কমরেড ভুললে চলবে না, আপনাদের জমানায়, ৩৪ বছর ধরে জেলায় জেলায় পার্টির চোখধাঁধানো পার্টি অফিস দেখে একসময় খেটে খাওয়া মানুষের ভ্রু কুঁচকে যেত। প্রশ্ন উঠত, এসবই আগমার্কা নির্লোভ কমরেডদের কষ্টার্জিত সাদা পয়সায় তৈরি কি না! সমাজ বদল করার স্বপ্ন দেখা ভাল, কিন্তু কাজটা বাবার পয়সায় বাইশ লাখি গাড়ি চাপা কমিউনিস্টদের কম্ম নয়, সেটা সবাই আজ হাড়ে হাড়ে (কিংবা হারে হারে) টের পাচ্ছে। আবার একনিষ্ঠ নীরেন ঘোষ, চিত্তব্রত মজুমদাররা মাইলের পর মাইল পায়ে না হেঁটে যদি অমন বিলাসবহুল গাড়ি পেতেন তাহলে সমাজ এতদিনে বদলে যেত কি না, সেটাও অর্বুদ টাকার প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-ফের শিরোনামে যোগীরাজ্য, বিজেপি নেতার ক্ষমতা প্রদর্শনের জেরে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু রোগীর
ক্ষমতা হারানোর ১১-১২ বছর পর সিপিএম নেতারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কোনও স্মৃতিই আর মনে করতে পারছেন না। নিজেরাও ভুলতে চান, মানুষকেও ভোলাতে চান সেসব কথা। ভোলাতে চান বিনয় চৌধুরীর সেই আক্ষেপ, ‘পার্টি ফর দ্য কন্ট্রাক্টর, বাই দ্য কনন্ট্রাক্টর…।’ কিংবা দুর্নীতির নাগপাশে দলকে বন্দি দেখে হতাশ বুদ্ধদেববাবুর ঐতিহাসিক স্বগতোক্তি ও পদত্যাগের নাটক, ‘চোরের ক্যাবিনেটে আর থাকব না।’ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এটা কথা ভোলাতে চাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন-ইডেনে পা রাখবেন কিং খান, জিততে মরিয়া নাইটরা
যাঁরা ৩৪ বছরের লাল জমানার সাক্ষী তাঁরা জানেন, হলদিয়ার শাহেনশা কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতার ছেলের বিয়েতে উপহারের বৃত্তান্তও ছিল সেই আমলের মুখরোচক আলোচনার বিষয়। কিংবা এক মন্ত্রীর লাখ টাকার চশমার বিল। তিনি অবশ্য এখন পরলোকগত। এরকম একটা দলের আজ ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার একযুগ পর বৈরাগ্য এসেছে। একেবারে হিমালয়ের কপর্দকহীন সন্ন্যাসী সেজে নতুন করে বাংলার রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হতে চাইছেন ইডি-সিবিআইয়ের পিছন পিছন। ঠিক যেমন সাতাত্তর সালে জনতা দলের হাওয়া সম্বল করে প্রফুল্ল সেনদের ছায়ায় বাংলার রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছিলেন জ্যোতি বসুরা। সেই ইনিংস চলেছিল ৩৪ বছর। আর, এবার রাম-বাম এক হয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে মরিয়া, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-কলকাতায় বাড়ছে তাপমাত্রা, বৃষ্টির সম্ভাবনা কবে
কিন্তু মুশকিলটা অন্য জায়গায়। গ্রামেগঞ্জে ভোটের নামে বাম আমলের প্রহসনের কথা বাংলার মানুষ ভোলেননি। তাঁরা আজও মনে রেখেছেন, নির্বাচনী প্রচার শেষ হতেই বিরোধী এজেন্টদের এলাকা ছাড়ার ফরমান। ভোটকর্মীদের ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে ম্যানেজ করা সহ সব কালো স্মৃতি বেমালুম ভুলিয়ে দিতে চাইলেই হবে! তারই ফলশ্রুতি তো বুথে বুথে গণনা শুরু হলেই বছরের পর বছর লাল ঝড়! পাহাড় থেকে সাগর। এভাবেই কেটে গিয়েছে ৩৪ বছর। কোথাও বাধা মানেনি সন্ত্রাস। শুধু একবার নয়, পরের পর নির্বাচনে এই জিনিস ঘটেছে। সিপিএমের সায়েন্টিফিক রিগিংয়ের খতিয়ান ৩৪ বছর ধরে তাদের রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আসীন রেখেছিল।
আরও পড়ুন-আইপিএলে কোভিড এন্ট্রি, আক্রান্ত তারকা ক্রিকেটার
মনে পড়ে না কমরেডদের সেইসব দিনের কথা যখন দেখতাম এক-একটি বুথে বামেরা পেয়েছে ৮৩২ ভোট, আর বিরোধীরা মাত্র ১৫? আবার কোথাও ৯০০ তো উল্টোদিকে মাত্র ৬। এমন অবিশ্বাস্য সাফল্যের কারণ একটাই। শুরু থেকেই বিরোধী এজেন্ট ও পোলিং পার্টিকে কব্জা করে ছাপ্পা চলেছিল বিনা বাধায়। এমনকী, অদৃশ্য জাদুবলে বিরোধী সমর্থকদের ভোটও চলে গিয়েছে বামেদের বাক্সে! কলকাতা পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে ছাপ্পার জোরে রেকর্ড ২৫ হাজারেরও বেশি ভোটে দলের জয় দেখে মুচকে হেসেছিলেন পার্টিরই বহু পুরনো কমরেড। মাত্র ১২ বছরেই সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে চাইছেন লাল পার্টির লোকজন।
আরও পড়ুন-তারকেশ্বর মন্দির পুজো দিতে এসে তীর্থযাত্রীর মৃত্যু
সেই আমলে একটা জিনিস কিন্তু প্রায় প্রমাণিত সত্য ছিল। একদিকে যেমন রিকশা কিংবা অটোয় চেপে পার্টি অফিস বললেই চালক অবধারিতভাবে লালপার্টির কার্যালয়েই নিয়ে যেত, চোখ বেঁধে দিলেও অন্য কোথাও নয়, ঠিক তেমনই চাকরি হলে শতকরা ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তা নির্দিষ্ট থাকত পার্টির হয়ে গলা ফাটানো নেতানেত্রীদের জন্য। ‘গণশক্তি’র এক কর্মীর স্ত্রী রাজ্য সরকারের চাকরি পেয়েছেন, অথচ পাশের জন বঞ্চিত, তা নিয়েও ঠান্ডা লড়াই চলছে, সে খবরও কানে এসেছে। স্বজনপোষণের নামে একেবারে গুছিয়ে খাওয়া যাকে বলে! জেলা কমিটি থেকে নির্দিষ্ট তালিকা যেত এবং তা মেনেই স্কুলে কলেজে নিয়োগ হত। কুজন, সুজন, দুর্জন সবাই পার্টির দৌলতে চাকরি বিলিয়েছেন, এ একেবারে ওপেন সিক্রেট।
আরও পড়ুন-‘পঞ্চায়েতে দক্ষ কর্মী চাই, ভাল মানুষ চাই’ পূর্ব মেদিনীপুর থেকে বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
সে আমলে মিডি গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছিল পরিবহণ দফতর। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পরিবহণ ব্যবস্থাকে সাধারণের কল্যাণে পরিচালিত করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু অত দামি গাড়ি ধূমকেতুর মতো এল, আবার রাতারাতি বিদায়ও নিল। টিকিটিও আর দেখা গেল না। সাধারণ মানুষের পকেট কেটে সরকারি পয়সার শ্রাদ্ধ করল কারা, তার কী তদন্ত হয়েছে, দোষীরা কি শাস্তি পেয়েছে?
মনে আছে, ২০০৮ এর কথা। কৃষি দফতরের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল। খাদ্য দফতরে গ্রুপ ডি পদে ৬৪১ জনের নিয়োগ নিয়েও কম তোলপাড় হয়নি। ক্ষমতা হারানোর তিনবছর আগে, অর্থাৎ ২০০৮ সালে ওই ঘটনা ঘটে। ওই জোড়া অনিয়মের জন্য ক’জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ঝাড়ুদার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীয় উপাচার্য, কোনও পদকেই তো সিপিএমের কমরেডরা ছাড়েনি। সব এক্কেবারে বেমালুম ভুলে গেলেন কমরেডকুল?
আরও পড়ুন-‘পঞ্চায়েতে দক্ষ কর্মী চাই, ভাল মানুষ চাই’ পূর্ব মেদিনীপুর থেকে বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
মোদি সরকারের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পাওনা পড়ে আছে লক্ষাধিক কোটি টাকা। রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি দায়িত্বশীল সরকারের পক্ষে এই অন্যায় অনির্দিষ্টকাল মুখ বুজে সহ্য করা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নালিশ জানাবার শ্রেষ্ঠ জায়গা হল মানুষের দরবার। সেজন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষমেশ সেই পথই বেছে নিয়েছিলেন। ধর্মতলায় আম্বেদকর মূর্তির পাদদেশে টানা দু’দিনের ধরনা কর্মসূচি পালন করেন তিনি। হুক্কাহুয়া রবে গলা না মিলিয়ে, ঘোলা জলে মাছ ধরার বৃথা চেষ্টা না করে, লাল পার্টির লোকদেরও উচিত ছিল, জননেত্রীর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শামিল হওয়া। তাহলে অন্তত ভাবমূর্তি কিঞ্চিৎ উদ্ধারের আশা ছিল।
সদুপদেশটা মনে রাখবেন কমরেড। নইলে ভবিষ্যতে মুখ লুকোবার জায়গা পাবেন না।