লগ্নির লগ্ন এখন বঙ্গে

সদ্য অনুষ্ঠিত হল বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যে রাজ্যের অন্যতম সমাজকল্যাণ প্রকল্প, লগ্নি-লক্ষ্মী এখন সেই রাজ্যমুখী। অপপ্রচার চলছে চলুক। কিন্তু সত্যিটা এই যে, শিল্প-পুষ্প বিকশিত হতে চলেছে এ-রাজ্যে। কর্মসংস্থানও পল্লবিত হবে। সম্ভাবনাময় আগামীর কথা শোনাচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবনারায়ণ সরকার

Must read

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চতুরঙ্গ উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘যারা নিন্দা করে, তারা নিন্দা ভালোবাসে বলিয়াই করে। সত্য ভালোবাসে বলিয়া নয়।’
রাজারহাট নিউ টাউন কনভেনশন সেন্টারে ২০২০-’২১-এ রাজ্যের সংঘটিত ষষ্ঠতম বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন হয়ে গেল। বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, এর আগের পাঁচটি সম্মেলনে যে ১২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছিল, কার্যত তার কণামাত্র পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ হয়নি। এই বক্তব্য মোটেই ঠিক নয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও বিনিয়োগকারীরা তাঁদের বাণিজ্য সম্মেলনে যা প্রস্তাব দেয়, তার কতখানি বাস্তবায়িত হয়?
ধরা যাক, ভাইব্রেন্ট গুজরাট। প্রতি দুবছর যে ভাইব্রেন্ট গুজরাট অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে যে বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়, তার সম্পূর্ণ বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয় কি!

আরও পড়ুন-নববর্ষের নববিধান

২০১৯ সালের ভাইব্রেন্ট গুজরাট ধরা যাক। ওই অনুষ্ঠানে প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু বড় শিল্পে ২০১৯ সালে বিনিয়োগ হয়েছিল মাত্র ১৮,৮৬১ কোটি টাকা। ২০২০ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। তবে এটা ঘটনা যে গুজরাটের মতো রাজ্যে, একটা বড় অংশের বিনিয়োগ ঘটে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বিভিন্ন প্রকল্পে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা অনেক রাজ্যে ঘটে না।
এবার পশ্চিমবঙ্গে আসা যাক। পশ্চিবঙ্গে যা বিনিয়োগ ঘটেছে তার সিংহভাগ ঘটেছে ছোট শিল্পে অর্থাৎ এমএসএমই প্রকল্পে। বড় শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শিল্প দপ্তরের ডিআইপিপি-এর এসআইএ-এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বৃহৎ শিল্পে গত পাঁচ বছরে বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে ১৪,২৯৭ কোটি টাকা। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ যথাক্রমে ২,৬০২ কোটি টাকা, ৬,৫৫০ কোটি টাকা, ২,৩৬১ কোটি, ৮১৭ কোটি টাকা এবং ১,৯৬৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে বড় শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল ষষ্ঠ। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল চতুর্থ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বামফ্রন্টের শেষ চার বছরে বড় শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ঘটেছিল ২,৮৯৭ কোটি টাকা। ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে যথাক্রমে ৯১৬ কোটি, ১৮৬, ৬৩২, ১১৬৩ কোটি টাকা। তৃণমূল সরকারের প্রথম চার বছরে অর্থাৎ ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বেসরকারি বড় শিল্পে মোট বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে ৭,৫৩৬ কোটি টাকা। একই সময় বামফ্রন্টের চেয়ে প্রায় পৌনে তিন গুণ বেশি।

আরও পড়ুন-প্রকৃত কবির যাপন প্রত্যাশাহীন

এবার বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলন সম্পর্কে আসা যাক। ৪২টা দেশের প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৪টি দেশ অংশীদার হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিল। সম্মেলনে বিদেশি প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ৫০০-র মতো। অনেক বড় শিল্পপতি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। আদানি গোষ্ঠী এই সম্মেলনে প্রথম পা রেখেই ঘোষণা করেছিলেন যে, আগামী এক দশকে বাংলায় তাঁরা ১০,০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন। এবং এর ফলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হবে প্রায় ২৫,০০০ মানুষের।
এই সম্মেলনে মোট ৩.৪২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব ঘোষিত হয়। সম্মেলনে মোট ১৩৭টি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। ৬টি বিজিবিএস-র মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। আদানি গোষ্ঠী ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের প্রস্তাবগুলি হল— সিটি গ্যাস বণ্টনে এইচপিসিএল-এর লগ্নি ৮,০০০ কোটি টাকা। জেএস ডব্লু-এর হাইড্রো পাম্প স্টোরেজ প্রকল্পে ৫,০০০ কোটি টাকা। বেঙ্গল গ্যাসের বিনিয়োগ ৫,০০০ কোটি টাকা। অশোকনগরে তেল ও গ্যাস উত্তোলনে ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ওএনজিসি-র। মুর্শিদাবাদে ব্যাটারিচালিত বাস নির্মাণে ৩,০০০ কোটি টাকা। হিরা নন্দানি গোষ্ঠীর ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগ ১,৫০০ কোটি টাকা। টেকনো ইন্ডিয়ার বিনিয়োগ ১,৫০০ কোটি টাকা। কৃষি ও সরঞ্জামে লগ্নি ৩,২৬৯ কোটি টাকা। পরিষেবায় ২,৭০০ কোটি টাকা। পর্যটনে ৫,০০০ কোটি টাকা। গ্যাস বণ্টন ১৭,০০০ কোটি টাকা। শিক্ষায় বিনিয়োগ ৩,৩০০ কোটি টাকা ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য, যারা বাংলায় বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে, তারা হল মাইক্রোসফট, আইবিএম, আইটিসি, লোগোশ, আদানি গ্রুপ ইত্যাদি। এই সম্মেলনে কর্মসংস্থানের লক্ষমাত্রা ৪০ লক্ষ।

আরও পড়ুন-প্রয়াগরাজ নিয়ে কেন চুপ বিজেপি ? বিজেপিকে তোপ চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের

এটা ঘটনা, বর্তমান সরকারের মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পে বিশেষ নজর রয়েছে। বামা-আমলে ক্লাস্টারের সংখ্যা ছিল ৫০টির মতো। বর্তমানে ক্লাস্টারের সংখ্যা ৫২১টি। ২০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি হয়েছে। ২২টি প্রোডাক্টের জিআই পেয়েছে রাজ্য। তাজপুর বন্দর নির্মাণ ছাড়াও দেওচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর এই সরকার যা মুখ্যমন্ত্রী এই সম্মেলন থেকেই ঘোষণা করলেন।
প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আটটি স্তম্ভর উপরে দাঁড়িয়ে আছে রাজ্যের শিল্প। পরিকাঠামো, সামাজিক-সুরক্ষা, শিক্ষা, কারিগরি-শিক্ষা, মূলধনী বিনিয়োগ, বাণিজ্য সরলীকরণ, প্রশাসনিক সরলীকরণ এবং ধর্মঘট-বিরোধী অবস্থান। এর ওপরেই ভিত্তি করে শিল্পের ইমারত গড়ে তুলতে চান মুখ্যমন্ত্রী।
বিরোধীরা বলেন এ-রাজ্যে কোনও শিল্প গঠিত হয়নি। এ-রাজ্যে যদি শিল্প না থাকে, তা হলে, গত বছরই সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব এসেছে ১,৭৬,০০০ কোটি টাকা। কীভাবে অর্জিত হল!

আরও পড়ুন-ইউক্রেনকে এবার ফিনিক্স ঘোস্ট ড্রোন দেবে আমেরিকা

এর মধ্যে ৭৪,০০০ কোটি টাকা আসছে নিজস্ব কর থেকে। ৫৬,০০০ কোটি টাকা আসছে করের শেয়ার হিসেবে কেন্দ্র থেকে। এর মধ্যে আবগারি কর থেকে আসছে মাত্র ১৫,৫০০ কোটি টাকা। এইসব রাজস্ব গুজরাতের রাজস্ব অপেক্ষা অনেক বেশি।
অর্থাৎ রাজ্যে শিল্প না থাকলে, কেউ তো আর রাজ্যকে মুখ দেখে টাকা দেবেন না! বামফ্রন্টের থেকে এই আয় প্রায় ৪ গুণ বেড়েছে। সুতরাং, শিল্প যে রাজ্যে বাড়ছে, তা তথ্য থেকেই স্পষ্ট।
পরিশেষে, রবীন্দ্রনাথের ‘অসম্ভব কথা’ গল্প দিয়ে শেষ করব। তিনি লিখেছিলেন, ‘এখনকার দিনের সুচতুর মিথ্যা, মুখোশ পরা মিথ্যা।’
বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর শিল্পসম্মেলনগুলির সাফল্য মানতে পারছেন না বলেই তাঁরা মুখোশ পরে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন।

Latest article