দেবাশিস পাঠক: সাংবাদিকতার নৈমিত্তিকতায় রাবীন্দ্রিক অনীহা প্রকট ১৮৮৭-তে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘এই বসন্তকাল এসেছে। দক্ষিণের হাওয়া বয়েছে। এ সময়টা একটু আধটু গানবাজনার সময়। এসময়টা যদি কেবলই রুশ, চিন, পাঠানের অরাজকত্ব, মগের মুল্লুক, আবগারী ডিপার্টমেন্ট, নুনের মাশুল, তারের খবর এবং পৃথিবীর যত শয়তানের প্রতি নজর রাখতে হয় তাহলে ত আর বাঁচিনে, পৃথিবীর গুপ্তচর হয়ে বেঁচে সুখ নেই।’’
আরও পড়ুন-শতবার্ষিক-স্মরণ পরিচালক অসিত সেন
এই অনীহা সত্ত্বেও বছরখানেক ‘ভারতী’র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। সেসময় রাজনৈতিক সভাসমিতিতে থাকত তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।
যখন সিডিশন বিল গৃহীত হল তখন রবীন্দ্রনাথ ‘কণ্ঠরোধ’-এর প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে টাউন হলে প্রদত্ত বক্ততায় বললেন, ‘‘গবর্মেন্ট অত্যন্ত সচকিতভাবে তাঁহার পুরাতন দণ্ডশালা হইতে কতকগুলি অব্যবহৃত কঠিন নিয়মের প্রবল লৌহশৃঙ্খল টানিয়া বাহির করিয়া তাহার মরিচা সাফ করিতে বসিয়াছেন, প্রত্যহ প্রচলিত আইনের মোটা কাছিতেও আমাদিগকে আর বাঁধিয়া রাখিতে পারে না…।’’
এসব স্মৃতি সলতে উসকিয়ে দিলে যদি কারও বর্তমানে মোদি জমানায় দেশদ্রোহিতার বিধি লাগু করার ধরনধারণের কথা মনে পড়ে, তবে তার জন্য নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ দায়ী নহে।
আরও পড়ুন-হিটলারের প্রেমকাহিনি
সরকার পক্ষের এরকম অযৌক্তিক ক্রিয়াকলাপের কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, ‘‘কর্তার নিকট আমার ভাষা অস্পষ্ট, আমিও নিরতিশয় অস্পষ্ট, সুতরাং স্বভাবতই তাঁহার শাসনদণ্ড আনুমানিক আশঙ্কাবেগে অন্ধভাবে পরিচালিত হইয়া দণ্ডবিধির ন্যায়সীমা উল্লঙ্ঘনপূর্বক আকস্মিক উল্কাপাতের ন্যায় অযথাস্থানে দুর্বলজীবের অন্তরিন্দ্রিয়কে অসময়ে সচকিত করিয়া তুলিতে পারে।’’
একথা শুনলে যদি কারও মনে ভেসে ওঠে ভারভারা রাও কিংবা উমর খলিদের ছবি, তজ্জন্যও রবীন্দ্রনাথ দায়ী নন।
আর্য ধ্বজাধারী নব্য হিন্দুদের নিয়ে ‘সাধনা’তে ১২৯৮ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় লিখলেন, ‘‘মহাভারতের মহাভারতবর্ষকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে যে-প্রচণ্ড বীর্য, বিপুল উদ্যমের আবশ্যক তাহা কেবল নিরামিষ ও সাত্ত্বিক নহে, অর্থাৎ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ অধ্যাপকের আবাদ করিলে সে ভারতবর্ষ উৎপন্ন হইবে না।’’
আরও পড়ুন-গুরু কে? কেনই বা গুরুপূর্ণিমা?
নাঃ! মোদি-শাহর জমানা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এ মন্তব্য করেননি। সংঘশাসিত ভারতবর্ষের সম্পর্কেও তাঁর এই মন্তব্য নয়। তবু, তবুও, এই মন্তব্য যদি কারও বর্তমানের নিরিখে প্রাসঙ্গিক মনে হলে সে দায় রবীন্দ্রনাথের নয়।
১০ চৈত্র, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’র সম্পাদকত্ব ত্যাগ করলেন, কবিতায় ধরা পড়ল সেই সময়কার মনোলোক। ‘‘লাভ-ক্ষতি টানাটানি,/ অতি সূক্ষ্ম ভগ্ন-অংশ ভাগ/ কলহ সংশয়—/সহে না সহে না আর জীবনেরে খণ্ড খণ্ড করি/ দণ্ডে দণ্ডে ক্ষয়।’’
আন্দোলনে অশান্তি নতুন কোনও বিষয় নয়। প্রতিবাদে প্রতিরোধে উত্তাল উদ্বেগ সময়ে হিংসার দাপাদাপি নতুন কোনও বিষয় নয়। এ-বিষয়েও রবীন্দ্র-ভাবনা প্রচলিত স্রোতে গা ভাসায়নি। চলতিপথের বিপরীতে গিয়ে তাঁর সনির্বন্ধ অনুরোধ দেশবাসীর প্রতি, ‘‘আপনারা ক্রোধের দ্বারা আত্মবিস্মৃত হইবেন না— কেবল বিরোধ করিয়া ক্ষোভ মিটাইবার চেষ্টা করিবেন না।’’ রবীন্দ্রনাথের এই আবেদন ‘রাজনৈতিক ইস্তাহারের মতো’।
‘ভারতী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘তত্ত্ববোধিনী’— একে একে সব পত্রপত্রিকার সম্পাদনাভার ছেড়েছেন। কিন্তু তা বলে নতুন পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহে ভাটা পড়েনি কোনওদিন। এমনকী শান্তিনিকেতনেও ছেলেপুলেদের হাতের লেখা কাগজ ‘শান্তি’, ‘শিশু’, ‘প্রভাত’, ‘বাগান’, ‘আশ্রম’, ‘বীথিকা’ ইত্যাদির প্রতি তাঁর সমসময় সস্নেহ সমর্থন ছিল। যে যে তাঁর কাছে কোনও নতুন পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতেন, তিনি তাঁকে তাঁকেই সাহায্য-সমর্থনে এগিয়ে আসতেন। ‘তবে দেখে নিতেন পত্রিকাটি লঘু ধরনের হবে কি না।’
আরও পড়ুন-বাড়ির সামনে গুলি, খুন তৃণমূল কর্মী
এসব প্রায় অজ্ঞাত অপরিচিত বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন ‘দৈনিক কালান্তর’-এর সঙ্গে জড়িত সাংবাদিক পবিত্রকুমার সরকার তাঁর ‘সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ’ বইটিতে। ‘লোক সেবা শিবির’ থেকে প্রকাশিত ঝকঝকে ছাপায় ২৩১ পৃষ্ঠার এই বইটির পাতায় পাতায় আছে অজানা তথ্যের অবাক করা উন্মোচন। কোথাও বাহুল্য নেই। নেই রবি-কবিকে নিয়ে অতিরিক্ত আদিখ্যেতা। কিন্তু নির্মেদ ভাষায় সঠিক তথ্যের প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় খামতি নেই এতটুকু।
গোটা বইটিতে বিস্তারিত আলোচনার শেষে উপসংহারে পৌঁছে প্রবীণ সাংবাদিক পবিত্রকুমার ‘সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ’-এর আধডজন বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরছেন একেবারে সোজাসুজি, কোনওরকম ভান-ভানিতা না-করেই। সেগুলো এরকম :
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে ধোঁয়া-আগুন, জরুরি অবতরণ স্পাইসজেটের
(১) সংবাদপত্র ও সংবাদের জগৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করেছিলেন।
(২) সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত নয়।
(৩) তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে তিনি সাময়িকপত্রের বিষয় বৈচিত্র্যে নতুন ধারা সংযোজন করেছিলেন, নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলোকে।
(৪) সংবাদধর্মী সাময়িকপত্রের একটা আদল তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
(৫) পত্রিকার গুণমানকে তিনি বাণিজ্যধর্মের কাছে জমা রাখেননি। লঘু মনোরঞ্জক লেখা প্রকাশের তাগিদ উপেক্ষা করেছেন আপসহীন দার্ঢ্যে।
(৬) পত্রিকা-সম্পাদনার বিষয়টিতে রবীন্দ্রনাথের নিয়মিত মনোযোগ ছিল না।
মোটামুটিভাবে ১৩ বছর ৩ মাস পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারই প্রেক্ষিতে লেখকের অন্তিম মন্তব্য, ‘‘তিনি যদি ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করতেন, তা হলে ভারতীয় সাংবাদিকতা নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি কিছু পেত।’’ বইটি পুরো পড়ার পর এই মন্তব্যের সঙ্গে সহমত না-হয়ে উপায় নেই।