রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়:
রাধা : কবে আমাকে প্রথম দেখেছিলে, মনে আছে তোমার?
কৃষ্ণ : সে তো কোন ধূসর অতীত। ইতিহাসের বাইরে। স্মৃতি সেখানে পৌঁছতে পারে না। সেই দূরত্বে পৌঁছতে ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে, অস্পষ্ট হয়ে যায়, মনকেমন। রাধা, আমাদের চেনা সময়ের অনেক দূরে মহাকালে অদৃশ্য আমাদের শুভদৃষ্টির লগ্ন। কিন্তু একটি কথা মনে আছে।
রাধা : কী কথা কৃষ্ণ?
কৃষ্ণ : প্রথম তোমাকে দেখিনি রাধা। শুভদৃষ্টি অনেক পরে। প্রথমে চিনেছিলাম তোমাকে তোমার ঝংকারে, সুরে, উদ্ভাসে।
রাধা : আমি তো তোমার মতো বাঁশি বাজাই না কৃষ্ণ। গান গেয়েও তো শোনাইনি। কোন শব্দের অভিজ্ঞানে আমাকে চিনেছিলে কৃষ্ণ?
কৃষ্ণ : তোমার কাঁকনের শব্দ রাধা। তোমার নূপুরের ঝংকার। আর তোমার সখীদের অনর্গল কথার মধ্যে তোমার হাসির ঝরনা। তারপর তো দেখলাম কে এই তন্বী তরুণী!
রাধা : কী দেখলে?
কৃষ্ণ : রাধা, হঠাৎ ঘটল তোমার আঁখিপাত আমার শরীরে! কত আলোকবর্ষ দূরত্ব পেরিয়েও মনে থেকে গেছে তোমার সেই চকিত চাউনি।
রাধা : মিথ্যে কথা কৃষ্ণ। আমি তো একা ছিলেম না। কত মেয়ে ছিল আমাকে ঘিরে। শুধু আমার চাউনি মনে থেকে গেল?
কৃষ্ণ : তুমি যে একেবারে দলছাড়া রাধা। তোমার দৃষ্টির মতো দৃষ্টি আর কোনও মেয়ের চোখে কখনও দেখিনি।
রাধা : মানে!
কৃষ্ণ : মানে খুব সহজ। তোমার ভুরুতে রতির ডাক। তোমার দৃষ্টিতে শৃঙ্গারের ইঙ্গিত। আর কোনও নারীর চোখে দেখিনি এই বাৎস্যায়ন! আর যেই তোমার চোখে চিনতে পারলাম কামনার আহ্বান, অমনি তুমি ইচ্ছে করে ছড়িয়ে দিলে তোমার চুড়ির ঝংকার। সেই শব্দের স্পর্শে সরে গেল আঁচল, উন্মোচিত হল তোমার আলো।
রাধা : যা অসভ্য! আমি ওইসব কিচ্ছু করিনি। বয়ে গেছে আমার। সব তোমার মনের ভুল।
কৃষ্ণ : রাধা, ঠিক আছে, সব আমার মনের ভ্রান্তি। তুমি কেউ নও, আমার ভাবনা ছাড়া। কিন্তু তোমার কি মনে আছে কবে আমাকে প্রথম দেখেছিলে?
রাধা : কতবার দেখেছি তোমাকে। আমার যমুনায় যাওয়ার পথে বসে বসে বাঁশি বাজাতে। আমি দেখেও দেখিনি তোমাকে। বাঁশি শুনেও না শোনার ভান করেছি। কিন্তু সেদিন দেখলাম!
কৃষ্ণ : কী দেখলে রাধা?
রাধা : অন্য কৃষ্ণকে। যে-কৃষ্ণকে এতদিন দেখিনি। অথচ যে-কৃষ্ণ তোমারই মধ্যে নিহিত ছিল, কোনও গভীর পাতাল ছায়ায়।
কৃষ্ণ : কবে? ঠিক কবে? মনে পড়ে রাধা?
রাধা : যেদিন আমাদের সামনে কালীয়দহে তুমি একা ঝাঁপ দিলে কৃষ্ণ। আর তোমার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার মনের সমস্ত প্রণয়, সমস্ত উদ্বেগ, সমস্ত মঙ্গলকামনা। আর তারপর !
কৃষ্ণ : তারপর কী রাধা?
রাধা : তারপর আমার পথের ধারে বসে-বসে বাঁশি বাজানো কৃষ্ণ একা কালীয়দহের গভীর জলের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক অজগর সাপের সঙ্গে কী যুদ্ধ করল! আর সেই যুদ্ধের শেষে তুমি উঠে এলে জল থেকে। ক্ষতবিক্ষত অজগরের ফণার ওপর দাঁড়িয়ে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে তুমি বাঁশি বাজাচ্ছ কৃষ্ণ, কী করে স্মৃতি থেকে মুছে যেতে পারে সেই প্রণয়-জ্ঞাপনের দৃশ্য?
কৃষ্ণ : (হাসতে হাসতে) মনে আছে, মেয়েদের ভিড় হয়েছিল বটে! তা তুমিও ছিলে বুঝি সেই মেয়েদের মধ্যে?
রাধা : ন্যাকামি কোরো না কৃষ্ণ। আমি না থাকলে তুমি বাঁশি বাজাতেই না। তোমার আসল বীরত্বের সবটুকু জলে যেত!
কৃষ্ণ : তাহলে সত্যি কথা বলো, ঠিক কী দেখেছিলে সেদিন।
রাধা : দেখেছিলাম, অনন্তনাগের মাথায় পা রেখে এক অনন্তকালের বীরপুরুষকে! আর আমার সমস্ত জীবনটা বদলে গেল মুহূর্তে। বিস্মৃত হলাম আমি। ভুলে গেলাম, আমি বিবাহিত।
কৃষ্ণ : তাহলে সত্যি কথাটা আমিও বলি। মেয়েদের ওই ভিড়ের মধ্যে শুধু একজনকেই দেখেছিলাম সেদিন। সেই মেয়ে আলোর নদী। সে শত তরঙ্গ ধেয়ে আসছে আমারই দিকে। সেই নারী অনন্তকালের অপূর্বা!
রাধা : কৃষ্ণ, তোমার কিছু চাইবার নেই সেই অনন্তকালের অপূর্বার কাছে?
কৃষ্ণ : আছে রাধা, আমার চাইবার আছে এমন কিছু যা শুধু তার কাছেই চাইতে পারি!
রাধা : তা হলে চাও কৃষ্ণ। যা চাইবে, সব দেব তোমাকে।
কৃষ্ণ : রাধা, আমি চাই তোমার প্রেম। যেন সারাজীবন শুধু আমাকেই ভালবাসো তুমি। অনন্তকালেও যেন শেষ না হয় তোমার প্রণয় ও আশ্লেষ। আর অনন্তকাল যেন তুমি কষ্ট পাও শুধু আমাকেই ভালবেসে!
রাধা : কী নিষ্ঠুর, নির্মম, স্বার্থপর তুমি কৃষ্ণ!
কৃষ্ণ : তুমিও স্বার্থপর রাধা। তুমিও নির্মোহ ও নির্মম। তুমি মন ভোলাও। তুমি ঢেউ তোলো। কিন্তু ধরা দাও না। তুমি মরুমায়া।
রাধা : কৃষ্ণ, তুমি নিজেই জানো না কী চাও। কাকে চাও। তুমি সারাক্ষণ ভাবের ঘরে চুরি করছ।
কৃষ্ণ : রাধা, আমরা দু’জনেই ভাবের ঘরে চুরি করছি। আমার বাঁশির সুরে সেই কথাটা বারবার বলেছি তোমাকে। আজ তোমাকে আরও স্পষ্ট করে বলতে চাই
রাধা : কী কথা কৃষ্ণ ( রাধার কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে)
কৃষ্ণ: তোমার ওই নাম
রাধা: আমার নাম!
কৃষ্ণ: তোমার নামের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে তোমার নিয়তি
রাধা: কী বলছ তুমি?
কৃষ্ণ: মাত্র দুটি অক্ষরে তোমার নাম……
রাধা : সে তো তোমার ও !
কৃষ্ণ: আমার নামের প্রসঙ্গে পরে আসছি।এখন তোমার নাম। প্রথম শব্দটি ‘রা’ মানে ডাক। অনন্তকালের ডাক যে ডাক তুমি শুনতে পাচ্ছ প্রতি মুহূর্তে ।আর ‘ধা ‘ মানে ধাবমানতা।তুমি ক্রমাগত ধাবমানরতা। তোমার পথের শেষ নেই। তুমি শুনেছ অনন্তের বাঁশি। আর তুমি চলেছ অনন্তের অভিসারে।এই অভিসারের শেষ নেই রাধা।তুমি কোনওদিন পৌঁছবে না যাকে তুমি চাও, তাঁর কাছে।
রাধা : কৃষ্ণ তোমার সঙ্গে মিলন সম্ভব নয়? তোমার আমার মিলন হবে না কোনও দিন?
কৃষ্ণ: অনন্ত অভিসার।আর চীরবিলীয়মান মিলন।এর চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব নয় তোমার আমার জীবনে।
রাধা: কৃষ্ণ তুমি ইচ্ছা করলে সম্ভব করতে পারো সব।
কৃষ্ণ: না রাধা। পারি না ।আমিও বাধ্য আমার নামে নেপথ্য নিয়তির আদেশ মানতে।
রাধা: তোমার নামেও রয়েছে নেপথ্য নিয়তি?কৃষ্ণ: আছে বৈকি রাধা।রাধা : কী তোমার নিয়তি কৃষ্ণ?কৃষ্ণ: রাধা আমার নাম বহন করছে আমার গাত্রবর্ণের প্রতিভাস।আমার গায়ের রং আর আকাশের রং এক।এই রং অনন্তের।
রাধা: বুঝেছি। সেই অনন্তের আহ্বানেই আমার নিঃসঙ্গ অভিসার?নিঃসঙ্গ পথিক আমি, তা-ই তো?
কৃষ্ণ : না রাধা, আমিও যাত্রী। আমি সেই মহাকাশ, মহাবিশ্ব, তোমারই দিকে ছুটে চলেছি অনন্তকাল, কারণ তোমার বুকের মধ্যে যুগযুগান্তরের ??? ডাক আমি শুনতে পেয়েছি। এবং সেকথা তোমাকে জানিয়েছি আমার বাঁশির সুরে।
রাধা : আমার জন্য কীসের এমন টান তোমার কৃষ্ণ?
কৃষ্ণ : তোমার রূপের আড়ালে আছে আরও এক রূপ— সেই রূপ আমি দেখতে চাই রাধা। তোমার কায়ার আড়ালে আছে এক ছায়ারূপ রাধা। সেই ছায়ারূপ আমি স্পর্শ করতে চাই।
রাধা : ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ মাধুরী।
কৃষ্ণ : রাধা, তোমার গায়ের রং চুরি করেছে চাঁদের আলো। আমি সেই রঙে আদর মাখাতে চাই। তোমার ভুরু মদনের ধনু। আমার বাণ রোপণ করতে চাই। তোমার ঠোঁট ভোরের শিশির ভেজা গোলাপ পাপড়়ি। আমি চুমু খেতে চাই। তোমার স্তন সোনার বাটি উল্টে রাখা। আমি অনন্তকাল দেখতে চাই। বলো রাধা, কোন অরণ্যের সিংহ তোমাকে দিয়েছে তার কোমর?
রাধা : বলব না?
কৃষ্ণ : তাহলে বলো, তোমার ওই ত্রিবলির তিনটি ধাপ, কোমরের নিচে নেমে গেছে পিচ্ছিল অরণ্যে, জ্বলন্ত গুহার বহ্নিত অন্ধকারে? কী করে করে পৌঁছাব সেই তুরীয় তৃপ্তি ও রাগমোচনে? না কি তোমার-আমার মিলনেও জ্বলবে চিরন্তন দহন? এই যন্ত্রণার কি কোনও শেষ নেই?
রাধা : কৃষ্ণ , কেন শুধু আমাদেরই ভাগ্যে এমন হল? কেন শুধু আমাদেরই নিয়তির এমন অভিপ্রায়?
কৃষ্ণ : এই একটি প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই রাধা। সম্ভবত না জানাই ভাল।
আরও পড়ুন- যোগমায়ার জন্মদিন
শুনুন আপনারা। আমার নাম রাধা। তবে যে-কোনও রাধা নই। আমিচণ্ডীদাসের রাধা। এইমাত্র খুব ঝড় উঠেছে। আমি সেই ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেছি। আমার বান্ধবীরা, যারা আমার সঙ্গে ছিল, তারা অন্ধকারে কে কোথায় ছিটকে গেছে। আর আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই ঝড় কৃষ্ণের সৃজন। কৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়ে সব সর্বনাশ ঘটাতে পারে। এমনকী তৈরি করতে পারে মহাপ্রলয়। আমি সুন্দরী পরস্ত্রী। লোকে বলে আমি কৃষ্ণের সম্পর্কে নাকি মামি হই। এবং বয়সেও সামান্য বড়। যাকে বলে অবৈধতার সমুদ্র, আমার আর কৃষ্ণের সম্পর্ক। এবং সেই জন্যেই তো এমন আকর্ষণ, রহস্য, টান এবং উন্মাদনা।
আমি এসেছিলাম যমুনার ওপারে। একেবারে একা হয়ে গেছি। কেমন করে এই অন্ধকার ঝড়জলের মধ্যে বাড়ি ফিরব জানি না। বাড়িতে ননদিনি রায়বাঘিনি। আর স্বামী আয়ান ঘোষ। আমার স্বামীটি বেশ বোকা। চট করে রেগে যায়। আর আমাকে সন্দেহ করে কৃষ্ণকে নিয়ে। এবং মিথ্যে সন্দেহ, তা-ও তো বলেত পারি না। আর ননদিনিটি আমার স্বামীর কান ভাঙছে সারাক্ষণ। তবে মিথ্যে বলেছ, তা-ও তো নয়। এবং এই যে আমি বিপদে পড়েছি, আমি জানি কৃষ্ণ থাকলে আমাকে ঠিক যমুনার ওপারে পৌঁছে একেবারে বাড়ির দরজায় ছেড়ে দিত। এবং ওর বাঁশির সুরে আমার ভিজে কাপড়-জামাও শুকিয়ে যেত।
আকস্মিক এক কাণ্ড ঘটল। বলছিলাম না, কৃষ্ণ ইচ্ছে করলে সব পারে। সেই ঘটনার কথা লিখে গেছেন চণ্ডীদাস। আমি আমার মতো করে বলি। অন্ধকারের মধ্যে ভিজতে ভিজতে কীভাবে যে শেষপর্যন্ত এস পৌঁছলাম ঝড়ের মধ্যে তোলপাড় যমুনার তীরে, ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এসে দেখি সেখানে একটি নৌকা অপেক্ষায়। যেন আমারই জন্য অপেক্ষা করে আছে। এবং সেই নৌকার প্রাণপুরুষ স্বয়ং কৃষ্ণ! হাতে বাঁশির বদলে নৌকার হাল। এমন অপূর্ব সুন্দর মাঝি জীবনে এই প্রথম দেখলাম। উত্তাল যমুনায় নৌকা কিন্তু টালমাটাল। কৃষ্ণ বলে, রাধা উঠে পড়ো আমার নৌকায়। তোমাকে নিয়ে যেত এসেছি ওপারে। কৃষ্ণের কথায় আমি তো অবাক। কী করে জানল ও আমি বিপদে পড়েছি। কৃষ্ণ বলল, তুমি তো বিপদের মধ্যে মনে মনে আমাকেই স্মরণ করছিলে। তুমি ডাকলে আমি আসব না, তা কি হতে পারে? আমার মনের মধ্যে ঈর্ষা টনটন করে উঠল? কৃষ্ণ এমন কথা আর কোনও মেয়েকে কি কখনও বলেছে? কৃষ্ণ বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পারল। ঠিক সেই সময়ে চমকে উঠল বিদ্যুৎ। আমি এক ঝলক দেখলাম কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আহা! কী সুন্দর এক তরুণ! হেসে বলল, আর কোনও প্রণয়িনীকে মান ভাঙতে আমি কি বলেছি, প্রিয়া, তোমার পা আমার মাথায় রাখো!
আরও পড়ুন- প্রেসক্লাবে সগৌরবে প্রকাশিত হল চন্দ্রা চক্রবর্তীর ‘ছয় তারের তানপুরা’
যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে আমি কৃষ্ণর নৌকায় উঠে পড়লাম। কৃষ্ণও আমাকে তরতর করে মাঝযমুনায় নিয়ে এল। সেই তুফান আর বৃষ্টি। যেন প্রলয়। আমি ভয়ে কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরলাম। কী যে ভাল লাগছিল কৃষ্ণের সেই নিবিড় উষ্ণতা! কিন্তু কৃষ্ণ একটা অদ্ভুত কথা বলল। বলল, রাধা, তোমার গায়ের গয়নাগুলো সব খুলে ফেলে যমুনার জলে ফেলে দাও। ওই সব গয়নার ভারে নচেৎ নৌকা ডুবে যাবে! তারপর কৃষ্ণ তাকালো আমার দিকে। বলল বিদ্যুতের আলোয় তোমার ভিজে কাপড়ের ভিতর থেকে তোমার শরীররেখা যেভাবে ফুটে উঠছে মাঝে মাঝে, ওগুলোই তোমার অলংকার। তোমার অন্য অলংকারের প্রয়োজন নেই। বিদ্যুৎ চমকাতেই আমি তাকালাম আমার ভিজে পোশাকের ভিতর থেকে ফুটে-ওঠা শরীরের দিকে। সত্যিই তো, কৃষ্ণের কাছে আমার আর কিছুই লুকোবার নেই। আমি তখন একে একে আমার সমস্ত অলংকার, রত্নখচিত বিভূষণ, স্বর্ণখচিত কঞ্চুল, হিরে-পান্না শোভিত অবতংস, মণিময় আকল্প— সব ত্যাগ করলাম যমুনার জলে। কৃষ্ণকে বললাম, এই নাও আমার কণ্ঠের প্রালম্বিকা, আমার বিভাজিকায় শোভিত বিম্বকি, আর আমার হাঁসুলি, আর এই নাও আমার সোনার সাতনরি হার। কৃষ্ণ, আমি সব দিয়ে দিলাম তোমাকে। কৃষ্ণ হেসে বলল, কোথায় সব দিলে রাধা! এখনও বাকি তোমার কঙ্কণ, তোমার বলয়, তোমার বাউটি। আর তোমার স্তনের ওপর ওই চন্দ্রহার, ওটিও যে আমার চাই রাধা। তখন বললাম, কৃষ্ণ সব দেব তোমাকে, এই নাও আমার ইন্দ্রকৃষ্ণ, আর রশ্মিকল্প। এ গয়না পৃথিবীতে আর নেই, আর তৈরিও হবে না। আর এই নাও আমার বাজুবন্ধ, আমার তাবিজ, আমার মানতাসা আর রতনচূড়। তারপর আমি খুললাম আমার ভিজে কোমর আমার ভরাট নিতম্ব থেকে আমার কটিসূত্র,সুর্ণড়সনা, মেখলা। আর কৃষ্ণকে দিয়ে দিলাম আমার হিরের অঙ্গুরীয়, আমার পায়ের মঞ্জির, আমার নাভির মণ্ডন।
এবার তো সব দিয়েছি তোমাকে কৃষ্ণ, আর কী দেব? কৃষ্ণ বলল, তোমার শ্রেষ্ঠ অলংকার তো এখনো দাওনি। তোমার যৌবনের গোপন রত্নভাণ্ডার। এবার তাও খুলে দাও। রাধা বলে তা হয় না। আর সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয় কৃষ্ণ। রাধাকৃষ্ণ মুহূর্তে ভেসে যায় যমুনার তোড়ে। কৃষ্ণ রাধাকে পিঠে তুলে নেয়। কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে রাধা। এবার আর চণ্ডীদাস নন। এবার বিদ্যাপতি :
রাধা যেন এক শ্বেতসর্প, কৃষ্ণ দেবতার পিঠে ভেসে চলেছে কালো যমুনায়। এইভাবে কৃষ্ণের পিঠে রাধা ওপারে গিয়ে ওঠে। যমুনার তীরে দাঁড়ায়। সম্পূর্ণ নগ্ন রাধা। তার আর কিছুই গোপন করার নেই। মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ ওঠে। চাঁদের আলোয় যমুনার তীরে নগ্ন রাধা। কৃষ্ণ দেখে বিদ্যাপতির বর্ণনায় সেই ভিজে রাধার রূপ : রাধার কেশরাশি থেকে গড়িয়ে নামছে জল। যেন মেঘ বর্ষণ করছে মুক্তোর হার। কৃষ্ণ রাধার ভিজে মুখটি মুছিয়ে দেয়। কৃষ্ণ এবার কী দেখে? এত মুখ নয়। এ তো ‘কনয় মুকুর’ অর্থাৎ কনক আর্শি। সোনার আয়না। এবার কৃষ্ণ তাকায় রাধার দুটি ভিজে রূপের দিকে। বলে, তেই উদসল কুচনোরা/পলট বৈসায়ল কনয়া কটোরা। রাধা তোমার দুটি উদাস (উন্মুক্ত) স্তন যেন ঝলমলে দুটি উল্টে বসানো সোনার বাটি। বিদ্যাপতির নগ্ন রাধা পৃথিবীর সবচেয়ে ভিজে মেয়ে। সে-ভেজে বৃষ্টিতে। সে-ভিজছে যমুনার জলে। আর সে ভিজছে রতিশ্রমে। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে সে ভিজছে শৃঙ্গারের ঘামে। বিদ্যাপতি তাই এই ভিজে রাধার ভারি সুন্দর একটা নাম রেখেছেন। সরোবরময়ী।
কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার রতিসুখ ও রতিশ্রমের শেষ কথা কিন্তু বলেছেন জয়দেব। তাঁর ধারেকাছে কেউ আসেন না। অভিসারের কথা বলব, বলব অসতীর আনন্দের কথা, বলব প্রসাদিত পরকীয়ার কথা, আর জয়দেবকে ভুলে থাকব, তা কি হয়? তাঁকে দিয়েই এই লেখার শেষ। জয়দেব লিখেছেন, কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার মিলনদৃশ্যের অনন্য বর্ণনা :
আলগা হয়ে গেল রাধার কেশপাশ। তাঁর খোঁপার ফুল শিথিল হয়ে খসে পড়ল। তার রূপ দুটিতে দেখা দিল শিহরন। দাঁড়িয়ে উঠল বৃন্ত দুটি পলকে শিউরে উঠে। হারটি ছটফট করতে লাগল স্তনের ওপর। জঘনের চাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠল মেখলা। কৃষ্ণ ঘন ঘন চুমু খেতে লাগল। এবং তীব্র আশ্লেষে ভরিয়ে দিল রাধার আগ্রহী শরীর। রাধার চোখদুটি পরকীয়ার সুখে বুজে এল। সে মেতে উঠল রতিলাস্যে। তার ঘনশ্বাস প্রকাশ করতে লাগল অনঙ্গরঙ্গ। এবার ভাগ্যবতীর শরীর রতিশ্রমের জলে পূর্ণ হতে লাগল। রাধা কৃষ্ণের বুকে লুটিয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে আর কোনও বিভেদ থাকল না। রাধাকৃষ্ণ একাকার হল।