উত্তাল জনসভা। গর্জে উঠলেন তিনি, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বক্তৃতা নয়, আগুন ঝরালেন। উচ্চারণ করলেন জনসাধারণের মনের কথা। তাঁর স্বর ধ্বনিত হল আকাশে বাতাসে। উঠল তুমুল ঢেউ। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা জীবন্ত চরিত্র। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। জাতির জনক। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ (Mujib: The Making of a Nation)। দৃশ্যটি সেই ছবির। রোমাঞ্চিত করল। মুগ্ধ করল। বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে আগেই। ১৩ অক্টোবর। ভারতে মুক্তি পেল ২৭ অক্টোবর। মুজিব কলকাতায় ছিলেন একটা সময়। নানা কারণে তাঁর প্রতি আমাদের মনে গভীর শ্রদ্ধা। তাই তাঁর বায়োপিক তৈরি হয়েছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায়। শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায়। পূর্ববঙ্গের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মানো তরুণ ছাত্রনেতা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার যাত্রাপথ ছবিতে ধাপে ধাপে তুলে ধরা হয়েছে। দেখানো হয়েছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। প্রায় তিন বছর ধরে হয়েছে শ্যুটিং। ছবির সময়সীমা দু ঘণ্টা ৫৯ মিনিট। মুজিববর্ষ উপলক্ষে তৈরি। খরচ ৮৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ মোট অর্থের ৫০ কোটি দিয়েছে। ভারত ৩৩ কোটি।
মুজিবের ভূমিকায়
নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। তিনি বাংলাদেশের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য অভিনেতা। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। প্রায় পাঁচ দফার অডিশনের পর মুজিবের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। কাজের মধ্যে রয়েছে ভাবনাচিন্তা এবং পরিশ্রমের ছাপ। বঙ্গবন্ধুর প্রচুর ভিডিয়ো ফুটেজ দেখা, বই পড়া এবং ওয়ার্কশপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের জাতির জনক মুজিবুর রহমানের (Mujib: The Making of a Nation) চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য। শ্যুটিং শুরুর আগে অনেকেই বলেছিলেন, ভুল কাস্টিং। এখন তাঁরাই আমার প্রশংসা করছেন। কাল্পনিক চরিত্রে আলাদা চ্যালেঞ্জ থাকে। কিন্তু এটা রক্তমাংসের মানুষের চরিত্র, তার উপর চরিত্রটা জাতির জনকের, যিনি দুই বাংলার চোখে লেগে আছেন। সেটা ফুটিয়ে তোলা খুব সহজ ছিল না।’
গায়ে কাঁটা
আরিফিন শুভ শুরু করেছিলেন ৮৪ কেজি ওজনে। বঙ্গবন্ধুর যত বয়স বাড়ে, অভিনেতারও তত ওজন বাড়ে। শেষ করেছিলেন ৯৯ কেজিতে। তার উপর প্রস্থেটিক। দেড় থেকে তিন কেজির পেট লাগানো হত। প্রতিটি দৃশ্য পরিচালক এক টেকেই শ্যুট করেছেন। তার জন্যও ছিল জোর প্রস্তুতি। আরিফিন শুভ উতরে গেছেন সসম্মানে। পরিশ্রমের ফল পাচ্ছেন হাতেনাতে। প্রশংসিত হচ্ছেন। যাঁরা বইয়ের পাতায় বা বিভিন্ন ভিডিয়ো ফুটেজে মুজিবুর রহমানের ছবি দেখেছেন, তাঁদের মনে হতেই পারে, স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই যেন দাঁড়িয়ে। সিনেমায় মুজিব (Mujib: The Making of a Nation) যখন বলেন, ‘বাংলা আমাদের মাতৃভাষা নয়, বাংলা আমাদের মা’, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় মধ্যিখানের কাঁটাতারের বেড়া। উপলব্ধি করি ভাষার সূত্রে আমরা এক। এতটাই নিখুঁত অভিনয়।
আরও পড়ুন- ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি পুরস্কার জিতলেন বাঙালি লেখিকা
অন্যান্য চরিত্রে
মুজিবুরের স্ত্রী বেগম ফাজিলাতুন্নেসার ভূমিকায় নুসরাত ইমরোজ তিশার অভিনয় মনে রাখার মতো। নুসরত ফারিয়া অভিনয় করেছেন শেখ হাসিনা চরিত্রে। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী মুগ্ধ করেছেন। পাশাপাশি এ কে ফজলুল হক চরিত্রে শহিদুল আলম সাচ্চু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চরিত্রে দীপক আন্তানি, খন্দকার মোশতাক আহমেদ চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, জুলফিকার আলি ভুট্টো চরিত্রে রজিত কাপুর, পাকিস্তানি সেনা অফিসারের চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদ দর্শকমনে রেখাপাত করেছেন।
প্রশংসনীয় কাজ
সুরারোপ করেছেন শান্তনু মৈত্র। বাংলার আবেগ অনেকটাই বেঁধে রেখেছে গান। গ্রামবাংলায় মুসলিম বিয়ের গানের ব্যবহার ছবিটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। চিত্রনাট্য লিখেছেন শমা জইদি, অতুল তিওয়ারি। ক্যামেরায় আকাশদীপ পাণ্ডে। শিল্প নির্দেশক নীতীশ রায়। পিয়া বেনেগল ছিলেন পোশাক পরিচালনার দায়িত্বে। দয়াল নিহালনি সহকারী পরিচালক। নির্বাহী প্রযোজক নুজহাত ইয়াসমিন। লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ হোসেন জেমি। সংলাপ লেখক, তত্ত্বাবধায়ক সাধনা আহমেদ। কাস্টিং পরিচালক শ্যাম রাওয়াত ও বাহারউদ্দিন খেলন। প্রত্যেকেই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে
বায়োপিকে তথ্য নির্ভুল রেখে পরিচিত গল্পকে উপস্থাপন করতে হয়। এমনভাবে, যাতে শেষ পর্যন্ত দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা যায়। এটা মস্তবড় চ্যালেঞ্জ। সেই কাজে অনেকটাই সফল চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক। গল্পের মধ্যে একটা গতি রেখে আন্তরিকভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপাখ্যান তাঁরা তুলে ধরেছেন। তবে সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন বলা যায় না। অসঙ্গতি আছে। সেটা সামান্যই। গল্প বুনতে গিয়ে কিছু কিছু কাল্পনিক মুহূর্ত রচনা করা হয়েছে। যদিও সেগুলো খুব একটা দোষের নয়। বহু আগেই কিংবদন্তি পর্যায়ে চলে গেছেন শ্যাম বেনেগাল। তাঁর সাফল্যের মুকুটে যোগ হল নতুন পালক। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে ছবিটি অবশ্যই দেখতে হবে।