মেরুকরণের তাস বাংলার মাটিতে খেলবেন না, প্লিজ

মোদিজি সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কাল্পনিক আতঙ্কের প্রসার ঘটিয়ে হিন্দু ভোট জোটবদ্ধ করতে মরিয়া। লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। সেকথা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছেন নরেন্দ্র মোদি। তাই, বাংলার বুকে তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের তাস খেলতে বসলেন। বর্ধমানের প্রচার সভা তার প্রমাণ। মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বারংবার হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদ ছড়াতে চাইলেন বাংলার সম্প্রীতির সবুজ ঘাসে। আসলে এটাই মোদির ঘরানা। বিজেপির পরম্পরা। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার গোড়ায় কুড়ুল মেরে ভোট ব্যাংক মজবুত করতে নেমে পড়েছেন। মোদিবাবু।

আরও পড়ুন-দেবের কপ্টারে ধোঁয়া, জরুরি অবতরণে রক্ষা

ভোটের মুখেই রাজস্থানে সংখ্যালঘু মোর্চার নেতা উসমান গণিকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিজেপি। অপরাধ? একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উসমান গণি বলেছিলেন, ‘মুসলিম সমাজের নাম করে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা কাম্য নয়।’ রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ায় এক জনসভায় মোদি বলেছিলেন, ‘আগে যখন কংগ্রেসের সরকার ছিল, তখন বলেছিল, দেশের সম্পত্তিতে প্রথম অধিকার মুসলিমদের। এর অর্থ ওরা সম্পত্তি এককাট্টা করে যারা বেশি সন্তানের জন্ম দেয়, যারা অনুপ্রবেশকারী, তাদের বিলি করবে।’ বলেছেন, ‘কংগ্রেসের নজর আপনার সম্পত্তির উপরে। ক্ষমতায় এলে এরা মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে।’ প্রধানমন্ত্রীর মুখে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী এমন মন্তব্যের সমালোচনা করেই দলীয় নেতাদের কোপে পড়েছেন উসমান গণি।
আর এই কথাগুলোই ফের বলেছেন বাংলার প্রচার সভায় বর্ধমানে।

আরও পড়ুন-আমার রবি কবি

আগেরবারের মতো মোদি-হাওয়া নেই। নেই পাঠানকোট-বালাকোটের মতো যুদ্ধ-যুদ্ধ গন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে আর মন দোলা দিচ্ছে না। একঘেয়েমি এসে গিয়েছে। তাদের নজরে ধরা পড়েছে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভোটের লাইনে হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমদের আধিক্য বেশি। ফলে প্রশ্ন জাগছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী না হয়েও যাঁরা মোদিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা এবার কি ভোট দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করছেন। রাজনীতির পরিভাষায় এসব ‘ফ্লোটিং ভোটার’ই জয়ের মার্জিন বাড়ায়। তাঁরা মুখ ফেরালে জয় পাওয়া কঠিন। আসলে মোদির ‘জুমলাবাজি’ (ভাঁওতা) মানুষ ধরে ফেলেছে। চাকরিবাকরির হাল শোচনীয়। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে। সাধারণের সুরাহার জন্য যাবতীয় প্রতিশ্রুতির একটাও পূরণ হয়নি। ফলে মোদির গ্যারান্টিতে মানুষ ভুলছে না। তাই ভোটের হার কমেছে। ‘চারশো পার’ স্লোগানও তাই অলীক কল্পনা। প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোটের হার দেখেই বিরোধীরা মনে করছে, এটা হতে চলেছে মোদির বিরুদ্ধে অনাস্থাজ্ঞাপনের ভোট।
বিজেপির এই কৌশল নতুন কিছু নয়। সেই ২০০২ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির প্রথম ভোটপ্রচার এ-দেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের আবহ ছড়িয়ে দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল নিজেকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ বানানোর কৌশল। সেই প্রথম কোনও রাজনৈতিক দলের প্রধান মুখ নির্বাচনী প্রচারে নেমে সরাসরি মুসলিমদের নাম করে, তাঁদের সম্পর্কে বিদ্বেষের তির ছুঁড়েছিলেন। প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিমদের বংশবৃদ্ধি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা সেই বারই প্রথম। গুজরাতের হিংসার পরে মুসলিমদের ত্রাণশিবিরকে তিনি ‘সন্তান উৎপাদনের কারখানা’ বলে তকমা দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে এসে সেই মোদি ফের মুসলিমদের সম্পর্কে একই কথা শোনাচ্ছেন।

আরও পড়ুন-সংঘর্ষের বর্ষপূর্তি বন্‌ধ মণিপুরে

মুম্বইয়ে ভোট প্রচারে গিয়ে জে পি নাড্ডা বলেছেন, ‘ইন্ডি’ (‘ইন্ডিয়া) জোটের গোপন উদ্দেশ্য হল তফসিলি জাতি-জনজাতি (এসসি-এসটি) এবং অন্য অনগ্রসরদের (ওবিসি) অধিকার কেড়ে নিয়ে তা মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া। ওঁদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহনই তো বলেছিলেন, দেশের সম্পদের উপর প্রথম অধিকার মুসলিমদের। তারা ‘ঘুসপেটিয়া’, অর্থাৎ অবৈধভাবে এ দেশে এসেছে, মানে অনুপ্রবেশকারী। আর বিদ্বেষের এই আবহে যোগী আদিত্যনাথ প্রকাশ্যে বলেছেন, ইন্ডি জোটের লক্ষ্য হল, গোহত্যা করে সংখ্যালঘুদের মাংস খাওয়ায় অধিকার দেওয়া। এটা আজ স্পষ্ট, কেন্দ্রের শাসকদল সংখ্যালঘুকে পায়ের নচে সদাসন্ত্রস্ত করে রাখতে চায়, এবং সেই লক্ষ্য যখন মোটের উপর পূর্ণ হয়ে এসেছে, তখন সংখ্যালঘুর জুজু দেখিয়ে ক্রমাগত সংখ্যাগুরু ভোট এক জায়গায় আনতে চায়। ভোটারদের অনাগ্রহ কাটিয়ে পরের পর্বগুলিতে হাওয়া তুলতে তাই ‘মুসলিম জুজু’ হাতিয়ার।

আরও পড়ুন-রবীন্দ্র-জীবনে তিন নারী

সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটির (সিএসডিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, চরিত্রগত ভাবেই গোবলয়ের উদ্ধত হিন্দুত্বগন্ধী। ফলে মুসলিমদের ১০ শতাংশ ভোটও বিজেপি পায় না। যতই তারা পসমন্দাদের (নিম্নবর্গের মুসলিম) মন পাওয়ার চেষ্টা করুক, তা সময়ের বৃথা অপচয়। ভোটের লাইনে মুসলিমদের প্রবল উপস্থিতি যদি এমনই থাকে এবং হিন্দুদের উৎসাহে জোয়ার না আসে, তা হলে বিপদ অনিবার্য। তাই হিন্দুত্বের জাগরণে হিন্দুদের মনে ভয় সঞ্চার করতেই হবে। মোদি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, রামমন্দির তৈরির ইস্যু ‘বাসি’ হয়ে গিয়েছে। বিরোধী প্রচারে রোটি-কাপড়া-মাকানের সঙ্গে বিজলি-সড়ক-পানি যেমন প্রাধান্য পাচ্ছে, তেমনই উঠে আসছে বেকারত্বের জ্বালা, মূল্যবৃদ্ধির কোপ, দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং এক শতাংশ ধনী মানুষের আরও ধনী হওয়ার কাহিনি। এই বোঝার উপর শাকের আঁটি নির্বাচনী বন্ড। এগুলোর একটার জবাবও তাঁর কাছে নেই। যা আছে, তা শুধুই ধর্মীয় মেরুকরণ। আর তাই ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনের গরম হাওয়ায় মাছ, মাটন, মুসলিমের পর মোদি যোগ করেছেন ‘মঙ্গলসূত্র’!
ধর্মীয় মেরুকরণই লাগামছাড়া বেকারত্ব আর আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির যুগে মোদির একমাত্র রক্ষাকবচ।

Latest article