কবিরা লিখে গেছেন— ‘আর সব কিছু ভাগ হয়ে যাবে, ভাগ হবে না কো নজরুল।’
আজ আমরা যে প্রশ্নের মুখোমুখি তা হল— নজরুল কি সত্যিই ভাগ হলেন না?
এক কথায় উত্তর, নজরুল নিজে শুধু অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা না, উনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ। আশালতা সেনগুপ্তের সঙ্গে ওঁর প্রণয় ও পরিণয়। আশালতা বিয়ের পরে প্রমীলা দেবী নামে পরিচিত হবেন, বিয়ের পরে স্বামীর ধর্মে ধর্মান্তরিত হবেন না। এমনকী সন্তানদের নামকরণেও রয়েছে একধরনের সম্প্রীতির চেতনা। নিজের চার সন্তানের নাম রাখেন যথাক্রমে— কৃষ্ণ মহম্মদ, অরিন্দম খালেদ বুলবুল, কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
আরও পড়ুন-গুগল ম্যাপে ভরসা, গাড়ি গেল মাঝ নদীতে
১৯১৭ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরই ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার হিসাবে কাজ করেন নজরুল। রেজিমেন্টটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি সেনার কাজে ইস্তফা দেন। ব্রিটিশ সেনার হয়ে কাজ করবার অব্যবহিত পরেই তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম ধরছেন, পথে নামছেন, এমনকী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করছেন।
১৯২১ সাল নাগাদ অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন নজরুল। অসহযোগ আন্দোলনের পন্থা ও খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে তিনি সহমত ছিলেন না, তবুও তিনি জড়িয়ে পড়েন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্ব দিতে।
নজরুল খিদে মেটানোর প্রয়োজন থেকে ভিনধর্মের বিষয় নিয়ে পরিণত চেতনা গড়ে উঠবার আগে থেকেই যখন লেখালেখি শুরু করছেন, তখন তা প্রত্যক্ষত তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার নির্মাণে সহায়তা করেছে। দ্বিতীয়ত, অনটন তাঁকে সাম্রাজ্যবাদের সেনাশিবিরে ভিড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, তিনি সেই জীবন এগিয়ে নিয়ে যাননি, প্রথম যে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই ট্রেন থেকে নেমে ভিন্ন লাইন ধরেছেন, সাম্রাজ্যবাদী চেতনা তাকে গ্রাস করতে অক্ষম শুধু হয়নি, তাকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিই বিরূপ করে তুলেছে। ঘাঁটলে বরং দেখা যাবে, সেনাজীবনের তিন বছর তিনি নিজের সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চার ট্রেনিং করে গেছেন কেবল! নজরুল শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমান বা সর্বধর্মসমন্বয় বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাটুকু বলে থেমে যাননি। তিনি যেকোনো ধর্মেরই, এমনকী নিজধর্মেরও গোঁড়ামি, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বারংবার তোপ দেগেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ হতে গিয়ে ধর্মের যাবতীয় কু-আচার সহিষ্ণু হয়ে যাননি।
আরও পড়ুন-রেমাল মোকাবিলায় এবার প্রস্তুত নবান্ন
নজরুল ৩০০র বেশি ইসলামি গান লিখেছেন। ‘ওরে ও মদিনা বলতে পারিস কোন সে পথে তোর/ খেলত ধূলা-মাটি নিয়ে মা ফাতেমা মোর।’ ইসলামের ভিতরকার ভক্তি, আবেগকে পুঁজি করে অসংখ্য গান লিখেছেন এরকম। তবে তা শুধু নিবেদনমূলক হয়েই থেমে থাকেনি। ইসলাম যে সাম্যের ইঙ্গিত দেয় নজরুল সেই সাম্যকেই তার গানে প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করব ‘ঈদের চাঁদ’ গানের কথা। ‘সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা;/ মোদের হিস্সা আদায় করিতে ঈদে দিল হুকুম আল্লাতালা!/… নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই–/ জুলুমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই!/ এক আল্লার সৃষ্ট সবাই, এক সেই বিচারক,/ তাঁর সে লীলার বিচার করিবে কোন ধার্মিক বক?/ বকিতে দিব না বকাসুরে আর, ঠাসিয়া ধরিব টুঁটি/ এই ভেদ-জ্ঞানে হারায়েছি মোরা ক্ষুধার অন্ন রুটি।’ আবার সেই নজরুলই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করতে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন।
আর নজরুল স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা,/ ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক মানবের একই রক্ত মেশা/ কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!’ এই মানবিক আবেদন এখন এতটা সোচ্চারে বলব এই বুকের জোর আমাদের দেশে এখন অপস্রিয়মাণ।
আরও পড়ুন-রেমাল মোকাবিলায় এবার প্রস্তুত নবান্ন
‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে উনি লিখতে পেরেছেন : ‘ইহারা ধর্মমাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।’ এই কথা আজ কেউ বললে হয়ত গঙ্গায় তুফান উঠে যেত। এখন খানিকটা আমাদেরই দায়িত্ব হওয়া উচিত এই উচ্চারণের দ্যোতনা জিইয়ে রাখা।
নিজের সম্পর্কে কী বলতেন নজরুল, যাঁকে আমরা বিদ্রোহী কবি বলতে ভালবাসি?
“আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনওদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি— অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনওটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনও বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ। মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।”
মৌলবাদী দানবদের তাণ্ডবে আজ যখন ভারতাত্মা বারবার শিউরে উঠছে, তখন নজরুলের ভাষাই হোক আমাদের ভাষ্য, ‘মানবতার এই মহান যুগে একবার/ গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে,/ তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও,/ তুমি মানুষ- তুমি ধ্রুব সত্য।’