পিতা নোহসি

“আসেন দাদা, অনেক দিন পরে আসলেন। কুথাও গ্যাসলেন নাকি?” পরিচিত হাসি হেসে স্বাগত জানাল জলিল মিঞা। সবে সাতটা বাজে।

Must read

সোমজা দাস 
“আসেন দাদা, অনেক দিন পরে আসলেন। কুথাও গ্যাসলেন নাকি?” পরিচিত হাসি হেসে স্বাগত জানাল জলিল মিঞা।
সবে সাতটা বাজে। এখনও রোজকার বাজার জমেনি ভাল করে। দু-চারজন করে আসতে শুরু করেছে সবে। কার্তিকের মাঝামাঝি বাতাসে হিমের আমেজ। বালাপোশের আদর ছেড়ে ঘুম থেকে উঠতে লোকের একটু দেরিই হয়।
“মেয়ের কাছে গেছিলাম রে জলিল, সেই অ্যামেরিকা”, চওড়া হাসি হেসে বললেন কান্তি ঘোষাল।
“বাহ্, নতুন দ্যাশ দেইখ্যা আসলেন। অনেক দূর না, ওই আমারিকা না কী? পেলেনে যাওয়া লাগে?”
“হ্যাঁ, অনেক দূর। মেয়ের প্রথম বাচ্চা, তাই আমাকে আর গিন্নিকে এক্কেরে টিকিট কেটে উড়িয়ে নিয়ে গেল। বাবা-মা সঙ্গে না থাকলে নাকি চলবেই না”, হাসিটা চওড়া হল কান্তিবাবু্র।
আরও পড়ুন-নাম
“তাইলে তো দাদা খুশির খবর নিয়া আসছেন। তা নাতি হইল নাকি দাদা?” সামনে পলিথিনের প্যাকেটের উপর সাজানো মাছগুলোতে জলের ছিটে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল জলিল মিঞা।
“ছেলেই হয়েছে। একদম আমার মেয়ের মুখ কেটে বসানো। বেশ বড়সড় চেহারা হয়েছে ব্যাটার।”
“বাহ বাহ্, এমন খবর শুদ্দা মুখে হবে না কিন্তুক। মিষ্টি লাগব”, জলিল মিঞার মুখেও চওড়া হাসি।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, খাওয়াব। আমাদের মেয়েটা তো জন্মেছিল নেংটি ইদুরের মতন, অ্যাত্তোটুকু। নাতিটা ভাগ্যিস মায়ের মতন হয়নি। হবে না? ওই দেশের জলহাওয়া, খাবারদাবার সবই অ্যাক্কেরে এ-ক্লাস।” বললেন কান্তিবাবু। বলতে বলতে তাঁর সেই নেংটি ইদুরের মতন ছোট্ট মেয়েটার জ্বলজ্বলে মুখটা মানসপটে ভেসে ওঠে কান্তিবাবুর। একটুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যান তিনি। চলে আসার আগে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিল মেয়েটা।
জামাই হেসে বলেছিল, “লোকে এখানে আসার জন্য হেদিয়ে মরে। আর মহারানির নাকি ভাল লাগে না।”
কান্তিবাবু বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন মেয়েকে! কিন্তু নিজেরই মনে হয়েছিল, সত্যিই যদি মেয়েটা কাছে থাকত, ভালই তো হত।
“কী নিবেন কন। আইজ চিংড়ি ফেরেশ আছে অ্যাকদম। পোস্কার করি দিই?” একটা বেশ নধর চিংড়ির দাঁড়া ধরে হাতে তুলে বলল জলিল।
বর্তমানে ফেরেন কান্তি ঘোষাল। হাত নেড়ে বলেন, “না না, চিংড়ি নেব না। মেয়েটা আমার চিংড়ি খেতে কী ভালই না বাসত! এখন নাকি তার চিংড়িতে অ্যালার্জি। যতসব বড়লোকি রোগ। সে খেতে পারে না বলে তার মায়েরও গলা দিয়ে নামে না চিংড়ি। একার জন্য নিয়ে আমি আর কী করব?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন কান্তিবাবু।
জলিল চিংড়িটা হাত থেকে নামিয়ে রাখে। নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়। গত বছর উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরে বিয়ে হয়েছে রহিমার। জামাইরা চার ভাই। জমিজিরেত আছে ভালই। নিজেরা ভাইয়েরা মিলে খেতি করে। খাওয়া-পরার কষ্ট নেই। এক বছরের উপর হয়ে গেল বাপের ঘরে আসেনি মেয়েটা। জামাইয়ের মোবাইল ফোনে কখনোসখনো কথা হয়। রহিমাটাও চিংড়ি খেতে খুব ভালবাসত। ওইসব দিকে ভাল মাছ পাওয়া যায় না। বাপের মাছের ব্যবসা, অথচ মেয়েটা একটু আত্তি পুরে মাছ খেতে পায় না শ্বশুরবাড়িতে।
“ট্যাংরা কত করে দিবি বল”, জিজ্ঞাসা করলেন কান্তিবাবু।
“ছয়শো টাকা কেজি দাদা। একদম টাটকা। খায়া কবেন, হ্যাঁ জলিল ট্যাংরা খাওয়াইছে সত্য!”
“ছশো? বলিস কী রে? মানুষ খুন করবি নাকি? তুই বরং ওই কাতলাটাই ওজন কর!” একটা মাঝারি আকারের কাতলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন কান্তি ঘোষাল।
“কাতলা তো রোজই নেন দাদা। আজ ট্যাংরাটা নিতে পারতেন। খুব ভাল মাছ ছিল।”
“আমরা রিটায়ার্ড মানুষ। ছশো টাকা দিয়ে ট্যাংরা খাওয়া পোষাবে না”, হেসে বললেন কান্তিবাবু।
জলিল মিঞা কাতলা মাছটা হাতে তুলে দাঁড়িপাল্লায় চড়াল। কান্তি ঘোষাল একটু অন্যমনস্কভাবে তাকালেন কালো চকচকে পেটমোটা ট্যাংরাগুলোর দিকে। তাদের কর্তাগিন্নিকে টিকিট কেটে আমেরিকায় নিয়ে গেছিল মেয়ে। কিন্তু যাওয়া-আসাটাই তো আর একমাত্র খরচ নয়। অবসরের পর পিএফ ফান্ড থেকে পাওয়া টাকা থেকে অনেকটা টাকা তুলে ডলার বানিয়ে নিয়ে গেছিলেন। ওখানে সব কিছুরই দাম এ-দেশের কয়েকগুণ। প্রথম প্রথম দাম দেখে গায়ে জ্বর আসত।  সব জিনিসের প্রাইসট্যাগে ডলারে লেখা দাম দেখেই টাকায় কত হয় মনে মনে হিসেব করতে বসতেন। পরের দিকে অভ্যেস হয়ে গেছিল অনেকটা। তবে যা নিয়ে গেছিলেন, পুরোটাই খরচ করে এসেছেন। তাঁদের কর্তাগিন্নির বয়স হয়েছে এখন, হাজারগন্ডা আধিব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। ওষুধবিষুধের পেছনে মাসে মাসে অনেকগুলো করে টাকা বেরিয়ে যায়। বাজারে জিনিসপত্রের আগুনদর। বিপদ-আপদের জন্যেও কিছু জমা-সঞ্চয় হাতে রাখতে হয়। নইলে বড় অসহায় লাগে। তাই ছশো টাকার ট্যাংরা কিনে খাওয়ার মতো বিলাসিতাকে অযথা প্রশ্রয় দিতে আর সাহস হয় না।
কাতলা মাছটাকে আঁশ ছাড়িয়ে চাক-চাক করে কাটতে কাটতে জলিল মিঞার মন তখন ঘুরে মরছে গোরক্ষপুরের কোনও অখ্যাত গাঁয়ের পথে। তার চোদ্দ বছরের রহিমা প্রথমবার মা হতে চলেছে। বাড়ি আসতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ওর শ্বাশুড়ি রাজি নয়। শ্বশুরবাড়িতে তার বড় সংসার, অনেক কাজ। সে না থাকলে শাশুড়ি মাজার ব্যাথা নিয়ে একা পেরে উঠবে না। সুতরাং তার বাপের বাড়ি বাচ্চা বিয়োতে যাওয়ার আর্জি পত্রপাঠ খারিজ হয়েছে।
মেয়েটার জন্য বড় মন কাঁদে জলিল মিঞার। বউ বারবার বলছে, গোরক্ষপুর গিয়ে মেয়েটাকে একবার দেখে আসতে। বিয়ের পর থেকে তত্ত্ব-তল্লাশও করা হয়নি। অভাবের সংসার তাদের। মিঞা-বিবি ছাড়াও আরও তিনটে নাবালক পেট বাড়িতে। যতই ঢালো, সংসারের হাঁ আর বোজে না। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি তো খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না। সেও অনেকগুলো টাকার ধাক্কা।
“পিসগুলো একটু পাতলা করে কাট বাবা!”
কান্তিবাবুর কথায় ধ্যান ভাঙল জলিলের। মাছটাকে দুই হাতে চেপে ধরে সাধ্যমতো পাতলা টুকরো কেটে বার করতে করতে বলল, “মেয়ের দেশে তাইলে ভালই ঘুরলেন দাদা।”
“ভাল বলে ভাল? বাইরের দেশে সুখ-সুবিধাই আলাদা। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, বড় বড় দোকানপাট, আর ওখানে বাঙালিও তো অনেক থাকে। গেলে মনেই হয় না এটা বাইরের কোনও দেশ। আমাদের এখানে তো শুধু ধুলো, ধোঁয়া, করাপশন, ভাঙা রাস্তা। তবু মেয়ের মা সারাক্ষণ আমাকেই দুষে চলে সেই সাতসমুদ্দুর পারে মেয়েটাকে বিয়ে দিলাম বলে। যেন সব দোষ আমারই। অথচ সম্বন্ধ এল যখন, নিজেই নাচছিল”, বলতে বলতে বিষণ্ণ হাসলেন কান্তি ঘোষাল। মনে হল, দূর দেশে মেয়ের সুখের ছবিটা নিজের কাছেই তার ম্লান লাগল।
“ক্যানে মেয়েটার বিয়া দিলা অত দূরে?”
আজকাল অভিযোগ করে জলিলের বউ ফাতিমাও। জলিল উত্তর দেয় না। তাদের মতো সংসারে মেয়ে বড় হলে ঘরে বসিয়ে রাখার বিলাসিতা চলে না। রহিমা হয়েও উঠেছিল বেশ ডাগরডোগর। ফাতিমা তিন বাড়িতে ঠিকা কাজ করে। সকালে কাজে বেরিয়ে যায়। রহিমাকে ঘরে রেখে কাজে গিয়ে সারাদিন চিন্তায় থাকত।
সম্বন্ধটা পেয়ে একদম শুরুতে একটু দ্বিধা করলেও পরে আর আপত্তি করেনি মিঞা- বিবি কেউই। সংসারে একটা পেট কমলে বাকি পেটগুলো একটু বেশি ভরে। মেয়েটারও একটা হিল্লে হয়েছে। এ-নিয়ে জলিল মিঞার দুঃখ নেই। সবই আল্লাহর মর্জি! রহিমার ভাত যদি সে গোরক্ষপুরের চাষিবাড়িতে লেখা থাকে, জলিল মিঞা কী করবে!
আজকাল ফোন করলেই রহিমা বারবার নানাভাবে জিগ্যেস করতে থাকে, ‘আব্বা, দুর্গাপুজার প্যান্ডেলে বাঁশ লাগল?’, ‘আব্বা, ইদে আম্মু এইবার লাল পুলাও বানাইছিল?’, ‘আব্বা, কতদিন দেবের ছেনেমা দেখি না!’ আরও কত কী গড়গড় করে নিজের মনেই বলে যায় রহিমা। জলিল চুপচাপ শোনে। জলিল জানে, ও শুধু একটু নিজের ভাষায় কথা বলে হাঁফ ছাড়ছে। এসব শুধু বলার জন্যই বলা।
পলিথিনের প্যাকেটে মাছের টুকরোগুলো ঢোকাতে ঢোকাতে ভেবে নেয় জলিল, এবার একবার গোরক্ষপুরে গিয়ে রহিমাকে দেখেই আসবে সে। টাকার দরকার হলে ধার করবে। হয়তো পরের ক’টা মাস একটু কষ্ট করে সংসার চালাতে হবে। কান্তিবাবুর দিকে মাছের প্যাকেটটা এগিয়ে দিল জলিল। কান্তিবাবুও পকেট থেকে টাকা গুনে জলিলের হাতে দিয়ে বললেন, “আসি রে।” তারপর এগিয়ে চললেন সবজির দোকানের দিকে।
হালকা কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে সকালের নরম রোদ ওম ছড়াচ্ছে।  মহানগরের জনজীবন জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। গোরক্ষপুরের কোনও চাষিবাড়ির উঠোনে একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে ভারী পেট ধরে ঝুঁকে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। জলিল ভাবে, সেই যে আমারিকা না কী যেন দেশটা, যেখানে নাকি সব ভাল, সে-দেশেও কি বাবুর মেয়েটার মন একই রকম ভাবে পোড়ে তার রহিমার মতন? সেও কি একটু মাছের ঝোল ভাত খাওয়ার জন্য, একটা দেবের ছেনেমা দেখার জন্য আঁকুপাঁকু করে? দুর্গাপুজার সময় তারও কি চোখে জল আসে?
একটু দূরে দোকানে ঘুরে ঘুরে দরদাম করে সস্তায় সবজি কিনছেন কান্তিবাবু। সেখানেও দাঁড়িয়ে আমেরিকা ভ্রমণের গল্প শোনাচ্ছেন তিনি। একটা বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল জলিল। বাজারের রাস্তা ধরে খানিকটা কোলকুঁজো ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া এক ক্লান্ত পিতার দিকে আনমনে চেয়ে রইল আরেকজন অসহায় মানুষ। সেও পিতা, ঠিক এতটাই ক্লান্ত, একই রকম বিষণ্ণ।

Latest article