কেউ বলে ধূমপান করলে নাকি কাজ করতে উদ্যম পাওয়া যায়, কেউ বলে দুশ্চিন্তা দূর করে, কারও আবার সকালে পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, কারও ক্ষেত্রে আবার শুধুই নেশা। কিন্তু এই ধূমপানই যত সর্বনাশা!
আরও পড়ুন-সাক্ষীদের পাশে কুম্বলে-ভাজ্জি
ধূমপানের স্বরূপ
ধূমপান বলতে সাধারণত তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কথাই বলা হয়ে থাকে। ছোট-মাঝারি-বড়, ধনী-নির্ধন, লম্বা-বেঁটে, সরু-মোটা, বুড়ো-জোয়ান, শিক্ষিত-মূর্খ, বেকার-কর্মরত, কানা-কুঁজো, অক্ষম-সক্ষম, নারী-পুরুষ, প্রায় কোনওরকম ভেদাভেদ ছাড়াই একটি বৃহৎ সংখ্যক মানুষ ধূমপান করে থাকেন। ধূমপান শরীরের মধ্যে তামাক গ্রহণের একটি মোক্ষম উপায়। মানুষজন সচরাচর বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা, খৈনি, গুটকা, জর্দা, সিগার, সিগারিলোস, হুঁকো, ধোঁয়াহীন তামাক ও আরও নানাবিধ উপায়ে শরীরের মধ্যে তামাক গ্রহণ করে থাকে। তামাক হল সোলানাসিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নিকোটিয়ানা গণের একপ্রকার মাদক গাছের পাতা। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল নিকোটিয়ানা ট্যাবাকাম। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে নিকোটিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা আমাদের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে ও মানবদেহের যাবতীয় ক্ষতিসাধন করে।
আরও পড়ুন-কলকাতা লিগে প্রিমিয়ার ‘এ’ ও ‘বি’ মিশে গেল, ডায়মন্ড হারবারের প্রতিপক্ষ তিন প্রধানও
নিকোটিনের মরণফাঁদ
ক্ষণস্থায়ী মনোরঞ্জন-হেতু তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে মানুষের দেহে প্রবেশ করে নিকোটিন, টার বা একপ্রকার চটচটে রস এবং কার্বন মনো অক্সাইড গ্যাস— তিনটেই মানুষের জীবনের জন্য বিষ! নিকোটিন হল দশ অণু কার্বন, চোদ্দো অণু হাইড্রোজেন ও দুই অণু নাইট্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্ষারীয় মাদক রাসায়নিক পদার্থ। পতঙ্গনিরোধক হিসেবে নিকোটিনের বহুল প্রচলন সত্ত্বেও এটি মানবজাতির জন্য একটি তীব্র নেশাযুক্ত সেবক।
সাধারণত আমেরিকাকে তামাকের উৎপত্তিস্থল মনে করা হলেও, প্রায় ১৫৫৯ সালে গোটা ইউরোপে এর প্রচলন শুরু হয়েছিল। ১৫৬০ সালে ফরাসি কূটনীতিক জিন নিকোট ডে ভিলি পর্তুগালে কর্মরত অবস্থায় প্যারিসে ফরাসি রাজার কাছে তামাক ও তামাকের বীজ পাঠিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতে। সেই থেকেই তামাকের মধ্যে প্রাপ্ত এই রাসায়নিকের নামকরণ হয় নিকোটিন। তবে মানবজাতির জন্য এই পদার্থটি খুবই অস্বাস্থ্যকর। তাই আর নয় নিকোটিন।
আরও পড়ুন-এটাই অবসরের সেরা সময়, কিন্তু…আর একটা বছর, আমার উপহার: ধোনি
তামাক সেবনের খেসারত
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্ব আজ চিন্তিত। তামাক গ্রহণে নেশা হয়, কখনও কখনও সেই নেশা খুবই তীব্র হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ মানবদেহের নানা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গভীর ভাবে তাড়িত হয়। রক্তবাহী নালিকাগুলো সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে সারা দেহে এমনকী পুংলিঙ্গে পর্যন্ত রক্ত সংবহন ব্যাহত হয়। যৌন বিষয়গুলো ঘেঁটে যায়, স্বাভাবিকতা বিঘ্নিত হয়। মানবদেহের পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়, মুখ ও দাঁতের ব্যামো হয়, ফুসফুসের অসুখ কড়া নাড়ে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয় ও এমনকী স্ট্রোক হয়েও মৃত্যু ডেকে আনে। মানসিক ও চিরস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনে গভীর দুর্দশা টেনে আনে এই তামাক সেবন।
আরও পড়ুন-সই চাওয়ায় ধোনি অবাক হয়েছিল: সানি
পরিসংখ্যান কী বলছে
কেউ একজন প্রত্যক্ষভাবে ধূমপান করছে, আর আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, সেই ধোঁয়া বাতাসে মিশে শ্বাস নেওয়ার সময় আমার শরীরেও প্রবেশ করল— এভাবেই আমি পরোক্ষভাবে ধূমপান করলাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধূমপানের জন্য গোটা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় আশি লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ পরোক্ষভাবে ধূমপানকারী। ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানান, গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২.৩ শতাংশ লোকই তামাক সেবন করে থাকে; এদের মধ্যে প্রায় ৩৬.৭ শতাংশ পুরুষ ও ৭.৮ শতাংশ নারী।
আরও পড়ুন-এটাই অবসরের সেরা সময়, কিন্তু…আর একটা বছর, আমার উপহার: ধোনি
ভারতবর্ষ ও তামাক সেবন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারতবর্ষের প্রায় ২৬.৭ কোটি মানুষ তামাক সেবন করে যা গোটা বিশ্বের ধূমপানকারীদর বৃহদাংশ। ভারতবর্ষের প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর+ বয়স)-দের মধ্যে প্রায় ২৮.৬ শতাংশ তামাক সেবন করে, এদের মধ্যে ৪২.৪ শতাংশ পুরুষ ও ১৪.২ শতাংশ নারী। প্রতি বছর এর কারণে ভারতবর্ষের প্রায় ১৩.৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়, এদের মধ্যে এককভাবে শুধু সিগারেট খাওয়ার দরুন মারা যায় ৪.৮ লক্ষ এবং ধোঁয়াহীন তামাক সেবন দরুন ২.৩ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। দুঃখের বিষয়, ভারতবর্ষের ১৩-১৫ বছর বয়সি যুবকদের মধ্যে প্রায় ৮.৫ শতাংশ তামাক গ্রহণ করে। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তাজনক!
আরও পড়ুন-দেখভালের প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মীরা যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকা
বিশ্বজনীন সচেতনতা
সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যের অধিকার, সুস্থ শরীর ও নিরাপদ ভবিষ্যতের লক্ষ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার না করার উদ্দেশ্যে গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর ৩১ মে পালিত হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড নো টোবাকো ডে’ বা ‘আর নয় তামাক সেবন দিবস’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বাস্থ্য-সুরক্ষার তাগিদে গৃহীত ১১টি জনহিতৈষী কর্মযঞ্জের একটি হল তামাক-বিরোধী দিন যাপন। সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত হয় ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব ধূমপান-বিরোধী দিবস পালিত হবে, এরপর ১৯৮৮ সালে ওই পরিষদ পুনরালোচনার মাধ্যমে ৩১ মে-কে বিশ্ব তামাক বিরোধী দিন হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকেই এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে জনসাধারণের মধ্যে তামাক-বিরোধী সচেতনতা গড়ে তুলতে।
আরও পড়ুন-‘গতকালই আমি নিশ্চিত করেছি আমি যাব’ পাটনায় বিরোধী জোটের বৈঠক প্রসঙ্গে জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের কথা
পরিসংখ্যান ও প্রতিবেদন দায়ী করছে ভারতবর্ষ পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম তামাক সেবনকারী দেশ, চিনের পরেই। ভারতবর্ষে প্রতিবছর ধোঁয়াহীন তামাক সেবনের জন্য মৃত্যুর সংখ্যা গোটা বিশ্বের মৃতের সংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ। এই খবর নিশ্চিতভাবেই ভয়ঙ্কর। ভারতবর্ষের যুবসমাজ আজ তামাকের নেশায় বুঁদ হয়ে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই দেশের মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা ও জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে সর্বাধিক ধূমপানকারীর দেখা মেলে। জানা যায়, ভারতবর্ষের মধ্যে শহর কলকাতা সেই ১৮৬৩ সালে প্রথম ধূমপান-বিরোধী আইন এনেছিল। কিন্তু এখনও মানুষ বেহিসাবি তামাক সেবন করেই চলেছে। আসলে কোনও সরকারি বা বেসরকারি আইন নয়, এই নেশা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের বড় প্রয়োজন একটি সুস্থ ও দৃঢ় তামাক-বিরোধী মানসিকতা!
আশা করি আমরা সবাই এ-বিষয়ে প্রস্তুত থাকব।