বাউল পদাবলিতে বিষয়কে বিষের মতো দেহের অন্তিম গাঁড়ায় সিদ্ধ করা হয়েছে, নিজস্বী যাপনে। এই জীবন আত্মপাগল ধন! তাকে হারিয়ে খুঁজতে হয়। আর এই বিষয়কে ধরতেই গানকে বিভিন্ন পর্যায়ভেদে ভাগ করা হয়েছে, বাউল যাপন সাধকদের সূত্রে। সাধকদের গুহ্যতত্ত্বানুসারের এই ভাগকে বাউল সাধকেরা সুরের বাগ্যন্ত্রের খেলায় নানান শব্দে রূপ দেন। যা শ্রবণযন্ত্রে কাঠামো তৈরি করে সাধন সংগীতের। আর তারই ছবি তৈরি হয়ে মণিমর্জ্জায় এবং চোখে-কানে আঘাত হানে। তখনই চেতন বীজ আমাদের দরজা খোলে। আত্মজাগরণের মধ্য দিয়ে। বাউলের পদ শিল্পীর কণ্ঠের বাগ্যন্ত্রের খেলায় আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, প্রেম, মাতৃতত্ত্বের মতো চোদ্দোটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। যেন আগুনবরণ জলকেলি। দেহতত্ত্ব ও আত্মসাধনায় বাংলার মহিলা বাউলদের চর্চাকারীরা জানেন, সাধন তত্ত্বের গভীরে গিয়ে বাউল গানকে স্থূল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ এবং আরও ১৬টি উপবিভাগে ভাগ করা হয়। এই সাধনার মাটি দেহের পরিসরটি সহজ নয়। আত্মযাপনে বাউল হয়ে উঠেছেন, মাটির সাধক।
আরও পড়ুন-অমলিন মলিনা
বাংলার বাউল সাধকদের মতে বাউলসাধনা আর গানের সাধনায় ত্রিস্তর আত্মতত্ত্ব, পরতত্ত্ব এবং গুরুতত্ত্বকে তুলে ধরা হয়। নারী-পুরুষ নিজ দেহে এই তত্ত্বের জ্ঞান জানার চেষ্টা করেন, আমৃত্যু। কাম-কামির খেলা পাতেন দেহ সংসারে। তবে বেশির ভাগ বাউল গায়ক পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষদের দৃষ্টিতে বস্তুরক্ষার জন্য বস্তুতত্ত্ব চিহ্নিত হয়। পরতত্ত্ব মূলত নারী-দেহতত্ত্ব। তার উপলব্ধি করেন সাধিকা বাউলেরা। রজ ও নারী বস্তুর তত্ত্ব, দেহের গভীরে নিয়ে গিয়ে থাকেন আত্মযাপনে মগ্ন। পুরুষের বস্তু কেবল, একটি স্বরবর্ণের মতো মৌলিক উপাদান। নারীর মূলতত্ত্বের সঙ্গে মিলেছে রজ, তাই একে যৌগিক ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। এই হল চারচন্দ্রের মিশ্রিত সাধনা। বাউলের ভূমিতে স্বরের সঙ্গে, ব্যঞ্জন, রেফ, য-ফলা, অন্য ব্যঞ্জন মিশে যায়। এই পদের কণ্ঠখেলায় ফুল, নূর-নবী, কালা, কালী আর শ্যাম-শ্যামা কোথায় যেন এসে দাঁড়িয়েছে। এ-বিষয়ে স্বরূপ দামোদরের কড়চায় হারাধন দাস লিখেছেন—
‘ঋতুকাল বিনা নারী সঙ্গ না করিবে
শাস্ত্রেতে নিষিদ্ধ যাহা অবশ্য পালিবে।।’
আরও পড়ুন-নিখোঁজ
এই তত্ত্বের খেলায় দেহপদাবলি আলোচিত। ঠিক এই শব্দগভীরে প্রবেশ করানো উচিত কি না বলতে পারব না। তবে দরকার ছিল দেহযাপন। সেখানে উচিত, আর কি উচিত কাজ নয় তা বলা হয়েছে। চর্যাপদের মতো বাউলপদেও সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি প্রকৃতি, সামাজিক ভাবদ্যোতক আবৃতকরণ হয়েছে। বাউলের কথার শব্দেই দেহ এবং কণ্ঠের খোঁজ মেলে। সেক্ষেত্রে সেক্সি কথা থাকা জরুরি, তাহলেই কণ্ঠে লালিত্য লাগবে। আর সেখানে যদি দীর্ঘ বড় তালের ব্যবহার হয়, তবে তো কথায় থাকে না… দেহেলী জ্বরে এসে নামে।
সুফিদের পাশাপাশি বাউলরা তাই এই দুইকে মেলাতে তারে সুর ফেলে। পঞ্চভূতের এই নিয়জিত দেহই তখন কণ্ঠের অস্তিত্ব নিয়ে খেলা করে। আলো খেলা, অন্ধকার খেলা। সময়ের তারেই গিয়ে সবাইকে পড়তে হয়।
আরও পড়ুন-কলকাতায় কাগজের গোডাউনে আগুন
বাউলের পদাবলিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় থাকতে পারে দেহতত্ত্ব। প্রথমে নারীদেহ, যা নর আর দ্বিতীয় রজঃ, যা থেকে শুক্রের জ্ঞান। তৃতীয়তে বস্তুরক্ষা, যুগলমিলন বা পারের গান। ঢেলে কুড়ানোই রীতি। তেমনই সুরের খেলায় শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠকে ভাব কুড়াতে হয়। এই ভাবটিই যুগলমিলন।
আরও পড়ুন-যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যু গ্রেফতার প্রাক্তন পড়ুয়া
দেহের মধ্যে বামাঙ্গে নারীসত্তা, দক্ষিণাঙ্গের একই অঙ্গে পুরুষসত্তাগুলি থাকে। নাকে চন্দ্র, নিঃশ্বাসে শীতলতা বা হৃদ্পিণ্ড রক্ত আকর্ষণ করে, ১৬ শিরা রক্তের গতিকে ঊর্ধ্বে আনে। ডান নাকে সূর্য, নিঃশ্বাসে উষ্ণতা, হৃৎপিণ্ড রক্ত বিকর্ষণ করে, আর ১৬ শিরা রক্তের নিম্নগমন করায়।
পুরুষদের থেকে দেহতত্ত্ব ও আত্মসাধনায় বাংলার মহিলা বাউলরা অনেক বেশি শক্তিশালী। তাঁদের আত্মসংযম, আত্মবাক্য এবং আত্মবিস্মরণ ক্ষমতা গৃহীজীবনের যাপন থেকেই শক্তিশালী হয়। বাংলার বীরভূমের সে-যুগের বিখ্যাত মহিলা বাউলদের মধ্যে এই ক্ষমতা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন বীরভূমের আহমদপুরের ফুলমালা দাসী, কেন্দুলীর সুবল দাস ও ললিতা মা। এ-প্রজন্মের পার্বতী দাস বাউল, রীনা দাস বাউল, সহজ মা-রাও কম শক্তিশালী নন, ভাব ও কণ্ঠে। কেন্দুলীর সুবল দাস প্রায় শতবর্ষ পেরিয়ে গেছেন আর ললিতা মা-ও সত্তরোর্ধ্বা। দু’জনেই শক্ত, সমর্থ।
আরও পড়ুন-গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র
চল্লিশ বছরের বহু বেশি তাঁরা কেন্দুলীতে এসেছেন। আশ্রমপল্লির শেষ দিকে টিকরবেতা গ্রামের কাছে, অজয়ের ধারে তাঁদের আশ্রম। দক্ষিণমুখী সে-আশ্রমে রাখা আছে, অনুরাজি মোহন্ত মহারাজের উপবেশনরত একটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। তাঁর নামকে আশ্রয় করেই এই আশ্রম। বর্ধমান জেলার কোটা গ্রামে এই মোহন্তের বড় আশ্রম রয়েছে। অনুরাগী মোহন্ত আশ্রম। বাউল সুবল আর বাউলানি ললিতা দু’জনেই তাঁর শিষ্য-শিষ্যা। দুজনেই বাউল সাধন শিল্পী। পুরনো দিনের বহু আসর মাতিয়েছেন তাঁরা দুজনে। এখনও গান করেন। বহু প্রাচীন পদকর্তাদের পদ তাঁরা করেন। অনুরাগী মোহন্তের গান, লালনের গান, প্যারিদাসের গান, ভবপিতার গান, হাউড়ে গোসাঁই, যাদবেন্দু, রাধেশ্যাম দাস, গোবিন্দ চাঁদ, পদ্মলোচন, নীলকণ্ঠ— সকলের গানের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা। তাঁদের আদি বাড়ি বাঁকুড়ায়। মাধুকরীই তাঁদের জীবিকা। প্রচার-বিমুখ এই বাউল সাধক-সাধিকা মনে করেন বাউলের শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে ব্রহ্মচর্য পালন। ইন্দ্রিয়ের বশে কোনও কাজ নয়, মানুষকে জানাই লক্ষ্য। ছাত্র তো আমরা সবাইগো বাবা, সহাস্যে বলেন ললিতা মা।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েত তৃণমূলের
বীরভূমের আরও এক প্রাচীন মহিলা বাউল ছিলেন আমোদপুরের ফুলমালা দাসী। ১৯৩৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা সুরেন বিশ্বাস। মা সরমা দাসী। স্বামী নিশিকান্ত বিশ্বাসের হাত ধরেই তিনি এপার বাংলার বীরভূমের আমোদপুর গঞ্জে চলে এসেছিলেন। বাউলের বসতি গড়ে তোলেন আমোদপুরের ছোট লাইন পাড়ায়। তাঁর বাউলের মন্ত্র বা দীক্ষাগুরু ছিলেন অজয়পাড়ের সুপুর গ্রামের বাউল দেবেশ দাস। তাঁর কাছে তালিম নিলেও, পরবর্তীতে নিজের আত্মগুণে নিজেকে বাউল সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন তিনি। নিজস্বীর গুণে বিদেশের ‘ভারত উৎসবে’র বাউলমেলায় যাবার সুযোগ হয় তাঁর। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকা, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, দুবাই-সহ ৬টি দেশ, বাউলের মায়াকণ্ঠের জাদুতে ঘুরে আসেন। তারপর থেকেই ফুলমালার খ্যাতি বেড়ে যায়। লন্ডনের বিবিসি থেকেও ফুলমালার গান প্রচারিত হয়েছিল। ফুলমালা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে, হাতে একতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গান করতেন। দীর্ঘায়ু ছিল ফুলমালার সাধনজীবন। ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে আমোদপুরের নিজের বাউল ভিটেতে ফুলমালা দেহ রাখেন।
আরও পড়ুন-সর্বোচ্চ আদালতে জয় নির্বাচন কমিশনের, বাংলায় দল পাঠানো নিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা
শুধু মানুষ কেন! কীট-পতঙ্গকেও শ্রদ্ধা করতে শিখতে হয়, বলেন এ-প্রজন্মের উজ্জ্বল বাউল সাধিকা, গায়ক পার্বতী দাস বাউল। সাদা, কখনও গেরুয়া বসন পরে থাকেন তিনি। আত্মতত্ত্বজ্ঞ সাধিকা তিনি। একসময় তিনি খুব রেডিওর ভক্ত ছিলেন। তিনি নিরামিষ খান। তবে মাছ খান, গুরুর দেখানো পথে। মাছ কৃষ্ণ দরশনে চোখের পাতা ফেলে না। তাই পার্বতী মাছের সঙ্গ করেন। পার্বতীর বাউলনৃত্য ও দেহভঙ্গি দেখার মতো। গায়কিতেও আছে নতুনত্ব। শান্তিনিকেতন থেকে অদূরে কোপাই স্টেশনের একটু আগে, রেলগেট পার হয়ে কামারডাঙা গ্রাম। সেখানেই তাঁর আশ্রম। নির্জনে। প্রথম জয়দেবের লক্ষ্মণ দাস বাউলের সঙ্গে গেছি, তাঁর কাছে। আশ্রমের নাম ‘সনাতন সিদ্ধাশ্রম’। বহু পরে একদিন নাট্যকার মণীশ মিত্রের কথায়, আমার ‘বাউল বাগযন্ত্র বিজ্ঞান’ বইটি দিতে, আমি আর রাখি গেছি। বাইকে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। নিজস্ব আসনে বসে, দেশ-বিদেশের বাউলদের সঙ্গে তিনি গাইছেন আর পড়ুয়াদের বোঝাচ্ছেন আত্ম ও দেহতত্ত্বের গতিপথ। শান্ত অথচ গভীরতা সেই যাপিত জীবনের আলো। আমাকে টেনে রেখেছিল বহুকাল।
আরও পড়ুন-নির্বাচন কমিশন দখলে বাদ প্রধান বিচারপতি!
আরও একদিন গেছি বীরভূমের বোলপুরের রীনা দাস বাউলের বাড়ি। এ-প্রজন্মের তিনিও দেশ-বিদেশ ঘোরা একজন বাউল। তাঁরা পারুলডাঙায় থাকেন। স্বামী দিবাকর বিখ্যাত বাউল। একমাত্র ছেলে পূর্ণেন্দুও বাউল গান করে। রীনার বাবা সুধীর খ্যাপা বাউল, ১০ নভেম্বর ২০২১ সালে দেহ রাখেন। তাঁরও নাম ছিল বাউল-পথে। একমাত্র ভাই গৌতম দাস বাউলের এখন জগৎজোড়া নাম। আজও মা মালতী দাস, পারুলডাঙায় বাউলবাগান বাড়িতে থাকেন, গানজীবন নিয়ে। বহুদূরের দেশ ঘোরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাঁর গর্ব হয়। তবে আত্মতত্ত্বের এই হাওয়ামহলে এখনও, পার্বতী, রীনারা খোঁজে মানুষ-রতনধন!