সকালবেলাই ঘুমটা গেল ভেঙে। মনটা কেমন যেন ফুরফুরে। মনে পড়ল আজ পয়লা বৈশাখ। কোনও উৎসবের সঙ্গে মনের একটা টেলিপ্যাথি নিশ্চয় আছে। আমার আজ ছুটি। সরকারি স্কুলে পড়াই। ছুটিছাটার মেলা বেশিই। ঠিক করলুম, দিনটা ছুটির মেজাজে কাটাব উইথ ফুল ফ্যামিলি।
আরও পড়ুন-প্রকৃত কবির যাপন প্রত্যাশাহীন
রিটায়ারের পর ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর নিজের কনসালটেন্সি— অতএব সেখানে নো প্রবলেম। মনে মনে একটা প্রোগ্রাম ভাঁজলুম বটে, কিন্তু সন্দেহ রয়েই গেল। প্রস্তাবটা পেশ করতেই ফুল ফ্যামিলিতে অ্যাবসেন্টের খাতায় প্রথম নাম উঠল মেয়ে মনামি ওরফে মাম্পির। সদ্য চাকরি নিয়েছে প্রাইভেট কোম্পানিতে। ছুটির প্রশ্ন নেই। বাঙালির পয়লা বৈশাখে কী এসে গেল কর্পোরেট হাউসগুলোর! অবশ্য মেয়ের কোনও দুঃখ নেই তাতে। এ-ব্যাপারে এদের ফিলিংসটা খুব আনপ্রেডিকটেবল। অন্য ছুটির দিনের থেকে কী এমন আলাদা কাটবে পয়লা বৈশাখ! জাস্ট নরম্যাল একটা ছুটির দিন— রেস্ট ডে, আর ভাল-মন্দ খাওয়া, ব্যস। বরং অফিসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খাওয়া জমে কুলফি। নতুন কাজ বলতে এদিন মা-বাবাকে একটা প্রণাম ঠুকে দেওয়া। আর দেখেছি নতুন জামার কনসেপ্টটা ওদের মন্দ লাগে না। আসলে শপিংমলে ঘুরে বাজার করার মজাই আলাদা। ফুড কোর্টে পেটপুজোটাও হয়ে যায়।
অফিসের জন্য রেডি হতে হতেই আমার কাছে এল মাম্পি— ‘‘মা, তুমি আজ একদম রান্নার ঝামেলায় যাবে না। রান্নার মাসি ছুটি নিয়েছে। আমি অনলাইন খাবার অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।”
আরও পড়ুন-প্রয়াগরাজ নিয়ে কেন চুপ বিজেপি ? বিজেপিকে তোপ চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের
‘‘তোর বাপিকে আগে জিজ্ঞেস কর।”
‘‘ও-সব আমি ম্যানেজ করে নেব। সারা বছরই তো বাড়িতে ভাল ভাল বাঙালি খাবার হচ্ছে। বুঝি না, বাপি আজ কী স্পেশ্যাল টেস্ট পাবে!”
জমিয়ে খাবার প্রবল বাসনা আমার স্বামীটির। কিন্তু বাজারের ধারেকাছে ঘেঁষেন না। অতএব সেই গুরুদায়িত্ব কিঞ্চিৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনন্দের সঙ্গে বহন করে আসছি। স্পেশ্যাল রান্নার ঝামেলা থেকে মাম্পি যে আমায় বাঁচাচ্ছে তার জন্য মনে মনে বেশ পুলকিত আমি। এখানে আমি একমত এই জেনারেশনের সঙ্গে। সত্যিই তো, বাঙালির ইচ্ছের কথা ভেবেই না কত রেস্তঁরায় মিলছে নানা পদের খাঁটি বাঙালি খাবার। কচুরলতি, মৌরলামাছও বাদ যাচ্ছে না। স্বামী এসে দাঁড়ালেন আমাদের কথার মাঝে।
‘‘কী রে মাম্পি, ছুটি পেলি না আজ!”
‘‘কীসের ছুটি বাপি! কর্পোরেট কালচার ডাজেন্ট কেয়ার ফর বাঙালির পয়লা বৈশাখ।”
‘‘ভাবলাম একসঙ্গে খাব। তোর মা জমিয়ে স্পেশ্যাল আইটেম রাঁধবে।”
‘‘ওইসব ওল্ড ট্রাডিশন এখন গন কেস বাপি। মা কিচ্ছু করবে না। আমি অনলাইনে ভাল দোকান থেকে অর্ডার দিচ্ছি। পছন্দের মেনু বল। দুবেলা জমিয়ে খাবে।”
আরও পড়ুন-অসমের রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি পদে রিপুন বোরা
চলে যেতে যেতেও ঘুরে তাকাল মাম্পি—
‘‘আমি রাতে এসে খাব। তবে একটু দেরি হবে। অফিসের পর আজ বন্ধুদের আড্ডাটা মিস করতে চাই না। আর আজকের খাওয়া কিন্তু আমার ট্রিট।”
স্বামীর তো আর কিচ্ছটিু বলার নেই।
‘‘ওঃ, দিদি, মিসাইলটা হেভি ছেড়েছিস।”
আমার টুয়েলভে পড়া পুত্র নীলাভ সব শুনছিল। এবার ফিল্ডে এল।
‘‘আমিও কিন্তু দুপুরে থাকছি না মা। আজ শুভ্রর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা হবে। তবে রাতে জমিয়ে খাচ্ছি। ডান?”
দিদির দিকে তাকিয়ে থাম্বস আপ দেখাল নীল।
‘‘তবে সকালে একটু লুচিটুচি হলে মন্দ হত না—” আস্তে করে বলে আমার দিকে তাকালেন পতিদেব।
মায়া হল। এখনও বাঙালির রসনার জিন শরীর থেকে যে বেরোতে পারেনি। মর্ডান দুনিয়ার চালচলনে ঠিক সড়গড় হয়ে উঠতে পারেননি।
ছেলেমেয়ের দিকে তাকালুম—
‘‘তোরাও লুচি খেয়ে বেরোস়। দেরি হবে না।”
আরও পড়ুন-অসমের রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি পদে রিপুন বোরা
তাড়াতাড়ি চলে এলুম কিচেনে। সাদা আলুর চচ্চড়ির সঙ্গে লুচিপর্ব সেরে বেরিয়ে গেল আমার নেক্সট জেন। স্বামী বেজায় খুশি। এইবার আমার মা-বাবা-শ্বশুর-শাশুড়িকে ফোন করে নববর্ষের প্রণাম জানিয়ে দিলুম। পরে সময়মতো ঘুরে আসা যাবে। মাম্পি আর নীল এই ট্রাডিশন মেনে সকালেই কাজ সেরে ফেলেছে। এখন খুব নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে ফোনেই সেরে ফেলি নববর্ষের শুভেচ্ছা। বাদবাকি হোয়াটসঅ্যাপে। মেয়ে বলে— ‘‘পুরোনো সবকিছু আঁকড়ে ধরে থাকলে এ যুগে বাঁচা যায় না। এখন ফাস্ট ফরোয়ার্ডে যাও। এরকম অনেক দুর্লভ জ্ঞান সংগ্রহ করি ওর থেকে।”
যথাসময়ে দুপুরবেলা এসে গেল নামী দোকানের গরমাগরম খাবার। এলাহি সব আইটেম— ঝুরো ঝুরো আলুভাজা, গন্ধরাজ মুগডাল, এঁচোড়ের ডালনা, পাবদার ঝাল, তেলকই, চিংড়ি মালাইকারি, আমের চাটনি— আর কী চাই! জমিয়ে খাওয়া হল হাফ ফ্যামিলি নিয়ে।
খাওয়ার পর বসলুম ফোন নিয়ে। হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজের বন্যা— ‘হ্যাপি নববর্ষ’, ‘হ্যাপি পয়লা বৈশাখ’। ছোট-বড় সবার এক রা। আমিও উত্তর দিলুম একই লাইনে। স্বামীর হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক নেই, মাথাব্যথাও নেই। ফোনেই সারেন সব। আমিই মাঝখান থেকে মর্ডান হয়ে পড়েছি। আসলে এই জেট-সেট জেনারেশনের মাইন্ড-সেটটা তো বুঝতে হবে। নাহলে যে ডারউইন সাহেব ওপর থেকে গালাগাল দেবেন ওঁর সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট থিওরি অবমাননার জন্য।
আরও পড়ুন-ঠিকাদাররাজ চলবে না
বিকেলে ফোন এল আমার খুড়তুতো দেওরের। ওঁর দোকানের হালখাতার নেমন্তন্ন আগেই করেছিল, এটা রিমাইন্ডার। ফোন ছেড়ে স্বামী তাকালেন আমার দিকে— ‘‘টুবলুর দোকান হয়ে যাব আরও দু-একটা দোকানে। আসলে সবাই তো যেতে বলে।”
গা জ্বলে গেল। এ-সব ব্যাপারে খুউব উৎসাহ। বাড়িতে ঢোকেন হাতে একগাদা মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে। বললুম—
‘‘এবার না গেলেই নয়! তার চেয়ে চল সিনেমা বা কোন বন্ধুর বাড়ি।”
‘‘আরে এক-দু’ ঘণ্টায় চলে আসছি। তারপর চল কোথায় যাবে।”
‘‘সিনেমার শো তো আর আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না, আর বন্ধুরাও বাড়িতে বসে থাকবে না। গেলে ওদের এখনই জানাতে হবে। এমন জানলে মায়ের কাছে চলে যেতাম।”
‘‘প্রতিবার যাই, একটা ট্রাডিশন বলে কথা।”
‘‘ট্রাডিশন ধুয়ে জল খাবে? কোন্ উপকার হবে?”
‘‘নিজের ব্যবসা থাকলে না হয় মেনে নিতাম।”
‘‘না, মানে—”
‘‘মাম্পি ঠিকই বলে— এসব আঁকড়ে থাকলে লাইফটা কোনওদিন এনজয় করতে পারবে না।”
হাঁ করে তাকিয়ে আছেন পতিদেব।
‘‘ডজ মারতেও শিখলে না এতদিনে!” নতুন জেনের ভাষাই বেরোল মুখ থেকে।
‘‘অ্যাঁ— ডজ!!”
‘‘হ্যাঁ, মানে স্রেফ কাটিয়ে দেওয়া । যুগের সঙ্গে নিজেকেও বদলাতে হয়, বুঝলে। জাস্ট চিল, লাভ ইওরসেলফ এনজয়, রিল্যাক্স।”
মেয়ের থেকে শেখা জ্ঞানের বাণীগুলোই উগরে দিলুম। হাফ ফ্যামিলিকে যদি ম্যানেজ করতে পারি। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!