরে সেই ধানের খই ও নলেন গুড় দিয়ে মোয়া তৈরি করে কোনও এক অনুষ্ঠানে তা পরিবেশন করেন। এবং কী আশ্চর্য সেই অনুষ্ঠানেই আমন্ত্রিত ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব৷ তাঁরই পাতে পড়েছিল যামিনী বুড়োর মোয়া৷ স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় মোয়া মুখে দিতেই বাজিমাত৷ খোঁজ পড়ল কে সেই ব্যক্তি, যিনি এমন মনোমুগ্ধকর মিষ্টি তৈরি করলেন৷ যামিনী বুড়োর মিঠাই তারপর বাড়ি থেকে বাড়ির অনুষ্ঠানে পথচলা শুরু৷ চাহিদা বাড়তে থাকে। খই-গুড়ের মিষ্টি থেকে নতুন নাম নলেন গুড়ের মোয়া৷ তারপর আরও পরিমার্জন এবং আধুনিকতার ছোঁয়া৷ ১৯২৯। স্বাদে, গন্ধে নতুন আঙ্গিকে মোয়া নিয়ে এলেন মিষ্টি বিশেষজ্ঞ পূর্ণচন্দ্র ঘোষ (বুঁচকিবাবু) ও নিত্যগোপাল সরকার। ব্যবসা বাড়তে থাকায় আর বাড়ি থেকে নয়, এই জুটি বহড়ুতে মিষ্টির দোকান খুলে ফেললেন৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, যে চাহিদার কথা মাথায় রেখে দোকান খুলেছিলেন, ব্যবসা শুরু করে সেখানে ধাক্কা খেল এই জুটি! এরপর সিদ্ধান্ত হল, বহড়ুতে ব্যবসা নয়৷ তৈরি হবে বহড়ুতে, বিক্রি করা হবে জয়নগরের হাটে৷ এই সিদ্ধান্তেই কপাল খুলে গেল ঘোষ-সরকার জুটির৷ বিরাট চাহিদা, দারুণ বিক্রি, বিশাল নাম, জোগান দিতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ার জোগাড়৷ ব্যবসা বেড়েছে, কর্মী বেড়েছে, নাম বেড়েছে৷ মোয়া থেকে বহড়ুর নামটা ধীরে ধীরে মুছে গেল৷ জয়নগরের হাট থেকেই নতুন নামকরণ হয়ে গেল জয়নগরের মোয়া৷ গ্রিন রুমের অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন আবিষ্কর্তা যামিনী বুড়ো আর তাঁর বহড়ু গ্রাম৷

আরও পড়ুন-নলেন গুড় বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের এক সুমধুর পরম্পরা

ম-ম করে এলাকা
হেমন্ত শেষ হতে না হতেই তৈরি হন শিউলিরা (খেজুর রস সংগ্রহকারী)। এইসময় খেজুর গাছের মাথায় দিক কাটা হয়৷ উদ্দেশ্য, রস বের করা৷ এই অবস্থায় কিছুদিন বিশ্রাম৷ শীতের শুরু থেকে রস আসা শুরু খেজুর গাছে। কখনও সকাল, কখনও সন্ধে, রসে ভরা কলসি কিংবা পাত্র কাঁধে মহানন্দে বাড়ি ফেরেন শিউলিরা। সেই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়। সুস্বাদু মোয়া তৈরিতে নলেন গুড়ের সঙ্গে লাগে কনকচূড় ধানের খই৷ মোয়াতে নলেন গুড়, খইয়ের সঙ্গে মেশানো হয় গাওয়া ঘি, এলাচ, পেস্তা, খোয়া ক্ষীর। থাকে কাজু, কিশমিশও। এরপর সব উপাদান একসঙ্গে নিয়ে হাল্কা আগুনে কড়াইয়ে ফেলে মেশানো হয়। উষ্ণ গরম মিশ্রণে ধোঁয়া যখন ম-ম করে তখন খুশবু ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। তারপর কর্মীদের হাতে তৈরি হয় গোল্লা পাকানো মোয়া।
জিআই স্বীকৃতি
জিআই স্বীকৃতি৷ এর অর্থ হল জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা ভৌগোলিক অবস্থান৷ এই স্বীকৃতি আসলে আন্তর্জাতিক বাজারে পেটেন্টের শামিল৷ বিক্রেতাদের তরফ থেকে উদ্যোগ তো ছিলই, কিন্তু রাজ্য সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টার কথা ভুলে গেলে চলবে না৷ বাংলার ঐতিহ্যশালী রসনাতৃপ্তিকারী অন্যতম মিষ্টিটির পেটেন্ট বাংলার ঘরে নিয়ে আসতে বহু লড়াই হয়েছে৷ বহুদিন ধরে৷ যেভাবে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে জিআই পেটেন্ট এসেছে দার্জিলিংয়ের চা, গোবিন্দভোগ ও তুলাইপাঞ্জি চাল, লক্ষ্মণভোগ-হিমসাগর-ফজলি আম, মিহিদানা আর সীতাভোগের৷ নতুন করে আরও ৫টি জিআই স্বত্ব পেতে চলেছে বাংলা৷ সুন্দরবনের মধু থেকে শুরু করে গরদ, করিয়াল, টাঙ্গাইল শাড়ি ও জলপাইগুড়ির সুগন্ধী চাল কালোনুনিয়া৷

আরও পড়ুন-কথা হল কবিতায়

কীভাবে স্বীকৃতি
জন্মভূমি বহড়ু হলেও প্রাচীন শহর জয়নগরের নাম ছিনিয়ে নেওয়া মোয়ার জিআই পেটেন্টে পেতে জনৈক অশোক কয়াল হাজির হন জয়নগরের সাংসদ প্রতিমা মণ্ডলের কাছে। সেটা ২০১৪৷ আলোচনার পর প্রতিমা মণ্ডলের তৎপরতায় ২০১৫-র মার্চে মেলে জিআই ট্যাগ। অশোক কয়ালকে সামনে রেখে ‘জয়নগর মোয়া নির্মাণকারী সংস্থা’ নামে ভৌগোলিক অবস্থানের তকমা এল জয়নগরের মোয়ার। কিন্তু তারপরই জটিলতা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা পরিষদ সদস্য খান জিয়াউল হক বলছেন, এরপর শুরু হয় রাজনীতি৷ অশোক কয়াল জিআই পেটেন্ট কুক্ষিগত করে রাখার জন্য জানিয়ে দেন, তাঁর তৈরি সংস্থার সদস্য না হলে প্রস্তুতকারকরা পেটেন্ট ব্যবহার করতে পারবেন না৷ বিষয়টি সাংসদকে জানানো হয়৷ সাংসদ বিষয়টি সরকারের শীর্ষ স্থানীয় আমলা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে যান৷ সিদ্ধান্ত হয় একটি কমিটি তৈরি হবে৷ যে কমিটি পরবর্তীকালে মোয়া ব্যবসায়ীদের আলাদা আলাদা জিআই স্বীকৃতির শংসাপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। তারপরই আজ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সদস্য পেয়েছেন শংসাপত্র।

আরও পড়ুন-ইনসাফ চাইছেন! বরং মুখ ঢাকুন লজ্জায়

পথ ভুলছে নয়া প্রজন্ম
মোয়া সিজনাল৷ শীতের মরশুমে ব্যবসায়ীদের মুখে বাড়তি হাসি ফুটলেও শীত ফুরলেই বিপাকে পড়েন শিউলিরা৷ খেজুর গাছের রস শুকোতেই তাঁদের অন্নের জন্য খুঁজতে হয় অন্য আয়ের উৎস৷ ফলে শুধু এই মরশুমি মিষ্টিকে আয়ের প্রধান উৎস করার অসুবিধা৷ যে কারণে শিউলিদের পরবর্তী প্রজন্ম খুব একটা উৎসাহ দেখান না এই পথকে৷ গুটিকয়েক শিউলি এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন এই প্রাচীন শিল্পকে৷ ব্যবসায়ী রাজেশ কুমার সেই প্রসঙ্গ টেনেই বললেন, ওঁদের জন্য কিছু সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন৷ কমপক্ষে বার্ধক্যভাতাটা ঠিকঠাক পাচ্ছেন কি না সে বিষয়ে যদি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা করা যায় তাহলেও ওঁরা বেঁচে থাকার রসদ পান৷
সমস্যা, পাশে রাজ্য
তৈরির পর জয়নগরের মোয়ার মেয়াদ মেরে কেটে দিন সাতেক৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে মোয়া সংরক্ষণ করার পরিকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন৷ যদি পরিকাঠামো তৈরি হয়, তাহলে মোয়া ব্যবসা আরও বিস্তার লাভ করবে৷ এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি এখন ব্যবসায়ীদের কাছে মূল বিষয়৷ রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্টই সহানুভূতিশীল৷ সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি জানানোর পর সিদ্ধান্ত হয় জয়নগরে হবে মোয়া হাব৷ এর জন্য জমি চিহ্নিতকরণ হবে৷ এর জন্য প্রায় ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে৷ দ্রুত কাজ শুরু হবে মোয়া হাবের৷ আশা করা হচ্ছে দ্রুত কাজ শুরু হবে৷ মরশুমি জয়নগরের মোয়া তখন হয়তো সারা বছর ধরেই বাংলা থেকে বাংলার বাইরের মানুষের রসনার তৃপ্তি মেটাবে৷

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বেই এগোবে দেশ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে পাল্টা ব্রাত্য-চন্দ্রিমার

সংরক্ষণ যেমন একটি সমস্যা, তেমনি আরেকটি গুরুতর সমস্যা হল কনকচূড় ধানের চাষ কমছে৷ এই দিকটিতেও নজর রয়েছে রাজ্য সরকারের৷ প্রাথমিকভাবে এই মেটাতে রাজ্য আত্মা প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০ জন কৃষককে কনকচূড় ধানের বীজ বিনামূল্যে দিয়েছে৷ সবমিলিয়ে ৫০০ কেজি বীজধান দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জয়নগর ১ ব্লকের কৃষিকর্তা মহাদেব বাড়ুই৷ ইতিমধ্যে যার দরুন কনকচূড় ধান চাষের অনেকটাই মিটেছে৷ সময় গেলে আরও স্বাভাবিক হবে৷ এর পাশাপাশি নকল ধান এবং নকল নলেন গুড়ের মোয়া বাজারে ব্যাপকভাবে রয়েছে৷ তবে মিষ্টিপ্রেমী তাঁরা অবশ্য দাঁতে কাটলেই বুঝতে পারেন আসল-নকলের ফারাকটা৷ কিন্তু সারা বছর জয়নগরের মোয়া পাওয়া যায় তাহলে নকলনবিশরা যে ক্রমশ ক্ষীণকায় হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য৷
জয়নগরের মোয়া বাংলার প্রসিদ্ধ মিষ্টির ইতিহাসে একটি ঐতিহ্যশালী মাইলস্টোন৷ রসগোল্লা, সন্দেশ, কিংবা চমচম— এইসব মিষ্টির পাশাপাশি জয়নগরের মোয়া কিন্তু রাজার মতোই বাঙালির ঘরে জনপ্রিয়৷ কিন্তু বাঙালি যেন ভুলে না যান বহড়ুর যামিনী বুড়োর কথা৷

Latest article