রাবীন্দ্রিক পোশাক

আজকের তরুণ-তরুণীদের মনে নিভৃত যতনে রবিঠাকুরেরই পদচারণ। তাঁদের চলনবলন, সাজ-পোশাকে প্রাধান্য পেয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যের চরিত্রগুলো। তাঁর গল্পের নায়িকাদের সাজে একালের মেয়েরাও হয়েছেন অনন্যা। রবীন্দ্রনাথই শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন বুটিক শিল্প। লিখছেন রাজীব শ্রাবণ

Must read

রাবীন্দ্রিক পোশাক বাংলা সাহিত্যে প্রভাব ফেলতে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নের অন্তিম সময় থেকে। তারপর থেকে দিন বদলের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন অনেক কিছু। কিন্তু অনেকের কাছে সমসাময়িক ও আধুনিক সাহিত্যে আজও রস ও প্রাণের যোগানদাতা একমাত্র কবিগুরুই। আজকের তরুণ-তরুণীদের মনে নিভৃত যতনে রবিঠাকুরেরই পদচারণ। তাঁদের চলনবলন, সাজ-পোশাকে প্রাধান্য পেয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যের চরিত্রগুলো। রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীত আজও আমাদের জীবনাচরণকে প্রভাবিত করে এক অমোঘ শক্তিতে। তাঁর গল্পের নায়িকাদের সাজে একালের মেয়েরাও হন অনন্য। আজকের তরুণরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐশ্বর্যময় সাহিত্য বুকে লালন করে নিজেদের সাজে ও ব্যবহারিক জীবনে প্রাণবন্ত করেন সেসব চরিত্রকে। শান্তিনিকেতনি কারুকার্যখচিত নানা রঙের, নানা বাহারের পাঞ্জাবিতে শুধু আজকের তরুণ যুবকরাই নয়, বহু আধুনিক মনস্ক তরুণীরাও এই পোশাকে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। সবথেকে বড় কথা বহু বাঙালি প্রবীণেরাও রবিঠাকুরের বর্ণিত ও প্রচলন করা পোশাককেই বেছে নেন নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে। এ-প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথই বিদেশ থেকে শান্তিনিকেতনে বুটিক শিল্পের আমদানিকারক। সোনাঝুরির বুটিক তাই আজও সমান জনপ্রিয়। রবিঠাকুরের ঘরে-বাইরে উপন্যাসের বিমলা, নষ্টনীড় গল্পের চারুলতা আর রক্তকরবী নাটকের নন্দিনীর মতো চরিত্রের সাজে যে পরিমিতির ছোঁয়া পাওয়া গেছে তা আজও যেন সমসাময়িক।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সময়ের মেয়েদের সাজসজ্জায় ছিল পূর্ণমাত্রায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। সেখানে পরিমিতি বোধ ছিল তীক্ষ্ণ। আর চোখে প্রশান্তি জোগাত বাহুল্যবর্জিত উপস্থাপনা। পোশাক নির্বাচন, চুলবাঁধা, গহনা বাছাই, চলার ভঙ্গি— সবই ছিল রুচিশীল। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে রাজবাড়ির বউ প্রগতিশীল বিমলা এক সময় স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পোশাক আর সাজসজ্জা সম্পর্কে তাঁর জবানিতেই জানা যায়, ‘সেদিন সকালে মাথা ঘষে আমার সুদীর্ঘ এলোচুল একটি লাল রেশমের ফিতে দিয়ে নিপুণ করে জড়িয়েছিলুম। দুপুরবেলায় খাবার নিমন্ত্রণ, তাই ভিজে চুল তখন খোঁপা করে বাঁধবার সময় ছিল না। গায়ে ছিল জরির পাড়ের একটি সাদা মাদ্রাজি শাড়ি, আর জরির একটু খানি পাড়-দেয়া হাত-কাটা জ্যাকেট।’
বিমলার মতো সাজ পেতে আজকের তরুণীরা হালকা বা গাঢ় রং ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এদিকে ফুলের গহনায় রক্তকরবীর নন্দিনীরূপে সাজতে পারেন যে কেউ। একরঙা জরিপাড়ের শাড়ি আর সাদামাটা সাজে চুলগুলো খুলে দিলেও তাদের ভাল লাগে।

আরও পড়ুন-জিএসটি আদায়ে রেকর্ড করল রাজ্য

নষ্টনীড়ের অন্দরমহলে বন্দি চারুলতা সারাক্ষণই ফিটফাট পোশাকে থাকা চরিত্র। চওড়া পাড়ের শাড়ি, লেস দেওয়া ব্লাউজ, কিছুটা ভারী গহনা, খোঁপায় কাঁটা বা ফুল ইত্যাদি যেন চারুর চরিত্রের সঙ্গেই মিলে যায়। তবে সেখানে কোনও বাহুল্য ছিল না। বরং নমনীয়তা ও আভিজাত্যের বিষয়টি ছিল পূর্ণ মাত্রায়। তাই কখনও ব্যতিক্রম হলে সেটাই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। আজকে যারা রবীন্দ্রনাথকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন তাঁদের সাজে এই তিন চরিত্রের আদল পাওয়া যায় একইভাবে। সে-সময় পোশাকের রং হিসেবে হালকা বেশি প্রাধান্য পেত। সাদা, বাদামি, খয়েরি, সবুজ, আসমানি ছিল বেশি। দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ড ‘রং বাংলাদেশ’-এর প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস বলেন, ‘আমরা সব সময়ই ক্রেতার চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছি। আর তাই রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমাদের আয়োজনে থাকছে রাবীন্দ্রিক আবহ। শাড়ি, থ্রি পিস, পাঞ্জাবি সবকিছুই তৈরি হয়েছে ছিমছাম ডিজাইন আর হালকা রং-এর মিশেলে।’ শাড়ির পাশাপাশি কারুকার্য করা ব্লাউজের প্রাধান্য বেশি। ভাল মানের কাপড়ে মটকা, সিল্ক, মসলিন ব্যবহার করা যেতে পারে। সঙ্গে কুরুশকাটার লেস, ফ্রিল বা পাইপিং থাকলেই অনেক বেশি নজরকাড়া হবে। ব্লাউজের গলা পছন্দমতো হতে পারে। পিঠখোলা, পিঠবন্ধ অথবা কলার তোলাও হতে পারে। হাতার ক্ষেত্রে লম্বা, থ্রি-কোয়ার্টার বা কনুই পর্যন্ত হতে পারে। ব্লাউজে অলঙ্করণের আধিক্যই প্রধান থাকবে। এই সাজে দেশীয় তাঁত টাঙ্গাইলের শাড়ি, এন্ডি, কোটা, হাফ সিল্ক, সিল্কের ঐতিহ্যবাহী নকশা করা শাড়িগুলো ভাল দেখাবে।

আরও পড়ুন-দেবের কপ্টারে ধোঁয়া, জরুরি অবতরণে রক্ষা

সাজের ক্ষেত্রে কবির নারী চরিত্রদের বেণী করা চুলে বড় করে খোঁপা করার চলন ছিল। খোঁপা কিংবা বেণীর ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিতেন রুপোর কাঁটা। অনেকে সামনে সেট করে চুল খোলা রাখতেও পছন্দ করতেন। বনেদি পরিবারের মেয়েরা বিচিত্র কারুকাজের বিভিন্ন সোনা-রুপোর গহনা পরতেন। হাতে চুড়ি, বালা, শাঁখা, গলায় কয়েক লহরের চেন, কানে দুল, নাকে নথ আর পায়ে মল পরে নিজেকে সাজাতেন। রাজকীয় নকশার আংটি আর চুড়ি পরতেন। ঘরে পরা পোশাক আর গহনায় রুচির ছাপ ছিল। বাড়ির আঙিনা ছেড়ে বাইরে বের হলে মাথায় ঘোমটা টেনে তার ওপর আটকে নিতেন। কোমরে বিছা, আঁচলে চাবির গোছায় টুংটাং শব্দ বাড়িতে যেন তার অস্তিত্ব জানান দিত। সনাতনী ধর্মের বিবাহিত নারীরা সিঁথিতে সিঁদুর পরতেন গাঢ় করে। পায়ে-হাতে আলতা পরে বাড়িতে ঘুরে বেড়াতেন সদ্য বিবাহিত বধূ আর তরুণীরা। বছর জুড়ে বাঙালি ঘরানায় নিজেকে উপস্থাপন করতেন। বর্তমান সময়ে নারীরাও রবীন্দ্র ঘরানায় নিজেকে সাজিয়ে তুলতে পছন্দ করেন। তবে উপস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নানা উৎসবে কানের একপাশে ক্লিপ দিয়ে আটকে দেন তাজা ফুল। খোঁপায় জড়িয়ে নেন গাজরা অথবা বেলি ফুলের মালা। আলতার পাশাপাশি মেয়েরা এখন মেহেন্দি পরে হাত-পা রাঙিয়ে নেন। শাড়িতে নানা নকশার ব্রোচের ব্যবহার ইদানীং বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। সাজসজ্জা খুব পরিপাটি থাকলেও সেসময় খুব বেশি প্রসাধন ত্বকে চড়ানোর প্রবণতা মেয়েদের মধ্যে ছিল না। আর তাই এ ধরনের সাজসজ্জা যে কেউই বাড়িতে বসে করে ফেলতে পারবেন। এ ধরনের সাজসজ্জার ক্ষেত্রে আজকাল হাল্কার পাশাপাশি ভারি বেইজ মেকআপেও অনেকে আগ্রহী। চোখের কাজল দেওয়া চাই অবশ্যই। কপালের টিপের আকৃতি থাকবে নিজের চেহারার সঙ্গে মানানসই। চোখে হালকা সোনালি বা বাদামি রঙের আইশ্যাডো দিয়ে টেনে আইলাইনার বা কাজল দিতে পারেন। তবে বর্ষার সময়ে কাজল দেওয়ার চেয়ে আইলাইনার দেওয়াটাই ভাল। কাঠ, পুতি, অ্যান্টিক এবং মাটির গহনা পরে এখন সাজানো হচ্ছে কবিগুরুর সাহিত্য চরিত্রগুলোকে। তবে পরিবর্তন যাই হোক না কেন চিরদিনই প্রাণবন্ত হয়ে থাকবে রাবীন্দ্রিক সাজ।

আরও পড়ুন-আমার রবি কবি

রবীন্দ্র ঘরানার এ-ধরনের পোশাক শুধু আমাদের বাংলাই নয়, এ-দেশের বহু রাজ্যের এ-প্রজন্মের যুবক-যুবতীকে আচ্ছন্ন করতে পেরেছে। যেমন, পূর্ব ভারতের মণিপুর, অসম, ত্রিপুরা যেমন আছে। তেমনি গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কেরলের রবীন্দ্রমনস্ক ছেলেমেয়েরাও নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র-পোশাক ব্যবহার শুরু করেছেন।
শুধুমাত্র একটি পোশাকেরই এখনও চল হয়নি। সেটি হল তাঁর সুদীর্ঘ জোব্বা। তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এ-পোশাকটিও গ্রহণীয় হয়ে উঠবে।
সব শেষে পোশাক নিয়ে রবিঠাকুরেরই একটি লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি বাঙালির সাহেব সাজার চিরকালীন ভয় নিয়ে লিখেছেন— ‘সাহেব সাজা বাঙালিদের প্রতি পদে পদে ভয়, পাচ্ছে তারা বাঙালি বলে ধরা পড়েন।’ এ-আমলের আধুনিক বাঙালি বিদ্বানদের কাছে যা একেবারেই অজানা। আসলে বাঙালির পোশাকি আধুনিকতা বা ফ্যাশনের পেছনে ছোটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ইওরোপ প্রবাসীর পঞ্চম পত্রে যা বলেছেন, তা হল সাহেব সাজতে এই জাতির চিরো-ভয়। এটা প্রাণিত সত্য। তিনি বিলেতে বসে তখন যা টের পেয়েছিলেন, এ সময়ে সেটা চোখে পড়ে প্রতি পদে। সাহেব সাজা বাঙালিদের ভয় হাই কমোড থেকে শুরু করে পোশাকে এসেও ধাক্কা মারে। সুট-ব্লেজার পরে এখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় মানায় না পাবলিক বাসে চড়া। অথবা কোন ফাঁকে না জানি পানের পিকে নষ্ট হয় পশ্চিমা জামাটি। অবশেষে ফুটে না ওঠে বাঙালি আচরণের প্রতিবিম্ব! ভয় থাকে সাহেব সাজতে। একইভাবে সহেবিয়ানার বেলায়ও। তখন অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে বাঙালিয়ানা। তবে এ-প্রসঙ্গে একটা কথা বলা ভাল, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করা আধুনিক ডিজাইনে সাহসিকতার পরিচয় দেন এ-সময়ের ডিজাইনাররা। এটা প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও অগ্রিম, আরও ফ্যাশনট্রেন্ডি হতে পারে।

Latest article