বাংলায় শীত আসবে অথচ বাতাসে ভাসবে না নলেন গুড়ের মৌতাত তাই আবার হয় নাকি! বস্তুত, বঙ্গজীবনে শীতের আবেশের সঙ্গে যেন মিশে থাকে নলেন গুড়ের সুঘ্রাণ। নিছক এক ধরনের প্রাকৃতিক মিষ্টি বা মিষ্টির নানারকম পদ তৈরির উপকরণ নয়, নলেন গুড় বা খেজুর গুড়ের ভুবনমোহিনী স্বাদ আর গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির অনেকটা আবেগও যা খাদ্যরসিক বাঙালি-হৃদয়কে মথিত করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। নলেন গুড়ের চিরাচরিত পায়েস, পিঠে, রসগোল্লা, সন্দেশ থেকে শুরু করে আজকে নলেন গুড়ের দই, কেক এমনকী আইসক্রিম… ডেজার্টের নানা পদে নলেন গুড়ের জাদুকরী স্বাদ-গন্ধে মজেছে গোটা দুনিয়া…কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! বিশেষজ্ঞেরা উচ্ছসিত এর পুষ্টিগুণ নিয়েও। অবশ্য নানা কারণে, চাহিদামতো খাঁটি নলেন গুড় পাওয়াটা আজ যথেষ্ট দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন-যাত্রা উৎসবের উদ্বোধনে শিক্ষামন্ত্রী
কিন্তু বাংলায় কবে শুরু হয়েছিল নলেন গুড়ের জয়যাত্রা? নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে প্রায় ৮০০ বছর আগেকার ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থে, নলেন গুড়ের স্তুতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়, তাঁর গ্রন্থ, বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব-এর পাতায়। বহু শতাব্দী আগেই নাকি পৃথিবীর নানা দেশ, বাংলার নলেন গুড়ের স্বাদ পেয়েছিল ভারতীয় নাবিকদের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে এর স্বাদে মোহিত পর্তুগিজ নাবিকরা নলেন গুড়ের খ্যাতিকে বিশ্বের দরবারে আরও ছড়িয়ে দেয়। এমনটাই জানা যাচ্ছে ‘বিশ্ব বাংলা’ সূত্রে। তবে নলেন গুড়ের প্রধান উপকরণ খেজুর রসের প্রচলন যে খ্রিস্ট জন্মের বহু আগেই হয়েছিল তা প্রায় ২০০০ বছর আগে উল্লেখ করেছিলেন বিখ্যাত রোমান ঐতিহাসিক প্লিনিয়াস। জানা যাচ্ছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রতিবেদন থেকে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যাচ্ছে যে মধ্য প্রাচ্য অঞ্চলে অন্তত ৬০০০ বছর আগে খেজুরের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল।
আরও পড়ুন-রসখ্যাপা ও গুড় সেবকের গুড়জালি
যাই হোক, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে খাদ্য, পানীয় ইত্যাদি নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে খেজুর। তবে খেজুর গুড় বা নলেন গুড়ের উৎপত্তি একসময় ভারতীয় উপমহাদেশেই যে হয়েছিল তা জানা যাচ্ছে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সূত্রে। মজার বিষয়, মধ্য প্রাচ্যের শুষ্ক মরু প্রান্তরে, খেজুর গাছে ফলের উৎপাদনই প্রধান আর ভারতীয় উপমহাদেশের তুলনামূলক সরস, সবুজ প্রান্তরে, খেজুর গাছে রসের উৎপাদনই কিন্তু প্রধান! কে জানে, এখানে প্রচুর পরিমাণে সুমিষ্ট প্রাকৃতিক রসকে নষ্ট হতে না দিয়ে সংরক্ষণের তাগিদেই অতীতে কোনও সময় খেজুর রস থেকে নলেন গুড়ের সৃষ্টি হয়েছিল কি না! প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে দীর্ঘ ৩০০০ বছরের বেশি সময় ধরে আয়ুর্বেদিক ওষুধে গুড়ের ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে আয়ুর্বেদে শুধুমাত্র আখের গুড়েরই কিন্তু উল্লেখ রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক আয়ুর্বেদিক প্রকাশনা, ‘আয়ুর পাব ডট কম’ থেকে। আবার, বিখ্যাত রন্ধনসম্পর্কীয় ইতিহাসবিদ মাইকেল ক্রন্ডল, তাঁর ‘সুইট ইনভেনশন: এ হিস্ট্রি অফ ডেজা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে বাংলায় সম্ভবত আখের চিনির আগে খেজুর গুড়ের প্রচলন হয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, সংস্কৃত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ অনুসারে, এই অঞ্চলে দানাদার আখের চিনির ব্যবহার নাকি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেও ছিল। সুতরাং, এই সমস্ত তথ্য থেকে একটা বিষয় অন্তত অনুমান করা যাচ্ছে যে বাংলার নলেন গুড় কত প্রাচীন, কত ঐতিহ্যবাহী!
আরও পড়ুন-চলতি বছরে সবুজসাথী প্রকল্পে বাড়ছে আরও ৩ লক্ষ, ১৫ লক্ষ সাইকেল দেবে রাজ্য
তবে প্রাচীন আয়ুর্বেদে নলেন গুড়ের উল্লেখ না থাকলেও এর অনেকগুলি স্বাস্থ্যগুণের কথা কিন্তু জানা গেছে। ‘ইলেক্ট্রনিক জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল, এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ফুড কেমিস্ট্রি’-তে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন সি-তে সমৃদ্ধ খেজুর রস অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই রস থেকে তৈরি নলেন গুড়, আয়রন, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক-সহ নানা স্বাস্থ্য সহায়ক উপাদানে ভরপুর। রক্তাল্পতা, সর্দিকাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যায় যথেষ্ট ফলপ্রদ। এছাড়া এটি বজায় রাখে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য, বাড়ায় এনার্জি ও হজম ক্ষমতা, শক্তপোক্ত করে হাড়, ভাল রাখে লিভার আর কমায় মাইগ্রেন ও ঋতুকালীন কিছু সমস্যা। সার্বিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নাকি বাড়ায় নলেন গুড়। আবার কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (৪১) থাকায় চিনি বা আখের গুড়ের তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যকর। তবে স্বাদে, গন্ধে, রূপে, গুণে যতই লা জবাব হোক না কেন, স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ীই অবশ্য এই গুড় খাওয়া উচিত।
আরও পড়ুন-আজ ইনসাফ চাইছে নেতাই
কিন্তু কেন এর নাম ‘নলেন গুড়’ হল? কেউ বলেন ব্রজবুলি শব্দ ‘নওল’ বা ‘নতুন’ থেকে ‘নলেন’ শব্দটির উৎপত্তি। কেউ বলেন এর উৎপত্তি দ্রাবিড়িয় শব্দ ‘নরকু’ থেকে যার আক্ষরিক অর্থ কাটা। আবার খেজুর গাছের গায়ে মূলত‘নল’ কেটে গুড় সংগৃহীত হয় তাই তার থেকেও‘নলেন’ শব্দটি আসতে পারে বলে অনেকের অনুমান। যাই হোক, কীভাবে তৈরি হয় এই নলেন গুড়? শীতের উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করলে ‘শিউলি’-রা শুরু করে খেজুর গাছের মাথা সাফ করার কাজ। পুরনো মরা, আধমরা পাতা কেটে তার নিচের অংশটি পরিষ্কার করা হয়। এই জায়গাটি এবার ধারালো অস্ত্র দিয়ে চেঁচে কাণ্ডের সাদা অংশটি বার করে সেখানে লম্বালম্বি চেরা একটি কঞ্চি তেরছাভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রস আসতে শুরু করলে তা ফোঁটা ফোঁটা আকারে পড়তে থাকে কঞ্চির নিচে বাঁধা হাঁড়িতে। একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে ৫-৬ লিটার রস পাওয়া যায়। তিন থেকে চারদিন এভাবে রস সংগ্রহের পর গাছকে দিন তিনেক বিশ্রাম দেওয়া হয়। তারপর আবার একবার চেঁচে, ময়লা পরিষ্কার করে কঞ্চি ঢুকিয়ে একই ভাবে রস সংগ্রহ করা হয়। তবে গাছের বিশ্রাম বা জিরোনোর পর এইভাবে সংগৃহীত রসকে জিরেন কাটের রস বলে। এই উৎকৃষ্ট রসের মিষ্টত্বও বেশি হয়। যাই হোক, খেজুর গাছ থেকে সংগৃহীত রসকে প্রথমে ছেঁকে নেওয়া হয়। এরপর বড় মাটি বা টিনের পাত্রে রসকে ফোটানো বা জ্বাল দেওয়া হয়। এইসময় একটানা রসের মধ্যে নেড়ে যেতে হয়।
আরও পড়ুন-আজ ভুবনেশ্বর-যাত্রা ক্লেটনদের, কুয়াদ্রাতকে ছাড়াই প্রস্তুতি ইস্টবেঙ্গলের
সাধারণত নারকেলমালার অর্ধেক অংশে লম্বা কাঠ লাগানো এক বিশেষ ধরনের হাতার সাহায্যে এই কাজ করা হয়। এইভাবে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণত তৈরি হয়ে যায় প্রাণকাড়া গন্ধে ম ম করা, গাঢ় বাদামি রঙের খাঁটি নলেন গুড়। গোটা পরিবার অংশ নেয় গুড় তৈরির কাজে। তবে তৈরি প্রক্রিয়ার তফাতভেদে নলেন গুড়ের নানারকম প্রকারভেদ হয়। যেমন, ‘ঝোলা’ বা তরল গুড়, ‘দানা’ গুড়, ‘পাটালি’ বা চাকতির আকারে জমাট বাঁধা গুড় এবং‘হাজারি’ বা শক্ত, সাদা রঙের গুড় যা এখন মূলত বাংলাদেশে তৈরি হয়। একটি খেজুর গাছ থেকে গড়ে প্রতি মরশুমে প্রায় ৪০ কেজি নলেন গুড় পাওয়া যায়।
অনুকূল পরিবেশে একসময় অবিভক্ত বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের নানা অঞ্চলে এবং বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দুই ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, বর্ধমান, হাওড়া, নদিয়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মালদা ইত্যাদি জেলাগুলিতে প্রচুর সংখ্যায় খেজুর গাছ দেখা যেত এবং অনেক গ্রামে বংশপরম্পরায় তৈরি হত যথেষ্ট পরিমাণ নলেন গুড়। দুঃখের বিষয়, দিন দিন নানা কারণে গাছের সংখ্যা কমে গিয়ে রসের জোগানে ঘাটতি আসছে। এছাড়া গাছ কাটা থেকে শুরু করে গুড় তৈরির কুশলী কারিগরদের সংখ্যা কমে যাওয়া, মাত্র ৩ মাসের সীমাবদ্ধ কর্মকাণ্ড ও ব্যবসার অনিশ্চয়তার জন্য নতুন প্রজন্মের এই পেশার প্রতি অনাগ্রহ, খেজুর রস উৎপাদনের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, পরিবর্ত রাসায়নিকের ব্যবহার ইত্যাদি নলেন গুড়ের উৎপাদন ও সুনামের সামনে বড় প্রশ্নচিহ্ন খাড়া করে দিচ্ছে। খেজুর গাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রসের জন্য প্রায় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। সাম্প্রতিক কম ঠান্ডা এবং ঠান্ডার অস্থির ভাব, রসের পরিমাণ এবং গুণমান উভয়কেই কিন্তু প্রভাবিত করছে।‘ডাউন টু আর্থ’ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশক বা তারও বেশি সময়ে খেজুর রসের নিঃসরণ নাকি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে! খাঁটি নলেন গুড় ক্রমশ দুর্লভ হয়ে পড়ছে অথচ দেশে-বিদেশে নলেন গুড়ের জনপ্রিয়তার কোনও ঘাটতি নেই। চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে কিন্তু জোগান নিম্নমুখী। বাংলার ঐতিহ্যবাহী, বিশ্বখ্যাত নলেন গুড়ের এই সংকট সময়ে এগিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে নদিয়ার মাজদিয়া ভাজন ঘাটে তৈরি হয়েছে ল্যাবরেটরি সহ নলেন গুড় উৎপাদনের আধুনিক কারখানা। এতে করে একদিকে চাষিরা যেমন খেজুর রসের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন, হচ্ছে কর্মসংস্থান, অন্যদিকে উৎকর্ষের সমস্ত মান পূরণ করে উৎপাদিত হচ্ছে চেটেপুটে খাবার মতো সেই খাঁটি নলেন গুড়। শুধু তাই নয়, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে এই প্রথমবার প্লাস্টিকের টিউবে করে নলেন গুড় দেশে-বিদেশে বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা এককথায় অভিনব। পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামোদ্যোগ বোর্ড, বিশ্ব বাংলা ইত্যাদি সংস্থা বিভিন্ন বিপণীর মাধ্যমে এমনকী অনলাইনে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বাংলার এই অনন্য ডেলিকেসিকে। পাশাপাশি নলেন গুড়ে ভেজাল রুখতে চলছে নিয়মিত প্রশাসনিক নজরদারিও।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
আশা করা যায়, রাজ্য সরকারের এইরকম সব সময়োচিত পদক্ষেপ, খেজুর রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে নলেন গুড়ের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাকে, আগামী দিনে আরও উন্নত ও যুগোপযোগী করে তুলবে। অবশ্য, বাংলার নলেন গুড়ের অতীত গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে মানুষের সচেতনতা ও সহযোগিতার বিষয়টিও কিন্তু সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।