শিশুকন্যার পুষ্টি
জন্মের পর থেকে কমপক্ষে ৬ মাস চলবে ব্রেস্ট ফিডিং। এটা খুবই প্রয়োজনীয়। এতে শিশুকন্যার বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য পরিপূর্ণ পুষ্টিমান নিশ্চিত থাকে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া-মুক্ত, খাঁটি এবং পরিচ্ছন্ন। ফলে শিশুকন্যার রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে না। এতে থাকে অ্যান্টিবডি, এনজাইম, ভিটামিন এবং মিনারেলস, যা শিশুকন্যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন-জাতিগত হিংসা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, মণিপুরে বেড়ে চলছে মৃত্যু
৬ মাস থেকে ১ বছর
এই সময়ের মধ্যে শিশু কন্যাদের ভাত-ডাল-সবজি দেওয়া যেতে পারে। তবে পুরোপুরি পেস্ট করে না দেওয়াই ভাল। কারণ যখন দাঁত বেরোবে তখন তারা তার ব্যবহার জানবে না। শিখবে না খাবার চিবিয়ে খেতে। তাই এমনভাবে দিতে হবে যাতে তারা চিবিয়ে খেতে পারে। জুস নয়, দিতে হবে ফল। আর্টিফিশিয়াল জুস এড়িয়ে চলতে হবে। চলবে শুধুমাত্র বাড়ির তৈরি খাবার।
আরও পড়ুন-শ্যামা
১ থেকে ৬ বছর
ভাত-ডাল-রুটি-তরকারি দিতে হবে। তবে টিফিন দেওয়া নিয়ে এই সময় একটা সমস্যা দেখা দেয়। কারণ স্কুলে এক-একজনের এক-একরকম টিফিন দেখে মেয়েরা নিত্যনতুন খাবারের স্বাদ পেতে চায়। তাই তাদের পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং কালারফুল খাবার দিতে হবে। তবেই মেয়েরা আনন্দ করে খাবে। অনেক মেয়ে দুধ খেতে চায় না। মিল্ক সেক বানিয়ে দেওয়া যায়। তারমধ্যে কিছু ফল দেওয়া যেতে পারে। ফল খেতে না চাইলে বানিয়ে দিন কাস্টার্ড। এতে খাবারটা আকর্ষণীয় এবং সুস্বাদু হয়। মাছ-মাংস-ডিম খেলেও অনেক সময় বাচ্চা মেয়েরা সবজি খেতে চায় না। তাদের প্যান কেক বানিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আটা, সবজি, ডিম দিয়ে। এমনভাবে খাবার দিতে হবে যাতে তারা খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেক সময় মেয়েরা ব্রেড এবং টক দই খেতে চায় না। আমি একটা উপায় বের করেছি। ব্রেড হালকাভাবে সেঁকে, তার ওপর টক দই মাখিয়ে, একটু চাট মশলা ছড়িয়ে দিলে সেটা চটপট খেয়ে নেবে। খেতেও সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। এইভাবেই নিজেদের মডিফাই করতে হবে। দেখতে হবে যাতে প্রতিদিন একটা করে ডিম দেওয়া যায় এবং অন্তত একটা সময় ফল।
৬ থেকে ১২ বছর
মেয়েদের এই পর্যায়ের শেষেই মেনস শুরু হয়। মেনস্ট্রুয়েশনের জন্য মেয়েদের প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার বেশি দিতে হবে। দেখতে হবে সেটা শরীরে ঠিকমতো কাজে লাগছে কি না। দিতে হবে ফল। সমস্যা হল অনেক সময় তারা মিষ্টি ফল ছাড়া কিছু খেতে চায় না। যেভাবেই হোক তাদের সাইট্রাস ফ্রুট খাওয়াতে হবে। নিয়মিত দিতে হবে মাছ, মাংস, ডিম। পুঁটিমাছ, মৌরলামাছ দিতে পারলে খুব ভাল হয়। সঙ্গে সবুজ শাকসবজি। এই বয়সে মেয়েদের মধ্যে ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায়। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গ্যাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্যালসিয়াম খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুধ খেতে চায় না অনেকেই। দেখলেই নাক সিঁটকোয়। এই ক্ষেত্রে তাদের দিতে হবে দুগ্ধজাত জিনিস। যেমন ছানা, পনির। দেওয়া যেতে পারে মিষ্টি। তবে অধিক নয়। খাওয়ার পর ভাল করে মুখ ধুতে হবে। না-হলে হতে পারে দাঁতের সমস্যা।
আরও পড়ুন-ফাইনালে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে বিদেশিরাই
গর্ভবতী মহিলাদের পুষ্টি
গর্ভবতী মহিলাদের অনেক সময় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস ডেভলপ করে। কারও কারও ক্ষেত্রে কন্টিনিউ করে। কারও কারও ক্ষেত্রে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার ডেভলপ করে। এড়িয়ে চলতে হবে রিফাইন প্রোডাক্ট, মিষ্টি, নুন, জাঙ্ক ফুড। এইসময় ক্যালোরির প্রয়োজন বেশি থাকে। সেটাও হিসেব মতো দিতে হবে। বডি ওয়েট দেখে দিতে হবে এক্সট্রা প্রোটিন। অ্যানিম্যাল প্রোটিন হলেই ভাল হয়। মাছ, মাংস, ডিম। তবে সেটা দিনের বেলায়। রাতে নয়। রাতে অ্যানিমেল প্রোটিন দিলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। হতে পারে বদহজম। ভাজাভুজি সরিয়ে রেখে যতটা সম্ভব দিতে হবে সিদ্ধ খাবার। কষিয়ে রান্না করা খাবার থেকে দূরে রাখতে পারলেই ভাল। যত বেশি কষিয়ে কারি হিসেবে রান্না হবে ডিম, মাছ, মাংসের পুষ্টিগুণ তত কমবে। সপ্তাহে একদিন দিলে ঠিক আছে। কিন্তু নিয়মিত দিলেই সমস্যা। ডিমও সিদ্ধ করে দিলেই ভাল।
আরও পড়ুন-শিক্ষারত্ন পাচ্ছেন কুলপির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
যতবেশি তেল, মশলা, ততবেশি শরীরের ক্ষতি। আগে দুধ খেলেও অনেকের গর্ভবতী অবস্থায় দুধে গন্ধ লাগে। যাঁদের কোনও সমস্যা নেই তাঁদের দুধ দেওয়া যেতে পারে। যাঁদের সমস্যা আছে তাঁদের দেওয়া যায় মিল্ক প্রোডাক্ট। যেমন দই, পনির, ছানা। দিনের মধ্যে অন্তত একবার। পাশাপাশি দেওয়া যেতে পারে পালস প্রোটিন। রাজমা, মুগ, মুসুর ডালের পাশাপাশি দেওয়া যায় নিউট্রেলা। সপ্তাহের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে এই প্রোডাক্টগুলো। অনেকেই জানতে চান, এই সময় কি তেল একেবারেই দেওয়া চলবে না? অবশ্যই চলবে। শরীরে তেলেরও প্রয়োজন আছে। দেখতে হবে কী ধরনের তেল। রিফাইন তেল দিলে কোনও অসুবিধা নেই। তবে পরিমাণমতো। খুব বেশি যেন না হয়। ফ্রাই আইটেম দ্বিতীয়বার যেন ফ্রাই করে না দেওয়া হয়। এই সময় ক্যালসিয়াম খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মায়ের জন্য নয়, বেবির গঠনের জন্যও। দিতে হবে সবুজ শাকসবজি।
আরও পড়ুন-৮৯৩১টি শিবিরে ৩৫ রকমের সুবিধার আবেদন
ভিটামিন ডি-র জন্য কিছু মেডিসিন দেওয়া যায়। তার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের কিছু মাছ, ডিম দেওয়া যেতে পারে। খুব ভাল হয় সকালের দিকে সূর্যের রোদ একটু গায়ে মাখাতে পারলে। আধঘণ্টার মতো। গর্ভবতী মায়ের আয়রনের প্রয়োজনতা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। সাধারণ মহিলাদের তুলনায় বেশি। তার জন্য সবুজ শাকসবজির পাশাপাশি ঢেঁকিছাঁটা চাল, গম, ব্রাউন রাইস, মিলেট দিতে পারলে খুব ভাল। দেওয়া যায় নানা রকমের বিনস। সোয়া বিনসের দশ থেকে পনেরোটা দানা রাতে ভিজিয়ে পরের দিন দিতে পারেন। তার সঙ্গে রাখা যায় অল্প ছোলা। অ্যাভয়েড করতে হবে রিফাইন প্রোডাক্ট। দিনে দুই তিনবার ফল দিতে পারলে খুব ভাল। তার মানে এই নয় আম-কাঁঠাল প্রচুর পরিমাণে খাওয়া যাবে। হাই ক্যালোরি ফুড দিতে হবে মেপে। পেয়ারা, আপেল, নাসপাতি, জামরুল দেওয়া যেতে পারে। আর একটা বিষয় বলব, দেখতে হবে যে খাবারটা যাঁকে দেওয়া হচ্ছে, তিনি সেটা নিতে পারছেন কি না। সব সময় দামি খাবার খেতে হবে তার কোনও মানে নেই। পুষ্টি পাওয়া যায় ঘরোয়া খাবারেও। দিতে হবে ভিটামিন এ।
আরও পড়ুন-সেটে অসুস্থ দেব, নিচ্ছেন চিকিৎসকের পরামর্শ, বন্ধ হচ্ছে না প্রধান ছবির শুটিং
রঙিন শাকসবজি এইক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দিনে জল খেতে হবে তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার। লস্যি, জুস, ডাবের জল দেওয়া যায়। কারণ আমাদের এখানে প্রচুর পরিমাণে ঘাম হয়। শরীর থেকে জল বেরিয়ে যায়। তাই জল খেতে হবে পরিমাণমতো। না-হলে কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় শরীরের ওজন নিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। কমিয়ে দেন খাওয়াদাওয়া। কেউ কেউ ব্রেকফাস্ট না করে লাঞ্চে অনেকটা খাবার খেয়ে নেন। সেটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আমার পরামর্শ, একসঙ্গে অনেকটা খাবার না খেয়ে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে অল্প অল্প করে খেতে হবে। চা-কফি দিনে দু’বার দেওয়া যেতে পারে। তার বেশি হলে সমস্যা। চায়ের মধ্যে গ্রিন-টি, হারবাল-টি খুব ভাল। মাঝেমধ্যে একটু বাদাম, চিপস জাতীয় খাবার মুখে দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন-৮৯৩১টি শিবিরে ৩৫ রকমের সুবিধার আবেদন
সন্তান প্রসবের পর
এই সময় বেবি ব্রেস্ট ফিডিং করে। তাই খুব বুঝে খাবার খেতে হবে। জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলাই ভাল। অন্তত প্রথম ছয় মাস। এইসময় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ক্যালোরির প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে। দুধসাবু দেওয়া যেতে পারে। দিনে তিন থেকে চারবার ফল দিতে হবে। শাকসবজি কাটার আগে সাধারণ জলে ধুয়ে হালকা গরম জলে একবার নাড়াচাড়া করে নিতে পারলে খুব ভাল হয়। এটা অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে তো কথাই নেই। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি এই সময় ফিজিক্যাল মুভমেন্ট খুব প্রয়োজন। তবে গর্ভাবস্থায় বেড়ে যাওয়া ওজন কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে কমপক্ষে এক বছর পর। তার আগে একেবারেই নয়।
আরও পড়ুন-ম্যাসিডোনিয়ার সিস্টার সিটি হবে কলকাতা
মেনোপজের সময়
প্রি-মেনোপোজ বা পোস্ট-মেনোপজের সময় একজন মহিলার শরীরে অনেকরকম সমস্যা দেখা দেয়। এই সময় প্রোটিন, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে দিতে হবে। শরীরে নানারকম ইনফেকশন, স্কিন ডিজিজ দেখা দিতে পারে। মোটামুটি ৪০-৪৫ বছর বয়সি মহিলাদের। বাড়াতে হবে ইমিউনিটি। কমাতে হবে ওজন। এই সময় খেতে হবে প্ল্যানড বেসড খাবার। করতে হবে শরীরচর্চা। এড়িয়ে চলতে হবে জাঙ্ক ফুড। দিতে হবে সবুজ শাকসবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম, সোয়া প্রোডাক্ট। ভাজাভুজি, রেড মিট এড়িয়ে চলতে পারলেই ভাল। এই বয়সে জয়েন্ট পেইন, ব্যাক পেইন ইত্যাদি বাড়তে থাকে। সমস্যা দেখা দেয় মাসলের। তার জন্য প্রয়োজন ভিটামিন-সি। হার্ট, সুগারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তেল, ময়দা, মিষ্টি যতটা সম্ভব কম দিতে হবে। আটার রুটি দেওয়া যায়। অনেকেই ওটস খান। তবে কী ধরনের ওটস সেটা দেখতে হবে। মশালা ওটস এগিয়ে চলতে হবে। যদিও ওটা বেশ সুস্বাদু। পাশাপাশি ম্যাগি, চাউমিন, কেক, পেস্ট্রি, কুকিজ অ্যাভয়েড করতে পারলে বেটার।
আরও পড়ুন-বৃষ্টির আবহেই আজ ভারত-পাক দ্বৈরথ
বয়স্কা মহিলারা কী খাবেন
এই সময় মহিলাদের ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যায়। দেখা দেয় বদহজমের সমস্যা। তাই সিদ্ধ খাবারের দিকে জোর দিতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে র ফুড। তবে সঙ্গে সঙ্গে দিলে সমস্যা তুলনামূলক ভাবে কম। কোনও খাবার যেন ফেলে রাখা না হয়। ফ্রিজে জমিয়ে রাখা আগের দিনের খাবার শরীরের যথেষ্ট ক্ষতি করে। ফ্রিজে খাবার ঢেকে রাখতে হবে। কোন খাবার কোন সময় দেওয়া হবে, সেটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের প্রয়োজন হাই ফাইবার ডায়েট। রাতে রুটি, ওটস, ডালিয়া দেওয়া যায়। মোটামুটি হালকা খাবার। এড়িয়ে চলতে হবে মাছ, মাংস, ডিম, ভাত। কারণ রাতে খাওয়ার পরেই শুয়ে পড়েন বেশিরভাগ মহিলা। তাই ঠিকঠাক হজম হয় না। সকালে পরিমাণমতো ননভেজ দিলে সমস্যা নেই। দিতে হবে প্রপার ব্রেকফাস্ট। লাঞ্চ তার থেকে কম। মাসে এক বা দু’দিন বাইরের খাবার দেওয়া যায়। তবে নিয়মিত নয়। এগুলো মেইনটেইন করতে পারলে ভাল। শরীর ঠিকঠাক থাকবে।