প্রাণজয় মাল
দা, মুড়ি হবে?’
গরম গোল তাওয়ার উপর অভ্যস্ত হাতে অদ্ভুত দ্রুততায় একসঙ্গে অনেকগুলো পরোটা ভাজতে-ভাজতে লোকটা বলল, ‘মুড়ি নেই। পরোটা আছে, দেব?’
পেটে কিছু দিতেই হবে। খালি পেটে এতটা বাস জার্নি সম্ভব নয়। কিন্তু এই সকালবেলায় তেলে-ভাজা পরোটা আমার মতো পেটরোগা মানুষের সহ্য হবে না।
‘পরোটা ছাড়া আর কী আছে?’
লোকাটা একপলক আমার মুখের দিকে তকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে-করতে একইরকম নির্লিপ্ত গলায়, ‘একটু বসলে চাউমিন বানিয়ে দেব।’
ওরে বাব্বা, এই সাতসকালে চাউমিন!
আরও পড়ুন-নতুন বইয়ের গন্ধ
আশেপাশে আর কোনও দোকান খোলা নেই। সব ঝাঁপ নামানো। এখনও বর্ধমান শহরের পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। অগত্যা একপ্রকার বাধ্য হয়েই, ‘পরোটা কত করে?’
‘কুড়ি টাকা প্লেট। তিনটে পরোটা। তরকারি। সস।’
‘আমি দুটো নেব…।’
‘তিনটেই নিন, খারাপ লাগবে না।’
বুঝলাম, লোকটা কুড়ির নিচে নামবে না। আমাকে তিনটেই নিতে হবে। মনে-মনে অসন্তুষ্ট হলেও এখন আমি নিরুপায়।
কিছুটা কিন্তু-কিন্তু মন নিয়েই পাতলা রুমালের মতো পরোটাতে কামড় দিলাম। খুব যে খারাপ, তা নয়। আসলে এই ধরনের স্ট্রিট-ফুডগুলো জিভের জন্য ভাল হলেও পেটের জন্য নয়।
আরও পড়ুন-বাংলা ভাগ! তালাবন্ধ করে রাখুন
গতকাল এক লেখক বন্ধুর আমন্ত্রণে সাহিত্য সভাতে এসে ফেঁসে গেলাম! আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া, বই প্রকাশ, কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে হইহই করে ভালই হল অনুষ্ঠান। একঘেয়ে গতানুগতিক জীবন থেকে একবেলার মুক্তি। গ্রীষ্মের গুমোট দুপুরে একপশলা ঠান্ডা কালবৈশাখীর মতো। ভেবেছিলাম এই ঠান্ডা গায়ে মেখে সভা শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়ব। অনেকটা রাস্তা ফিরতে হবে। কিন্তু একটি ফোন সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল। বিকেলের দিকে আমার পিতৃদেব ফোন করে বললেন, ‘তুই কি বেরিয়ে পড়েছিস?’
‘না, এবার বেরোবো। কেন বলতো?’
‘আর বলিস না, আরামবাগে বিরাট ঝামেলা হচ্ছে। পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। সব বাস-চলাচল বন্ধ!’
‘কেন! কী হয়েছে?’
‘ওই যা হয়, শাসক-বিরোধী তরজা। সেখান থেকে মারপিট-পথ অবরোধ…।’
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘নিউজ চ্যানেলে দেখাচ্ছে তো…।’
আরও পড়ুন-বিস্ফোরক অমর্ত্য, কেন্দ্রের নীতি অপছন্দ, তাই শুরু হয়রানি
‘হুম…কী করি বল তো?’
‘তোকে আজ আর আসতে হবে না। ওখানে কোনও একটা লজে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে আয়। এখন বেরোলেও বাড়ি ফিরতে পারবি না। আরামবাগে কোথাও থাকতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আরামবাগে থাকার চেয়ে বর্ধমানে থাকা ভাল।’
মানুষের জীবনে মুহূর্তগুলো ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণিকের মধ্যে আনন্দ, বিষাদে পাল্টে যায়। সুখ, দুঃখের রূপ নেয়। হাসি কান্নার আড়ালে মুখ লুকায়। আসলে হাসি-কান্না, আনন্দ-দুঃখ, ভাল-মন্দ পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে। কখন যে হাত পাল্টে যায়, বোঝা দায়। ঘরের বদলে হোটেলের বিছানাতে মাথা রাখতে হয়। সাদামাঠা একটেরে একটা রুমের জন্য পকেট থেকে খসে যায় ছশো। তারপর সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, এই মুড়ি-পরোটার মধ্যে ফেঁসে যেতে হয়। জীবন বড্ড…
আরও পড়ুন-২০ মার্চ দিল্লিতে ফের কৃষক আন্দোলন
‘আর দেব দাদা?’
কথাটা কানে আসতেই দেখি, পরোটাওলা আমার হাতে ধরা শূন্য প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। কখন যে পরোটা তিনটে গলা দিয়ে দিয়ে নেমে গেছে বুঝতেই পারিনি!
‘না-না, আর লাগবে না।’
‘কেমন লাগল?’
‘ভাল।’
‘বলেছিলাম ভাল লাগবে। আপনি শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছিলেন!’
লোকটার মুখের দিকে ভাল করে তাকাতেই প্রসন্ন মনে আবার বলল, ‘আমরা জানি আজকাল কাস্টমাররা তেল-মশলা দেওয়া খাবার একদম পছন্দ করে না। সবাই পেটের ব্যাপারে সিরিয়াস। … আমার দোকানে খেয়ে আপনার পেট খারাপ করলে আর কি আসবেন? তাই যতটুকু তেল-মশলা না দিলেই নয় ততটুকুই দিই।’
নিজের ঢাক পেটাবার সুযোগ পেলে রথীমহারথীরা ছাড়ে না। এ তো সাধারণ পরোটাওলা! কথা না বাড়িয়ে কুড়ি টাকার নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠব-উঠব করেছি, এমন সময়, ‘আপনি থাকেন কোথায়? আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না!’
‘দেখার কথা নয়। একটা কাজে এসেছিলাম। আজই ফিরব।’
আরও পড়ুন-মৃত্যু বেড়ে ২৫ হাজার, ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার ১০ দিনের শিশু
‘বাড়ি?’
অতিরিক্ত কৌতূহল দেখে মনে-মনে বিরক্ত হয়ে সংক্ষেপে বললাম, ‘মেদিনীপুর।’
আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়েই উঠে পড়লাম এক ফাঁকা টোটোতে। টোটো চলেছে বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। শহর বর্ধমানের ঘুম ভাঙছে আস্তে-আস্তে। রাস্তায় লোক-চলাচল বাড়ছে। বড়-বড় বিল্ডিংয়ের ফাঁকফোকর দিয়ে কাঁচা সোনার মতো আলো এসে লুটিয়ে পড়েছে চকচকে রাজপথের বুকে। চা-দোকানের আশেপাশে ভিড় জমেছে পথচলতি মানুষের। দু-একটা নাম না জানা পাখি ইলেকট্রিক তারের উপর দোল খাচ্ছে নির্দ্বিধায়। ভোরের ঠান্ডা ভাব এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। সেই পরশ শুষে নিচ্ছিল গত কয়েক ঘণ্টার টুকরো-টাকরা গ্লানি।
বেশকিছুটা আসার পর এক তন্বী উঠে বসল আমার বিপরীতে। টাইট জিন্স। উপরে টপ। পাকা গমের মতো রং। সকালের নিষ্পাপ ডাগর চোখে চোখ রেখে মন যখন অজানা উপত্যকায় ভেসে যেতে চাইছে, ঠিক তখনই আমার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল! মেয়েটির কোলের উপর শৌখিন হাত-ব্যাগটাতে চোখ পড়ল। তখন আমার পাশে রাখা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখি, সেটি নেই!
আরও পড়ুন-রাজভবনে সুকান্ত ক্ষমা চাইতেই গিয়েছিলেন
আমার হার্ট-বিট লাফিয়ে দ্বিগুণ। ব্যাগ গেল কোথায়? এই তো পাশেই রেখেছিলাম। নিশ্চয়ই টোটো থেকে পড়ে গেছে? কিন্তু কোথায় পড়ল? পড়ার কথা নয়! অন্য কেউ কি নিয়ে নেমে গেল? না, ফাঁকা টোটোতে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। নানা প্রশ্ন আছড়ে পড়তে থাকল মনের অশান্ত উপত্যকায়। শান্ত সকালের ঠান্ডা হাওয়াতেও ঘেমে উঠল আমার শরীর।
টোটোওলাকে বলাতে সে বলল, ‘কী যে করেন দাদা! আপনার পাশ থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল, বুঝতে পারলেন না!’
‘বোধহয় রাস্তাতেই পড়েছে।’
আরও পড়ুন-সামনে চেন্নাইয়িন, জয়ে ফিরতে চান ক্লেটনরা
টোটো থামিয়ে টোটোওলার হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়ে ছুটতে-ছুটতে ফিরছি, রাস্তার দু’পাশে তীক্ষ্ণ নজর রেখে। লোক-চলাচল অনেক বেড়ে গেছে। আর কি পাব ব্যাগটা? এতক্ষণ পর্যন্ত কি রাস্তায় পড়ে থাকবে? নিশ্চয় কেউ না কেউ কুড়িয়ে নিয়েছে।
ওই ব্যাগের মধ্যেই আমার সবকিছু; বেশকিছু টাকা, একটা নিকন ক্যামেরা, কালকের সভা থেকে পাওয়া পত্রিকা-বই, ভোটার কার্ড, একসেট জামাকাপড় ও আরও টুকিটাকি এটা-ওটা। আমার মতো মধ্যবিত্তের কাছে যেগুলি মোটেও ফেলনা নয়।
একটু আগের শান্ত সুন্দর সোনালি সকাল নিমেষের মধ্যে হয়ে গেল বর্ণহীন ফ্যাকাসে! মুহূর্তের মধ্যে উদ্বেগের মেঘ ঢেকে ফেলল মন-আকাশকে।
আরও পড়ুন-কোচবিহারে অভিষেকের সভায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস
রাস্তার দু’ধারে ব্যাগ খুঁজতে-খুঁজতে কখন যে সেই পরোটা দোকান পর্যন্ত পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারিনি।
‘আমি জানতাম, আপনি ফিরে আসবেন।’ আমাকে দেখেই লোকটা হাসিমুখে বলল। তারপর ঠেলাগাড়ির পেছন থেকে (যেখানে সকলের চোখ যায় না) ব্যাগটা বের করে, ‘এই নিন। দেখ নিন সব ঠিক-ঠাক আছে কি না।’
জানতাম সব ঠিকঠাকই আছে। ব্যাগ দেখিনি। দেখছিলাম মাঝবয়সি, কাঁচাপাকা দাড়ি, উসকো-খুসকো চুল, বড়বড় চোখের মানুষটিকে। ওই বিন্দু-বিন্দু ঘামে ভেজা পরিশ্রমী মুখটাই এখন আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুখ।
নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি, ‘দাদা, আপনার নামটা?’
লোকটা একগাল হেসে বলল, ‘নাম নিয়ে কী হবে? রাম-শ্যাম-যদু-মধু যা হোক একটা ধরলেই হয়।’
‘তা ধরলেই হয়। তবে, প্রতিটি মানুষেরই তো একটা নাম থাকে…’
‘হ্যাঁ, থাকে। কিন্তু নাম নয়, কামটাই আসল। এই দেখুন না, আমাদের পাড়ার ক্ষুদিরাম নামের ছেলেটা চুরি করে জেল খাটছে, আর লাদেন নামের লোকটা কাল হাসপাতালে এক রোগীকে রক্ত দিয়ে এল! নামে কী আসে যায়?’
না, তারপর আর নাম জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ, ততক্ষণে লোকটির আসল নাম আমি জেনে ফেলেছি।
ওর নাম— মানুষ।