পালান

১৯৮২ সালে কিংবদন্তি পরিচালক মৃণাল সেনের আলোড়ন তোলা ছবি ‘খারিজ’। মধ্যবিত্তের আবেগ, অসহায়তা, সংকটের লেখচিত্র ছিল ছবিটি। এর ঠিক চার দশক পরে ২০২৩-এ সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘পালান’। টাইম ফ্রেমে চল্লিশটা বছর পার করে একই পরিবার, একই নাম, পরিচয় নিয়ে নতুন মোড়কে। ছবিটিকে সিক্যুয়েল মনে হলেও পরিচালক নিজে সেটা দাবি করেন না। ‘পালান’ স্বতন্ত্র, এক গভীর উপলব্ধির ছবি। মধ্যবিত্তের বিপন্নতার, প্রাত্যহিক ক্ষয়িষ্ণুতার, আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের গল্প। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল— শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া তিন পরিচালক। কয়েকটি ছবি বাদ দিলে ঋত্বিকের প্রায় সব ছবির কেন্দ্রেই রয়েছে দেশভাগ। আবার সত্যজিতের ছবিতে দেখা মিলেছে নিটোল, নান্দনিক উৎকর্ষের। খুব নিঁখুত পরিচালক ছিলেন সত্যজিৎ। এই ত্রয়ীর মধ্যে মৃণাল সেনই একমাত্র পরিচালক যাঁর চলচ্চিত্র বারবার দর্শককে অস্থির করেছে, অস্বস্তি এবং অতৃপ্তি দিয়েছে।
১৯৮২ সালে তাঁর পরিচালিত ছবি ‘খারিজ’ ছিল তেমনই একটি ছবি। বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে এই ছবিটি। মূল কাহিনিকার রমাপদ চৌধুরী। তাঁর কোনও ছবিতেই বড়সড় কোনও পরিবর্তনের কথা বলেননি পরিচালক মৃণাল সেন বরং মধ্যবিত্তের চিন্তার পরিসরকে আর একটু বড় করতে বলেছেন সবসময়। অনেক ছবিতেই মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখানেই তাঁর মিল। মাটির গন্ধ মিশে থাকে তাঁদের দুজনের ছবিতেই। জীবনকে রিলেট করা যায় সহজেই। সেই মৃণাল সেন এবং রমাপদ চৌধুরী শতবর্ষে তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে ‘খারিজ’-এর অনুপ্রেরণায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘পালান’ (Palan)। এই ছবি এক অর্থে সিক্যুয়েল আবার অন্য অর্থে কো-ইন্সিডেন্টও। কারণ হল ফেলে আসা চল্লিশ বছরকে তিনি সুন্দর মিলিয়েছেন বর্তমানের সঙ্গে। রেখেছেন সেই একই পরিবার, একই নাম, একই পরিচয়। শুধুমাত্র সময়ের পরিবর্তনের ছাপ ফেলেছেন চরিত্রগুলিতে। আবার কো-ইন্সিডেন্ট এই কারণে যে ‘খারিজ’ ছবিতে অঞ্জন আর মমতা সেনের বাড়ির কাজের ছেলেটি স্থানাভাবে রান্নাঘরে ঘুমিয়ে মারা গেল। মারা যাওয়ার কারণ, রান্নাঘরের বদ্ধ পরিস্থিতিতে কার্বন মনোক্সাইডের বিষ। কৌশিক নিজে বলেছেন, যখন তিনি প্রথম ‘খারিজ’ দেখেন, তখন তিনি না চিনতেন মৃণাল সেনকে, না জানতেন কার্বন মনোক্সাইড। কিন্তু এই না-জানা রহস্য থেকেও পালাতে পারেননি পরিচালক। যে-মূল ভাবনা থেকে ডালপালা ছড়াল ‘পালান’ তা হল একটি পরিস্থিতি, যা কোনও ছবিরই বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
ছবির ট্রেলার লঞ্চের পর দেখা গিয়েছিল প্রথম দৃশ্যেই সেই ১৯৮২ সালের সূত্র। প্রথম দৃশ্যেই অঞ্জন দত্তের কণ্ঠে শোনা গেছিল সেই বাড়ির ভূমিকা। যে বাড়িতে ভেন্টিলেশনের অভাবে মারা যায় পালান। সেই বাড়িতেই বাস অঞ্জন ও মমতা সেনের।
১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘খারিজ’-এর চরিত্রগুলিকে ২০২২-’২৩-এর প্রেক্ষাপটে এনে চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন কৌশিক। সেই ছবিতে যাঁরা তখন অভিনয় করেছিলেন মূল চরিত্রে তাঁরা তো রয়েছেনই এ ছাড়া রয়েছেন বেশ কিছু নতুন মুখও।

আরও পড়ুন- ক্রিকেট বিশ্বকাপেই বদলা নেব হরদীপ হত্যার, খালিস্তানি হুমকি

পুরনো বাড়ি, ভগ্নপ্রায় দেওয়াল। যেকোনও মুহূর্ত ভেঙে পড়তে পারে বাড়ির যেকোনও অংশ। তবুও ১২/১সি নম্বরের ভাঙচোরা পুরনো বাড়িতেই অতীত স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে রয়েছেন বৃদ্ধ দম্পতি অঞ্জন সেন এবং মমতা সেন। তাঁদের কাছে সেই স্মৃতি সবকিছুর চেয়ে দামি। পৈর্তৃক ভিটের প্রতি ভালবাসা এবং মূল্যবোধ খুব গভীর। সেই বাড়ির আনাচ-কানাচে লুকিয়ে রয়েছে প্রথম দাম্পত্য, প্রথম গার্হস্থ্যের সমীকরণ। পুত্র পুপাই (অভিনেতা যিশু সেনগুপ্ত) এবং পুত্রবধূ পাওলি (পাওলি দাম) অন্যত্র থাকলেও বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্কের রসায়ন মন্দ নয়। এরই মাঝে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা সেই পুরনো বাড়ির কার্নিসের একটি অংশ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয় নিচের তলার এক বাসিন্দার। কলকাতা পুরসভা বাড়িটিকে ইতিমধ্যেই বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। চাঙড় ভেঙে পড়ে যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে যে কোনও অঘটন। তাই ছেড়ে যেতে হবে সেই বাড়ি যার প্রতিটি কোণায় রয়েছে যে সুখ-দুঃখের হাজারো স্মৃতি। যে-স্মৃতিটুকু আমৃত্যু আগলে রাখতে চেয়েছিলেন বৃদ্ধ দম্পতি। আর তা নিয়েই বিবাদ। এই বিবাদের জেরে আরও জটিল হয়ে উঠছে সম্পর্কের সমীকরণগুলি। শেষরক্ষা হয়নি একরাশ যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে ওই বাড়ি ছাড়লেন তাঁরা। সেই যন্ত্রণা, আত্মমর্যাদার লড়াই, করুণ আর্তি, অস্বস্তি, সেই বিঘ্নিত তৃপ্তিকে ‘পালান’-এ (Palan) ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি প্রসঙ্গে পরিচালক জানালেন, ‘খারিজ’-এর অনুপ্রেরণায় ছবিটি তৈরি হলেও এর সঙ্গে ‘পালান’ (Palan) ছবির গল্পের কোনও মিল নেই। সময় বদলেছে কিন্তু সমস্যা বদলায়নি। অঞ্জন সেন, মমতা সেনের বয়স বেড়েছে। এদের জন্য আমার চিন্তা হয়। বলতে পারেন সেই চিন্তা থেকেও এই ছবি৷
বাড়িটি বিপজ্জনক এই ঘোষণার পর থেকেই অঞ্জন-মমতার কানে বাজতে থাকে ‘পালান, পালান, পালান…।’ সেই বাড়িকে ঘিরে তৈরি আবেগ, সন্তানের দুশ্চিন্তা কোথায় রাখা হবে বাবা-মাকে এটাই মূল ছবির বিষয়বস্তু। শহরে আধুনিক নতুন বাড়িগুলোর মাঝে পুরোনো বাড়িগুলোর মতোই একা হয়ে যাওয়া এক পরিবারের কাহিনি উঠে এসেছে এই ছবিতে।

চার দশক আগের জুটি অঞ্জন দত্ত আর মমতাশঙ্কর ছাড়াও ছবিতে অভিনয় করেছেন শ্রীলা মজুমদার, পাওলি দাম, যিশু সেনগুপ্ত, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। ছবির প্রযোজক প্রতীক চক্রবর্তী। অঞ্জন দত্ত এবং মমতাশঙ্কর দুজনেই এই ছবির প্রাণ। যিশু এবং পাওলি সাবলীল। শ্রীলার অভিনয় একেবারেই মৃণাল-ঘরানার। দেবপ্রতিমের বলিষ্ঠ অভিনয় এই ছবির সম্পদ। মৃণাল সেনের ‘খারিজ’-এ শিশুশিল্পী হরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। সেই অভিনেতাকেও এখানে ফিরিয়েছেন পরিচালক। এই ছবির প্রমোশনাল গান ‘আমি আর ও’ গেয়েছেন ইন্দ্রনীল সেন। গানটি লিখেছেন স্বয়ং পরিচালক। বাবার লেখা গানকে সুরে বেঁধেছেন পুত্র উজান। মিউজিক প্রোডাকশনের দায়িত্বে রয়েছেন দেবায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁরা ‘খারিজ’ দেখেননি তাঁদের কাছে পালান এক স্বতন্ত্র উপলব্ধির ছবি। আবার যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝবেন প্রতিটি চরিত্রকে পরতে পরতে কৌশিক কত সুন্দর এঁকেছেন। দর্শক-মনে অনুরণন তুলবে ‘পালান’ (Palan) তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Latest article