পার্কিনসন কী
যেটা আমাদের মস্তিষ্কের দু’দিকে থাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাকে বলে বেসাল গ্যাংলিয়া। হাত পা নাড়ানো, কথা বলা, ঘাড় নাড়া ইত্যাদি অর্থাৎ আমাদের সাব-কনশাস মোটর অ্যাক্টিভিটিকে যে কোনও ধরনের বাধাবিঘ্ন ছাড়াই একদম স্বাভাবিক রাখা এই বেসাল গ্যাংলিয়ার কাজ। শুধু তাই নয়, আমি যতটা ডিগ্রি হাত নাড়াতে চাইছি ততটাই নাড়াতে পারছি বা পা নাড়াতে পারছি এই কাজটাও সম্পন্ন করে বেসাল গ্যাংলিয়া। এই বেসাল গ্যাংলিয়ার সার্কিট এবং সংযোগের বা কানেকশনের মধ্যে কোনও গন্ডগোল হলেই পার্কিনসন রোগটি হয়। আর বেসাল গ্যাংলিয়ার সার্কিটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমোন বা নিউরো ট্রান্সমিটার হল ডোপামিন। ডোপামিন হরমোন বেসাল গ্যাংলিয়ার সার্কিটের কার্যকারিতার আসল কান্ডারি। মানবদেহে ডোপামিনের মাত্রা হ্রাস পেলে এবং বেসাল গ্যাংলিয়ার সার্কিট ঠিকমতো কাজ না করলে শুরু হয় পার্কিনসন।
আরও পড়ুন-ধানবাদের জনবহুল রাস্তায় ডাকাতদের হামলা, পুলিশের পাল্টা গুলিতে মৃত ১, গ্রেফতার ২
শ্রেণিবিন্যাস
ইডিওপ্যাথিক পার্কিনসনিজম (আইপিডি) বা ক্লাসিক্যাল পার্কিনসন ডিজিজ। এটা মূলত বয়সোজনিত কারণে হয় বা নির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়াও দেখা দিতে পারে। সাধারণত পঞ্চাশ বছরের ঊর্ধ্বে হয় আইপিডি।
দ্বিতীয়টি হল সেকেন্ডারি পার্কিনসনিজম। এক্ষেত্রে অন্য বহিরাগত কোনও কারণে এই বেসাল গ্যাংলিয়ার সার্কিট নষ্ট হয় বা ডিজেনারেটেড হয়।
তৃতীয় হল কিছু ওষুধ রয়েছে যা দীর্ঘদিন খাওয়ার ফলে ডোপামিনের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকে, তার প্রভাবে একটা সময়ের পর পার্কিনসন দেখা দেয়, যাকে বলে ড্রাগ ইনডিউজ পার্কিনসন। এটি সেকেন্ডারি পার্কিনসনিজমের মধ্যেই পড়ে।
যাঁদের ছোট ছোট প্রচুর স্ট্রোক হয়েছে তাঁদেরও পার্কিনসন হতে পারে। একে বলে ভ্যাসকুলার পার্কিনসন।
ব্রেনের ইন্ট্রাফেনিয়াল প্রেশার বৃদ্ধি পেলে তাকে বলে নমার্ল প্রেশার হাইড্রোসেফালাস। এক্ষেত্রেও হয়। একে বলে সেকেন্ডারি পার্কিনসনিজম।
আর একটি হল পার্কিনসন প্লাস সিনড্রোম। এটা ক্লাসিক্যাল পার্কিনসন থেকে একটু আলাদা।
জেনেটিক পার্কিনসনিজম রয়েছে। জিনগত সমস্যা থাকার জন্য কিছু মানুষের চল্লিশের নিচে পার্কিনসন হয় তাঁদেরটা জেনেটিক বলে ধরে নেওয়া হয়। একে বলে ইয়ং অনসেট পার্কিনসন ডিজিজ অর্থাৎ (ওয়াইওপিডি)। বংশগতভাবে পার্কিনসন রোগ বাবা বা মায়ের থাকলে অনেক সময় পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই রোগ আসে।
আরও পড়ুন-বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যই এখন সবচেয়ে জরুরি, সরব নীতীশ
উপসর্গ
পার্কিনসন সহজে প্রথমেই ধরা পড়ে না। প্রথম লক্ষণ রোগীর খুব স্লথ হয়ে যাওয়া। খুব ধীরগতির হয়ে যায়।
কথা বলার সময় গলার স্বর হালকা, খুব ধীরে হয়ে যায়। যেন কথার মধ্যে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ইনফরমেশন প্রসেসিং স্পিড হ্রাস পায় অর্থাৎ একটা কথা বলার পর তার উত্তর দিতে অনেকটা দেরি হয়। চিন্তাভাবনার স্তর ধীরে হয়ে যায়। একে বলে ব্রাডিফেনিয়া।
হাতের লেখা খারাপ বা ছোট ছোট হয়ে যায়। চিকিৎসকের পরিভাষায় একে বলে মাইক্রোগ্রাফিয়া।
কাঁপুনি হয়। তবে হাত-পা কাঁপা শুরু হয় একটু পরের দিকে। সাধারণত রোগী বসে থাকলেও দেখা যাবে তাঁর কোনও একটা হাত বা পা কাঁপছে মৃদু। এটা প্রথমে ডানদিক বা বাঁদিকে হয় তারপর দু’দিকেই শুরু হয়ে যায়।
রোগ আরও বেড়ে গেলে পশ্চারাল রিফ্লেক্স ব্রেক হতে শুরু করে অর্থাৎ উঠে দাঁড়াতে সমস্যা হয়। সেই জন্য পার্কিনসন বেশি বেড়ে গেলে রোগী বারবার পড়ে যায়।
ঘ্রাণশক্তি হ্রাস পায়, ক্রনিক কনস্টিপেশন হয়।
আরও পড়ুন-উপরাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ
ঘুমের মধ্যে কথা বলা, হাত-পা ছোঁড়া, স্বপ্ন যেটা দেখছেন বা যাকে দেখছেন তার সঙ্গেই কথা বলে চলেছেন রোগী, একে বলে ড্রিম এনাক্টমেন্ট। স্বভাবের পরিবর্তন হয়।
পার্কিনসন রোগীর একটা সেন্ট্রাল পেন হয় সেটা রোগী নিজে বুঝতে পারে না। কাঁধে ব্যথা বা ফ্রোজেন শোল্ডার, খুব কোমরে ব্যথা হয় যেটা আসলে হাড়জনিত কোনও ব্যথাই নয়। পার্কিনসনের জন্য এই ধরনের ব্যথা হয়।
পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স যাঁদের, তাঁদের মানসিক অবসাদ হতে পারে। সারাদিন ঝিমিয়ে থাকার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায় যে কারণে গতিবিধি আরও কমে যায়।
কিছু পার্কিনসন প্লাস সিনড্রোম রয়েছে যাতে রোগীর তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। এঁদের দু’দিকে একসঙ্গে খারাপ হতে থাকে। অর্থাৎ কয়েকদিনেই দেখা গেল একদম আর হাঁটাচলা করতেই পারছেন না। খুব স্লো হয়ে গেছেন। খুব হ্যালুসিনেশন হয়। খিঁচুনি হয়, ঝাঁকুনি হয়। রোগীর হাত পা একটু বেঁকে যায়। দুটো হাতই কাঁপছে। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
মনে রাখা দরকার পার্কিনসনের রোগীর খুব সামান্য সর্দিকাশি, জ্বর হলে বা সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা কমে গেলেই সিরিয়াস হয়ে যায়। হসপিটালাইজেশনের প্রয়োজনও হতে পারে।
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে যান্ত্রিক ত্রুটি, যাত্রীদের আতঙ্কে ফেলে দিল্লিতে ফিরল ভিস্তারা
চিকিৎসা
পার্কিনসনে ডোপামিনের মাত্রা কমে যায় তাই বাইরে থেকে কৃত্রিম ভাবে ডোপামিন মাত্রা বৃদ্ধি করবে এমন ওষুধ দিতে হবে বা ডোপামিনের বিকল্প ওষুধ দিতে হবে।
ডোপামিন আর অ্যাসিটাইল কোলিন সমভাগে থাকে মস্তিষ্কে। ডোপামিন কমলে সেটার ভারসাম্য রক্ষার্থে অনেকসময় অ্যাসিটাইলকোলিনের মাত্রা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয় কিছু রোগীর ক্ষেত্রে। তখন বাইরে থেকে ডোপামিন দেওয়া আর অ্যাসিটাইলকোলিনের মাত্রা একটু কমিয়ে দেওয়া হলে রোগীর খানিকটা সুস্থ হয়।
পার্কিনসন সিভিয়র হলে ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন বলে একটি সার্জিক্যাল পদ্ধতি রয়েছে। ব্রেনের ড্যামেজ অংশকে স্টিমুলেট করে দেওয়া হয় এই পদ্ধতিতে। এখানে এখনও পুরোপুরি এই পদ্ধতি শুরু হয়নি, গবেষণা চলছে।
ওষুধের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে পার্কিনসন এমনটা নয়। সুগারের ওষুধের মতোই সারাজীবন খেয়ে সুস্থ থাকতে হয়। ওষুধের ডোজ কমানো-বাড়ানো হয় মাত্র।
আরও পড়ুন-কিশোর স্কুলপড়ুয়াদের সমস্যা সমাধানে ‘বন্ধুমহল’
ফিজিওথেরাপি খুব কার্যকরী পার্কিনসনে। ব্যায়াম করাটাও খুব জরুরি অর্থাৎ রোগীকে সচল রাখা। কারণ এই রোগী জবুথবু হয়ে গেলে হাড়ের ক্যালসিয়ামে খুব প্রভাব পড়ে। ফলে একটু পড়ে গেলেই ফ্রাকচার হয়ে যেতে পারে তাই নিয়মিত ব্যায়াম করলে মাংশপেশি সচল হয়, হাড়গুলো শক্ত হয়। এর ফলে অনেক ভাল থাকে পেশেন্ট।
পার্কিনসনের প্রতিরোধ করার তেমন কোনও উপায় নেই তবে নিয়মিত ব্যায়াম, স্ট্রোক যাতে বারবার না হয়, এমন কোনও ওষুধ যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে পার্কিনসন হতে পারে সেগুলো দীর্ঘদিন না খাওয়া এগুলো অনেকটা রোধ করে পার্কিনসন। জেনেটিক বা আইপিডি পার্কিনসনে কিন্তু কার হবে বা হবে না তা বলা মুশকিল।
তবে নিয়মিত ওষুধ, ব্যায়াম, ফিজিওথেরাপির মধ্যে থাকলে রোগী অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থ থাকতে পারে।