ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর রাষ্ট্র করতে হবে দেশটাকে তাই উঠে পড়ে লেগেছে হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদীর দল। সেই লক্ষ্যেই ইতিহাসের পুনর্লিখন পর্ব চলছে এখন। এই পুনর্লিখন প্রকল্পে জ্ঞানীগুণী বিদ্বজনেরা উপেক্ষিত। পাণ্ডিত্য এখন এক প্রবলভাবে বর্জিত শব্দ। এই কারণেই ভারত ইতিহাসের তাবৎ মুসলমান শাসকেরা বহিরাগত বিদেশি, এই একটি পরিচয়েই পরিচায়িত হচ্ছেন। গেরুয়া পক্ষের তো তেমনটাই অভিপ্রায়।
আরও পড়ুন-বিজেপির মদতে বাম-তাণ্ডব
গত সপ্তাহেই তো ঘটে গেল কাণ্ডটা। ভারতে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক মন্তব্য করতে গেলে প্রচুর খাটতে হয়। ইতিহাস ঘেঁটে অনেক তথ্য উদ্ধার করতে হয়। কে যায় আর হ্যাপার মধ্যে! সম্ভবত সেজন্যই এনসিইআরটি দ্বাদশ শ্রেণির বই থেকে এক কোপে মুঘল জমানাটাই কোতল করে দিল। আশা রাখি, এমন শুভ সূচনার পরে, ধীরে ধীরে, সব মুসলমান শাসক বংশই বাদ পড়বে।
এখানেই ব্যাপারটা থামবে বলে মনে হয় না। মোগলসরাই, এলাহাবাদের নাম বদল তো ইতিমধ্যেই দেখেছি। বাবরের মসজিদ ধূলিসাৎ হয়েছে, তাও দেখেছি। তাজমহলকে তেজোমহালয় বানানোর তাল উঠেছে, সেটাও বোধ করি সর্বস্তরে উপেক্ষা করার চক্রান্ত চলছে, সেটাও ভালমতোই টের পাওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-সেবক-রংপো রেলের টানেলে দুর্ঘটনা, শ্রমিকের মৃত্যু
এভাবেই কি একদিন খেয়াল আর ধ্রুপদ ঘরানার ওপরেও কোপ পড়বে?
‘খেয়াল’ এই নামটার উৎসে রয়েছে ফারসি প্রভাব। খেয়ালের অর্থ কল্পনা। বর্তমানে যাঁরা খেয়াল চর্চা করেন তাঁদের বেশির ভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এর আগের প্রজন্মেও হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই খেয়াল চর্চা করতেন। আর তারও আগে, সুফি ইসলামি সংস্কৃতি থেকে খেয়ালের উদ্ভব।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্প গ্রহণ করল রেল
ষোড়শ শতকে দিল্লি ও জৌনপুরী অঞ্চলের সুফি সাধকরা কাটকুলা উপভাষায় ভক্তিগীতি গাইতেন। কাটকুলা হিন্দির উপভাষা। সুফি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পরম্পরা এসেছে আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫)-র কাছ থেকে। তাঁর সময়ে সুফি সাধকরা ফারসি কাউল আর তারানায় গান গাইতেন। জৌনপুরের মুসলমান শাসক সুলতান হুসেন শাহ সারকির আমলে উদ্ভব হয় কাটকুলা উপভাষার। আর তাতেই গীত হতে থাকে সুফি সংগীত। সংগীতপ্রেমী হুসেন শাহ সারকি ১৪৫৮ থেকে ১৫০৫ পর্যন্ত জৌনপুরের শাসক ছিলেন। এই সংগীত পরম্পরা থেকেই খেয়ালের উদ্ভব ও বৈভব অর্জন। খেয়াল ঘরানা নিয়ে গবেষণাকারী ইতিহাসবিদদের মধ্যে প্রাচীনতম যিনি, সেই ক্যাথেরিন বাটলার স্কোফিল্ড আমাদের এইসব তথ্য জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির বাধায় করা যাচ্ছে না মানিকতলার নির্বাচন
খেয়ালের আদিতম রূপই সম্ভবত বিবর্তিত হয়ে দ্রুত বন্দিশে পরিণত হয়। বাটলার স্কোফিল্ড জানাচ্ছেন, সুফি সাধকদের সঙ্গে বৈষ্ণব ভক্তিবাদীদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে খেয়াল দিল্লির হজরত নিজামুদ্দিন দরগার কাওয়ালিতেও যে জায়গা করে নিয়েছিল এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত এই ট্র্যাডিশন বজায় ছিল, সেকথাও বাটলার স্কোফিল্ডের গবেষণায় আলোচনায় উঠে এসেছে।
১৭১৪ থেকে ১৭৪৮ পর্যন্ত দিল্লির মুঘল বাদশা ছিলেন মহম্মদ শাহ ‘রঙ্গিলা’। তাঁর দরবারে বিন বাজাতেন আর ধ্রুপদ গাইতেন নিয়ামত খান ‘সদারং’ (১৬৭০-১৭৪৮)। এই নিয়ামত খানই ধ্রুপদের সঙ্গে খেয়ালের মেলবন্ধন ঘটান। ফলে উদ্ভব হয় বিলম্বিত বন্দিশের।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রকে বাতিল করতে হবে শ্রম আইন
বাটলার স্কোফিল্ডের মতে ১৮৫৭ পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে কলাবন্ত (মুঘল দরবারে যাঁরা গান গাইতেন তাঁদের বংশপরম্পরায় কলাবন্ত বলা হত) ও কাওয়ালরা (কাওয়ালি যাঁরা গান তাঁদের কাওয়াল বলা হয়) খেয়াল গাইতেন। তারপর সংগীত শিল্পী আর যন্ত্রবাদকদের মেরে ফেলা শুরু হল। তখন ওই ঘরানার মুখ্য শিল্পীরা গোয়ালিয়র-সহ দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নিলেন। এই গোয়ালিয়রেই বর্তমানের খেয়াল ঘরানার উদ্ভব।
উনিশ শতকের শেষে দেখা গেল যাঁরা বংশপরম্পরায় খেয়াল শিল্পী তাঁদের অধিকাংশই মুসলমান। কারণ, সুফি সাধনার ঘরানাতেই খেয়ালের জন্ম। কিন্তু এই সময় ওই খেয়াল শিল্পীদের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ হিন্দু ছিলেন। ফলে আমরা পেলাম ভীমসেন যোশী, কিশোরী আমনকর, কুমার গন্ধর্ব, যশরাজ, মল্লিকার্জুন মনসুরের মতো শিল্পীদের।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়ি পেল দ্বিতীয় চুল্লি
আগ্রা ঘরানার খেয়াল শিল্পী ছিলেন মেহবুব খান (১৮৪৫-১৯২২)। ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। কিন্তু তিনিই রচনা করেছেন শ্রীকৃষ্ণের ভজনাগীতি, যার প্রথম দুটি পঙক্তি এরকম— ‘বিখে নয়ন তোরে ভাউনহে হ্যায় কামান / শরবী সুরত মোহনী মুরত”। অর্থাৎ, তোমার তীক্ষ্ণ চোখ আর ধনুকের মতো ভ্রু / কৃষ্ণ মুখশ্রী আর মনোমুগ্ধকর মূর্তি।
এভাবেই হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনা সুর খুঁজে নিয়েছে খেয়ালে। এই বুনোট থেকে একটা সুতো সরিয়ে নিলেই গোটা কাপড়টা নষ্ট।
জিয়াউল হকের জমানায় পাকিস্তানে হিন্দুত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে খেয়ালের ওপর কোপ পড়েছিল।
আরও পড়ুন-‘সব জবাব হবে ২০২৪-এ’ বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
যে-হারে সীমান্তের এপারে হিন্দু-ভারতের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য উদ্যোগ-আয়োজন দেখা যাচ্ছে, তাতে আশঙ্কা হয়, এদেশেও বুঝি ইসলামি সংসর্গের কারণে খেয়ালের ওপর কোপ না পড়ে।
ধর্মীয় মৌলবাদ যে কোনও ভূগোলেই ভয়ঙ্কর।