প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর ইতিহাস থাকে। পাত সাজানো পদের আগে থাকে রান্নাঘরের সমাচার। রাজার কথা পেড়ে বসলে তেমনভাবেই এসে পড়ে তাঁর বংশপরিচয়ের কাহিনি। বংশলতিকা আসলে ব্যক্তিকে বুঝে নেওয়ার আঁতুড়ঘর। এই ঘরই চিনিয়ে দেয় নৃপতির মানসিক গঠনের শিকড়, তাঁর কাজকর্মের পেছনে থাকা মূল্যবোধের মূলটাকে।
আরও পড়ুন-অনলাইনে মিলবে দাবানলের সংকেত
যেমন শ্রীরামচন্দ্রের ইক্ষ্বাকু বংশ আর যুধিষ্ঠিরদের কুরুবংশ। প্রথমটির সঙ্গে যোগ সূর্যের, দ্বিতীয়টির খ্যাতি চন্দ্র সংসর্গে। সূর্যবংশীয়রা জ্যেষ্ঠপুত্রের দোষগুণ বিচার করতেন না। ভাল-মন্দ যাই হোক না কেন, সূর্যবংশের জ্যেষ্ঠপুত্র সর্বদা সিংহাসনের অধিকারী। তাই শ্রীরামচন্দ্র সতত অযোধ্যাপতি হওয়ার ন্যায্য দাবিদার হিসেবে বন্দিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে, চন্দ্রবংশীয় কুরুকুলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার (পড়ুন, জন্মান্ধতার) সুবাদে উপেক্ষিত হয় জ্যেষ্ঠপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের রাজা হওয়ার দাবি। সে ব্যাপারে আদৃত হয়েছে পাণ্ডুর নাম।
এভাবেই বংশলতিকায়, পূর্বজদের আখ্যানে পারিবারিক মূল্যবোধের পরম্পরা গেঁথে থাকে। চিনিয়ে দেয় সেই পরিবারে অন্তর্লীন চলনের সুনির্দিষ্ট সমীকরণ। নবদ্বীপের মহারাজাধিরাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দিল্লির কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে সখ্য নির্মাণের তাগিদে বাংলার স্থানীয় স্বাতন্ত্র্যের প্রতিভূ প্রশাসকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির বংশলতিকায় নিহিত ছিল। সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলছে।
আরও পড়ুন-পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামে তৃণমূল প্রার্থীদের জেতাবেন মহিলারাই : জেলা সভানেত্রী
কৃষ্ণচন্দ্র এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা লিপিবদ্ধ আছে ‘ক্ষিতীশ-বংশাবলি-চরিত’-এ। রচয়িতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। ২৪ বছর কৃষ্ণনগরের রাজাদের দেওয়ান ছিলেন। কর্মজীবনের আরও ১০ বছর তিনি ওই রাজ পরিবারের অপরাপর বিবিধ দায়িত্ব সামলেছেন। এহেন কার্তিকেয়চন্দ্রের লিখিত নথি কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রামাণ্য উপাদান, সন্দেহ নেই।
সেই ‘ক্ষিতীশ-বংশাবলি-চরিত’ জানাচ্ছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের একজন পূর্বপুরুষ হলের কাশীনাথ। কাশীনাথের পূর্বপুরুষ বিশ্বনাথ দিল্লির সম্রাটের অনুগ্রহে বিরাট জমিদারি লাভ করেছিলেন। একবার ত্রিপুরারাজ দিল্লির বাদশাকে হাতি পাঠাচ্ছিলেন ভেট হিসেবে। দিল্লি যাওয়ার সময় হাতিগুলো কাশীনাথের জমিদারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা হাতি খেপে উঠে কাশীনাথের জমিদারির লোকজন মারতে, বাড়িঘর ভাঙতে, খেতের ফসলেরও ক্ষয়ক্ষতি করতে শুরু করল। বেগতিক বুঝে কাশীনাথ সেই পাগলা হাতিটাকে মেরে ফেলার আদেশ দিলেন। বাংলার তৎকালীন নবাব অনেকদিন ধরেই ছুতো খুঁজছিলেন কাশীনাথকে বেকায়দায় ফেলার। দিল্লির বাদশাকে পাঠানো হাতি কাশীনাথের আদেশে মেরে ফেলার তাঁকে পূর্ণমাত্রায় সেই সুযোগ করে দিল। ঘটনাটিকে অতিরঞ্জিত করে, সত্যি-মিথ্যে আরও নানা কথা তার সঙ্গে জুড়ে নবাব এই হস্তী নিধনের খবর পাঠালেন দিল্লিতে।
আরও পড়ুন-ভগবানগোলায় নির্বিঘ্নে মিটল উপনির্বাচন
দিল্লিতে তখন মুঘল শাসন। বাদশা তখন আকবর। তিনি বাংলার নবাবের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে কাশীনাথকে বন্দি করার আদেশ দিলেন। কাশীনাথের কাছেও সেখবর পৌঁছল। বিপদ আসন্ন টের পেয়ে তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে সপরিবারে পালালেন। ক’দিন পর জলঙ্গি নদীর কাছে বাগওয়ান পরগনার আন্দুলিয়া গ্রামে পৌঁছলেন তাঁরা। সেখানে জেলেরা তখন মাছ বিক্রি করছিল। কাশীনাথ এক জেলে বউয়ের হাতে নিজের আংটি দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে আমাকে এখন মাছ দাও। আমার লোকলস্কর পেছন পেছন আসছে। ওদের এই আংটিটি দেখালে ওরা তোমাকে মাছের দাম দিয়ে আংটি ছাড়িয়ে নেবে।’
মাছ কিনে কাশীনাথ নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে পৌঁছে নদীতে নেমে ইষ্টদেবতার আরাধনা করছিলেন। ওদিকে নবাবের সেনাবাহিনীও আন্দুলিয়ায় পৌঁছল। তারা সেখানে আংটি দিয়ে মাছ কেনার খবর পেল। ধরল সেই জেলে বউকে। ভীত-সন্ত্রস্ত জেলে বউ নিরুপায় হয়ে নবাবের সৈন্যদের দেখিয়ে দিল কাশীনাথ কোনদিকে গিয়েছেন। সেনাপতি সহজেই নদীবক্ষে ঈশ্বরার্চনারত কাশীনাথকে গ্রেফতার করে দিল্লির দিকে রওনা দিল।
কার্তিকেয়চন্দ্র রায় জানাচ্ছেন, কাশীনাথের মৃত্যু নিয়ে দুটো মত প্রচলিত আছে। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির ইতিহাস যে সংস্কৃত গ্রন্থে পাওয়া যায়, সেটির নাম ‘ক্ষিতীশ-বংশাবলিচরিতম’। তাতে লেখা আছে, বন্দিদশায় নবাবি সেনাদের হাতে কাশীনাথ নিহত হন। তবে রাজবাড়ির জনশ্রুতি অনুযায়ী, কাশীনাথকে নিয়ে নবাবি ফৌজ দিল্লিতে পৌঁছেছিল। সেখানে কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন-দেশে ২ বছর ধরে বন্ধ কোভিশিল্ড, বিতর্কের মধ্যে বিবৃতি সিরামের
এই কাশীনাথের নাতি ভবানন্দ। ছোটবেলা থেকে মুঘল বাদশার কারণে তাঁর ঠাকুর্দার মৃত্যুর কথা শুনে আসছেন। সেই বাদশার সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি দেখা হল মানসিংহের সৌজন্যে। দিল্লিতে মুঘল বাদশা তখন জাহাঙ্গির। আকবরের পুত্র। ভবানন্দ তখন নবাবের কানুইগুই পদে আসীন। মজুমদার উপাধি পেয়েছেন। ওদিকে দিল্লীশ্বরের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য। বারো ভুঁইয়ার অন্যতম তিনি। জাহাঙ্গিরের বশ্যতা মানতে নারাজ। নিজের কাকা বসন্ত রায়কে হত্যা করেছেন। বসন্ত রায়ের ছেলে প্রাণ বাঁচাতে কচুবনে লুকিয়ে পড়েন। সেই থেকে তাঁর পরিচয় কচু রায়। কচু রায় দিল্লিতে গিয়ে জাহাঙ্গিরের শরণাপন্ন হলেন। প্রতাপাদিত্য ক্রমশ বেলাগাম হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে বাদশা মানসিংহকে পাঠালেন বাংলায়। মানসিংহের সঙ্গে ভবানন্দের দেখা হল বর্ধমানে। সেখান থেকে অগ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ ঘুরে পৌঁছলেন বল্লভপুরে। মানসিংহের নেতৃত্বে মুঘল সেনা ছাউনি ফেলল ভবানন্দের বাড়ির কাছেই।
ভবানন্দের বাড়িতে নিত্য পূজিত হতেন গোবিন্দ। সেদিন ছিল গোবিন্দ-মন্দিরে লক্ষ্মীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করার উৎসব। সেই উপলক্ষে বিরাট খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হয়েছিল ভবানন্দের বাড়িতে। হঠাৎ শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলল টানা সাতদিন। আর এই সাতদিন দু’বেলা মানসিংহের সেনাবাহিনীর খাবারের দায়িত্ব নিলেন ভবানন্দ। আর সেই অবকাশে ভবানন্দের বাড়িঘর দেবদেউল সব ঘুরে ঘুরে দেখে আর তাঁর বংশ পরিচয় জেনে মুগ্ধ মানসিংহ। দুর্যোগ কেটে গেলে মুঘল সেনা যশোহরের উদ্দেশে রওনা দিল। মানসিংহ সঙ্গে নিলেন ভবানন্দকে। আর প্রতিশ্রুতি দিলেন, যদি প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে পারেন তাহলে ভবানন্দ যে উপকার তাঁর করেছেন সেটার প্রতিদান দেবেন।
আরও পড়ুন-গেরুয়া শিবিরের নিজেদের হিসেবেই অশনিসংকেত এসে গিয়েছে বিদায়বেলা
যশোরে প্রতাপাদিত্য মানসিংহের মুঘল বাহিনীর কাছে পরাস্ত হলেন। তাঁকে বন্দি করে খাঁচায় পুরে দিল্লিতে পাঠানো হল। আর, ভবানন্দকে সঙ্গে করে জাহাঙ্গিরের কাছে নিয়ে গেলেন মানসিংহ স্বয়ং। জাহাঙ্গির বাদশাহ সব শুনলেন। ভবানন্দের বংশের ইতিহাস, তাঁর ঠাকুর্দা কাশীনাথের প্রতি সম্রাট আকবরের অবিচার, বাগওয়ানে দুর্যোগের সময় তাঁর অসাধারণ আতিথ্য, যশোরের যুদ্ধে তাঁর সুমন্ত্রণা ইত্যাদি সব কিছু। প্রসন্ন মুঘল বাদশা ভবানন্দকে ১৪টি পরগনার ফরমান দিলেন। সেই ১৪টি পরগনার মধ্যে একটি হল নদিয়া। জাহাঙ্গিরের ফরমান জারি হয়েছিল ১০১৫ হিজরি সন অর্থাৎ ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে।
যে বংশের কাশীনাথ সম্রাট আকবরের আমলে নিগৃহীত হয়েছিলেন সেই বংশেরই ভবানন্দ সম্রাট জাহাঙ্গিরের অনুগ্রহে নদিয়ার সামন্তপ্রভু হয়ে বসলেন। কিন্তু বিধর্মী মুঘল বাদশার দাক্ষিণ্য পাওয়ার জন্য স্বধর্মের প্রতাপাদিত্যর বিরোধিতায় তাঁকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়েছিল। এজন্য ছোটদের খেলার ছড়া ‘ইকির মিকির চাম চিকির’ – এ বাঙালি তাঁকে চেনাল ‘চামে কাটা মজুমদার’ অর্থাৎ বিধর্মীর মতো চামড়াকর্তিত মজুমদার হিসেবে। পরবর্তীকালে বিদেশি শাসকের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য এই চামে কাটা ভবানন্দ মজুমদারের উত্তরপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র রায় স্বদেশের শাসক সিরাজ-উদ-দৌল্লার সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন। তফাত শুধু এই যে ভবানন্দের ক্ষেত্রে অনুগ্রহ প্রদানকারী ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী আর ভবানন্দ যাঁর বিরোধিতা করেছিলেন তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা হিন্দু। কৃষ্ণচন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুগ্রহ প্রদানকারী শক্তি ছিল বিদেশি তবে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। আর, কৃষ্ণচন্দ্র যাঁর বিরোধিতা করেছিলেন তিনি স্বাধীনচেতা হলেও ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান ছিলেন।
আরও পড়ুন-সন্দেশখালি চক্রান্ত, নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ তৃণমূলের
নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতো কেউ কেউ বলেছেন, প্রতাপাদিত্যের পতনে মানসিংহকে সাহায্য করে ভবানন্দের জমিদারি লাভের কথা মিথ্যা। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, ভবানন্দকে সম্রাট জাহাঙ্গির যে দুটি ফরমান দিয়েছিলেন, সে দুটির কোনওটাতেই প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে ভবানন্দের সাহায্যের কথা উল্লিখিত হয়নি। ১৩৪৫-এর ‘প্রবাসী’ প্রত্রিকার বৈশাখ সংখ্যা, ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকার কার্তিক, ১৩৪১ সংখ্যা, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার ১৩৩৯-এর ফাল্গুন সংখ্যা প্রভৃতি নানা পত্রপত্রিকায় এই মত প্রকাশিত ও সমর্থিত হয়েছে।
কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্ন আছে। ভবানন্দ মজুমদার যদি জাহাঙ্গিরকে প্রতাপাদিত্য-দমনে সাহায্য না-ই করে থাকেন, তাহলে তাঁকে বাদশা পরগনাগুলো দিলেন কেন? নিছক বন্ধুত্বের খাতিরে? দু’জনের মধ্যে এমন কোনও সম্পর্কের কথা তো ইতিহাসে নেই।
একই কথা ভবানন্দের উত্তরসূরি কৃষ্ণচন্দ্র-ইংরেজ-সিরাজ পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
রজতকান্ত রায় তাঁর ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ’ গ্রন্থে স্পষ্ট লিখেছেন, ‘নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তলে তলে ইংরাজদের সাহায্য করেছিলেন।’ বিষয়টা বিশদে বর্ণিত হয়েছে কুমুথনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া-কাহিনী’তে। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। সেখানে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার বিবাদ যখন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন ‘এই সুযোগ অবলম্বন করিয়া নবাবের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীগণ ইংরাজগণের সহায়তায় নবাবকে পদচ্যুত করিয়া মিরজাফরকে সিংহাসন দেওয়াইবার পরামর্শ করিতে লাগিলেন।’
আরও পড়ুন-ভারী বৃষ্টিতে হড়পা বান আফগানিস্তানে, মৃত্যু তিনশোরও বেশি!
সেখানেই, কোনও নির্দিষ্ট নথির ভিত্তিতে নয়, জনশ্রুতির সুবাদে, লেখক কুমুথনাথ জানাচ্ছেন, মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের বাড়িতে এই গোপন সভাটি বসে। আর সেসময় নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সপরিবারে ভৃত্যদের নিয়ে কৃষ্ণনগর থেকে ১৬ মাইল দূরে শিবনিবাসে থাকছিলেন। সেই গোপন সভায় যোগ দিয়েছিলেন মিরজাফর, জগৎ শেঠ, দুর্লভরাম, রামনারায়ণ, রাজবল্লভ, কৃষ্ণদাস প্রমুখ। চিঠি দিয়ে তাঁরা কৃষ্ণচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন। সেই চিঠির মর্মার্থ একটাই। নবাবের অত্যাচারে মুর্শিদাবাদের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে তৈরি। নবাব কারও কোনও কথা শোনেন না। ‘এবিষয়ে কী কর্তব্য আমরা বুঝিতে না পারিয়া আপনাকে আহ্বান করিতেছি। আপনি শীঘ্র আসিবেন।’
চিঠি পেয়ে রাতের বেলা মন্ত্রী কালীপ্রসাদ সিংহ-সহ অন্যান্য বিশ্বস্ত অমাত্যদের ডেকে পাঠালেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেখানে ঠিক হল, প্রথমেই কৃষ্ণচন্দ্র যাবেন না, বৈঠকে যোগ দেবেন কালীপ্রসাদ। কালীপ্রসাদ মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে এসে যেমন খবরাখবর দিলেন, সেসব শুনে ষড়যন্ত্রকারীদের পরের বৈঠকে যোগ দিলেন স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র। সেখানে কোনও কোনও ষড়যন্ত্রকারী বললেন, মুসলমান সিরাজকে সরিয়ে হিন্দুরাজাকে বাংলার শাসকের পদে বসানো হোক। কৃষ্ণচন্দ্র সেই প্রস্তাবে সায় দিলেন না। বললেন, নবাবের সেনাপতি যেহেতু আমাদের পক্ষেই আছেন, সেহেতু নতুন করে ক্ষমতা অর্জনকারী শক্তি ইংরেজদের সাহায্যে আমরা সহজেই নবাব সিরাজকে মসনদচ্যুত করতে পারব। ‘বিশেষত ইংরেজগণের সহিত আমার সদ্ভাব আছে, সুতরাং এবিষয়ে আমি বিশেষ চেষ্টা করিতে পারিব।’
আরও পড়ুন-ভারী বৃষ্টিতে হড়পা বান আফগানিস্তানে, মৃত্যু তিনশোরও বেশি!
বহু বাগবিতণ্ডার পর উপস্থিত সবাই কৃষ্ণচন্দ্রের কথাটাই মেনে নেয়। ‘নদীয়া-কাহিনি’তে কুমুথনাথ লিখছেন, ‘কোনও কাগজপত্র প্রকাশ না থাকিলেও ইহা বাংলার জনসাধারণের বিশ্বাস যে স্বয়ং রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কালীঘাটে মায়ের পূজা দিবার ছলে কলিকাতায় গমনপূর্বক ইংরাজদিগের সহিত পরামর্শ করিয়া এবিষয়ে কর্তব্য নির্ধারণ করেন।’
ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে সখ্য কিংবা শত্রুতা না-থাকা সত্ত্বেও স্রেফ আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুঘলদের সাহায্য করেছিলেন। একইভাবে, নবাব সিরাজের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত কিংবা মিত্রতা না-থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেজন্য তাঁকে ‘চামে কাটা’ নামে চিহ্নিত না করলেও বাঙালি নাট্যকার কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। কোনওরকম ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই, স্রেফ জনশ্রুতিকে আশ্রয় করে বাঙালি সাহিত্যিক লিখেছেন, ইংরেজদের সাহায্য করার জন্য রানি ভবানী কৃষ্ণচন্দ্রকে সদুপদেশদানের ছলে শাঁখা–সিঁদুর উপহার পাঠিয়েছিলেন৷
ব্রিটিশদের সাহায্য করার বাইরে, রাজা হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র কেমন ছিলেন?
লর্ড ক্লাইভের দুই সাহায্যকারী, কলকাতায় রাজা নবকৃষ্ণদেব আর কৃষ্ণনগরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় জাঁকজমক করে দুর্গোৎসব চালু করেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় পরিষ্কার লিখেছেন, ‘দুর্গোৎসব বাংলাদেশের পরব, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে এর নাম-গন্ধও নাই, বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল হতেই বাংলায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।’ পলাশির যুদ্ধের প্রায় একশো বছরের মধ্যে হুতোমের নকশা প্রকাশিত হয়। সুতরাং সেটির সাক্ষ্য এই ব্যাপারে আদৌ উপেক্ষণীয় নয়।
কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাপুজোয় বিখ্যাত নর্তকী নিকির নূপুরে উঠত ঝড় আর রাতভর চলত মদিরার ফোয়ারা৷ নিকিকে কৃষ্ণনগরে আনার জন্য কলকাতার নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতেও ইতস্তত করতেন না কৃষ্ণচন্দ্র৷
আরও পড়ুন-মোদিবাবু এবার তুমি ভোকাট্টা হবে, দুর্যোধন-দুঃশাসনের থেকেও ভয়ঙ্কর এই বিজেপি : মুখ্যমন্ত্রী
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আজীবন অমিতব্যয়ী রাজা ছিলেন৷ আয় অনুযায়ী ব্যয়ের কিংবা দেনা শোধের ইচ্ছা, কোনওদিনই তাঁর ছিল না৷ একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে৷
১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদে বসলেন নবাব আলিবর্দি খাঁ৷ নজরানা বাবদ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে তিনি দাবি করলেন ১২ লক্ষ টাকা৷ ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র যখন নদিয়ার সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বাবা রামজীবনের নবাবের কাছে দেনা ছিল ১০ লক্ষ টাকা৷ রাজ সিংহাসনে বসার সময় এই দেনার ভার এসে পড়ল কৃষ্ণচন্দ্রের ঘাড়ে৷ ১৭২৮ থেকে ১৭৪০, এই ১২ বছরে পিতৃঋণের কানাকড়িও শোধ করেননি কৃষ্ণচন্দ্র৷ আলিবর্দি সিংহাসনে আসীন হয়ে আদেশ জারি করলেন, হয় ওই ২২ লক্ষ (১২ লক্ষ + ১০ লক্ষ) টাকা মেটাও, নয় কয়েদ করব৷ সেসময় কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বের আয় ছিল প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা৷ আর ওই ঋণ পরিশোধের বার্ষিক কিস্তি ছিল মাত্র ২৫ হাজার টাকা৷ তাও ১২ বছরে ধার মেটানো যায়নি৷ টাকা দিতে না পারায় কারারুদ্ধ হলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র৷
কৃষ্ণচন্দ্র যখন আলিবর্দি খাঁয়ের কারাগারে বন্দি, সে সময়ে নাকি দেবী অন্নপূর্ণা স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে মূর্তি পূজার উপদেশ দেন৷ ‘চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী নিশায়, করিহ আমার পূজা বিধি–ব্যবস্থায়৷’ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েই কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় অন্নপূর্ণার মূর্তি পূজার প্রচলন করেন৷
একইভাবে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলনও কৃষ্ণচন্দ্রই করেছিলেন৷ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী উপাসনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন৷ তিনিই এই পূজা বাংলায় চালাইয়া যান৷’ পাঁচকড়ি আরও লিখেছেন, জগদ্ধাত্রী পূজার সৌজন্যে ‘বাঙ্গলার শাক্তগৃহে মদের স্রোত মন্থর হইয়াছিল, স্বেচ্ছাচার সংযত হইয়াছিল, বৌদ্ধতন্ত্রের উৎকট ব্যাপার সকল একেবারে উঠিয়া গিয়াছিল৷’
আরও পড়ুন-বোসের পাশে বসাও পাপ, ডাকলেও রাজভবনে যাব না, ইস্তফা দিন রাজ্যপাল
পলাশির ষড়যন্ত্র সফল হয়েছিল বটে, তবে নথিপত্র বলছে, পলাশির যুদ্ধের পর থেকে এইসব ধর্মকর্মের অগ্রনায়ক কৃষ্ণচন্দ্র আজীবন ঋণভারে জর্জরিত ছিলেন৷ ঈশ্বরের অনুগ্রহ সেবিষয়ে তিনি পাননি।
এত ধর্মকর্ম পূজা-অর্চনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে কৃষ্ণচন্দ্রের পরধনের প্রতি লোভ কম ছিল, এমনটা নয়৷ কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ‘ক্ষিতীশ–বংশাবলি–চরিত’–এ লিখে গিয়েছেন, কৃষ্ণচন্দ্র গায়ের জোরে জমি দখল করতেন৷ জমি ঠকিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন৷ এবিষয়ে কতিপয় প্রামাণ্য ঘটনা।
হোগলকুড়িয়া, সিমলা, মৃজাপুর, বেনিয়াপুকুর, পাগলাডাঙা, ট্যাংরা প্রভৃতি আজকের কলকাতার নানা স্থানাদি সেদিন ছিল এক-একটা গ্রাম৷ এই গ্রামগুলোর জমিদার ছিলেন রসিক মল্লিক আর নূরজী মল্লিক নামে দুই মুসলমান ভাই৷ পলাশির যুদ্ধের তিন বছর আগেকার ঘটনা৷ ৮ অগাস্ট, ১৭৯৪৷ কলকাতার কালেক্টর হলওয়েল ২,২৮১ টাকা দিয়ে ওই জমিগুলোর পাট্টা দুই ভাইয়ের কাছ থেকে লিখিয়ে নেন৷ ইংরেজরা যখন ট্যাংরার জমি দখল করতে উদ্যোগী হয়, তখন আপত্তি জানান কৃষ্ণচন্দ্র৷ তাঁর দাবি, নূরজী মল্লিকের কাছ থেকে ওই জমি তিনি আগেই কিনেছেন৷ এই মর্মে পাট্টাও দেখান তিনি৷ কোম্পানি ওই পাট্টা জাল বলে অগ্রাহ্য করে৷ কারণ, নূরজী মল্লিক ১৫ বছর আগে মারা গিয়েছেন, আর কৃষ্ণচন্দ্রের দেখানো পাট্টার তারিখ মোটে নয় মাস আগেকার৷
নবাব আলিবর্দির সময় হুগলি–বংশবাটির রাজা গোবিন্দদেব প্রয়াত হলেন৷ আলিবর্দি গোবিন্দদেবের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেন৷ রাজ্য দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল৷ একটি ভাগ গ্রাস করলেন বর্ধমানের রাজা৷ আর একটি অংশ নিজের ছেলে শম্ভুচন্দ্রের তালুকে ঢুকিয়ে নিলেন কৃষ্ণচন্দ্র৷ গোবিন্দদেব রায়ের ছেলে নৃসিংহদেব নিজে একথা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গিয়েছেন৷ বাঁশবেড়িয়ার ইতিহাস প্রসিদ্ধ হংসেশ্বরী মন্দিরের নির্মাতা এই নৃসিংহদেব৷
পলাশির ষড়যন্ত্রে জড়িত কৃষ্ণচন্দ্রের অন্তিম দশার কথা লিখেছেন রজতকান্ত রায়৷ কৃষ্ণচন্দ্র যে বাংলার মসনদ থেকে সিরাজ–উদ–দৌল্লাকে সরাতে ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন, ক্ষমতালাভের পর ‘ইংরাজদের সে সব স্মরণ রইল না৷’ তাদের তিন কোটি টাকার দাবি মেটাতে মিরজাফর লিখে দিলেন, নদিয়া জমিদারির খাজনা মুর্শিদাবাদে না এসে ইংরেজদের ‘তনখা’ হয়ে সোজা কলকাতায় যাবে৷ রজতকান্ত জানাচ্ছেন, ‘(সেই) টাকা আদায় করবার জন্য ইংরাজরা কৃষ্ণচন্দ্রকে অশেষ উৎপীড়ন করল৷ এমনকী সনাতন হিন্দু সমাজের ধারক ও বাহক এই রাজার জাতিনাশ করবার ভয় দেখাল৷ বুড়ো বয়সে তাঁর জমিদারি অপরিমেয় ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ল৷ রাজা মারা যাওয়ার পর তাঁর বংশধরেরা সে জমিদারি রক্ষা করতে পারলেন না৷ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইনে প্রায় সব নিলাম হয়ে গেল৷’
আরও পড়ুন-বোসের পাশে বসাও পাপ, ডাকলেও রাজভবনে যাব না, ইস্তফা দিন রাজ্যপাল
এই যে রজতকান্ত কৃষ্ণচন্দ্রকে ‘সনাতন হিন্দু সমাজের ধারক ও বাহক’ বলছেন, তার বিশেষ কারণ আছে৷
পলাশির ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম রাজবল্লভ৷ তিনি বঙ্গ, বারেন্দ্র ও পূর্বকুল সমাজের বৈদ্যদের উপবীত (পৈতা) প্রথা ফের চালু করার চেষ্টা করেন৷ হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহেরও চেষ্টা করেন তিনি৷ রক্ষণশীলতার সমর্থক কৃষ্ণচন্দ্র এসব সামাজিক সংস্কারের বিরোধিতা করতে দ্বিধা করেননি৷
রাজার কথা বলতে গেলে রানির কথা এসে পড়বেই৷ কৃষ্ণচন্দ্রের ছিলেন দুই রানি। দ্বিতীয় পত্নীর পাণি গ্রহণের পর বাসর রাত্রির কাহিনি৷ নববধূ রূপার পালংকে শায়িতা৷ তিনি কুলীন বংশীয়া৷ রাজা কেশরকুনি বংশীয়, কৌলীন্যে শ্বশুরবাড়ির তুলনায় খাটো৷ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রানিকে বললেন, দ্যাখো! তোমার বাবা আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়েছেন বলে তুমি আজ রুপোর পালংকে শুতে পাচ্ছ৷ তেজস্বিণী রাজমহিষী উত্তর দিলেন, আর একটু উত্তরে গেলে সোনার খাটে শুতে পারতাম৷
অর্থাৎ, ছোট রানির বাবা বড় কুলীন হয়ে যখন কেশরকুনিকে মেয়ে দিলেন, তখন আর একটু হীনতা স্বীকার করে যদি মুর্শিদাবাদের মুসলমান নবাবের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতেন, তবে রানি সোনার পালংকে শুতে পারতেন৷
আরও পড়ুন-শাহরুখই সেরা মালিক, বিতর্কের আবহে গম্ভীর
ভোটের বাজারে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির এক বধূ যখন কৃষ্ণচন্দ্রকে মহামানব, মহান সমাজসংস্কারক রূপে তুলে ধরতে প্রয়াসী আর ইতিহাস না–পড়ে, না–জেনে গেরুয়া দলের প্রচারমন্ত্রী যখন সেই দাবির পক্ষে ধুয়ো তুলছেন, তখন মিথ–মিথ্যের জট ছড়িয়ে সত্যিকার ইতিহাস পুরুষটিকে চিনে বুঝে জেনে নেওয়া দরকার৷
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিঃসন্দেহে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এক প্রবাদ–পুরুষ৷ কিন্তু আর্থিক চিন্তায় তাঁকে সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে৷ হিন্দু সমাজের কুসংস্কারগুলো দূরীকরণে যে কাঙ্ক্ষিত প্রগতিশীল ভূমিকা তিনি নিতে পারতেন, সেটা তিনি নেননি৷ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া, দেনা শোধ না করা, জমি ঠকিয়ে নেওয়া, অমিতব্যয়িতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, সুরাসক্তি, এসব তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রকে কলুষিত করেছে, এসব বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷
আসলে, ‘চামে কাটা’ মজুমদারের উত্তরপুরুষ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কোনওদিন যুগধর্মের বেড়া কাটিয়ে ওপরে উঠতে পারেননি৷ তিনি ছিলেন তাঁর যুগেরই সন্তান৷ এটা অস্বীকারের সুযোগ ইতিহাস দেয় না।

