উদ্বাস্তু কলোনি থেকে নোবেল জয়ের বিশ্বলোকে বিজ্ঞানী আডা ই ইয়োনাথ

ছোটবেলা থেকেই দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, সে বিজ্ঞানী হবে। চোখের সামনে আদর্শ মারি কুরি। সেই স্বপ্নই তাঁকে একদিন পৌঁছে দিয়েছে নোবেল পুরস্কারের সম্মানের মঞ্চে।

Must read

দারিদ্র, অনটন, প্রতিকূল পরিবেশ কোনও বাধাই তাঁকে নিরস্ত করতে পারেনি। যে জেরুজালেমে এক আস্তাবলে খড়ের গাদায় জন্মেছিলেন এক বিশ্বপ্রেমের প্রতীক যিশুখ্রিস্ট, সেই জেরুজালেমেই এক উদ্বাস্তু কলোনিতে হতদরিদ্র পরিবারে জন্মান এই স্বপ্নজয়ী বিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, সে বিজ্ঞানী হবে। চোখের সামনে আদর্শ মারি কুরি। সেই স্বপ্নই তাঁকে একদিন পৌঁছে দিয়েছে নোবেল পুরস্কারের সম্মানের মঞ্চে।

আরও পড়ুন-পুজোর লেখালিখি

বাবা হিল্লেল এবং মা এস্তার লিফশিৎজ। ১৯৩৩ সালে উদ্বাস্তু ইহুদি হিসবে পোল্যান্ড থেকে এসে প্যালেস্তাইন শহরে ঠাঁই নেন এই পরিবার। ছোট্ট পরিসর, অসংখ্য মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার দিনাতিপাত। সেই পরিস্থিতিতেই ১৯৩৯ সালের ২২ জুন জেরুজালেমের জেলুয়া নামক স্থানে চোখ মেলল সেই মেয়ে। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। ক্রমশ, বাবার কোলে চড়ে বাবার মুদির দোকানের বেচাকেনা দেখতে-দেখতেই বড় হওয়া। বাবা দরিদ্র হলে কী হবে, প্রবল বাসনা মেয়েকে শিক্ষিত করে তোলা। যত কষ্টই হোক চাইলেন মেয়ে ভাল কোনও স্কুলে পড়ে বড় হোক। মেয়েরও তাই ইচ্ছে। চরম দারিদ্রের মধ্যেও নিজের বলতে শুধু কিছু বই। সেই বইগুলোই শিশুর সবচেয়ে আদরের বন্ধু। পিতামাতা তীব্র দারিদ্র‌ের মধ্যেও মেয়েকে শিক্ষার জন্য ভাল স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু ভাগ্য যার বিরূপ তার কি সব কিছু সহজে হয়? সেখানেও প্রভূত প্রতিবন্ধকতা।

আরও পড়ুন-কাজের মানুষের কথা কাছের মানুষের কলমে

ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার তখনই। স্কুলে পড়াকালীনই ছোট্ট ইয়োনাথ অকস্মাৎ হারাল তার বাবাকে। পিতৃহীন ইয়োনাথকে বাধ্য হয়েই উদ্বাস্তু কলোনি ছেড়ে চলে যেতে হল তেল আভিভ-এ।  কপর্দকহীন পরিবার। পিতৃহীন ইয়োনাথ তবু নাছোড় নিজের পড়া চালিয়ে যেতে। বাধ্য হয়েই নিলেন টিউশনি। গতিবিদ্যায় পারদর্শী। কিছু ছাত্র পড়িয়ে যে অর্থ উপার্জন করেন সেই অর্থেই পড়া চলিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁকে যে বড় হতেই হবে। এই স্বপ্ন আর জেদই তাঁর এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। কঠিন সাধনার পথ পেরিয়ে ইয়োনাথ ১৯৬২ সালে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতক হলেন। বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রী থেকে কলেজে শিক্ষকদের নজরকাড়া রেজাল্ট। চোখেমুখে আরও বড় হয়ে ওঠার স্বপ্ন। কলেজে পড়াশোনার শেষ অবধি পৌঁছতে চান। সেই ইচ্ছের জোরেই স্নাতক স্তর পেরিয়ে ১৯৬৪ সালে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন।

আরও পড়ুন-পদকের আড়ালে

মাস্টার ডিগ্রির বিষয় ছিল স্টাডিজ অব দ্য স্ট্রাকচার অ্যান্ড ফাংশন অব দ্য রাইবোজম। ১৯৬৮ সালে কোলাজেনের কৃস্টালোগ্রাফি স্টাডির জন্য ইয়োনাথ ডক্টরেট ডিগ্রি পান। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। দারিদ্রকে অনেক দূরে ফেলে তিনি এগিয়ে গেছেন সাফল্যের দিকে। রসায়ন বিষয় নিয়ে গবেষণা আর শিক্ষকতার চরম ঔৎকর্ষ ঘটিয়ে একের পর এক সম্মান ও পুরস্কারে নিজের সাফল্যের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন বিজ্ঞানী জগতে। তারই সেরা সম্মান লাভ ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল জয়ের স্বীকৃতি। বিজ্ঞানী ভেঙ্কট রামন ও টমাস এ স্টাইৎস-এর সঙ্গে যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। রসায়নে মহিলা বিজ্ঞানীর সাফল্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রইল এই বিজ্ঞানীর নাম। বিজ্ঞানের নানা ভাষ্য নিয়ে ছুটে বেড়ান এ-দেশ থেকে সে-দেশ, এ-শহর পেরিয়ে সে-শহরে। প্রচেষ্টা ও মনের জেদ থাকলে যে কতদূর পৌঁছনো যায় তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ এই বিজ্ঞানী। কোনও প্রতিবন্ধকতাই তাঁকে প্রতিহত করতে পারেনি। এই প্রজন্মের সফল বিজ্ঞানীদের কাছে তিনি এক মহান আদর্শ। শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছনো এই রসায়ন বিজ্ঞানীই সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন এক বিজ্ঞানসভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে।

Latest article