মাহে রমজান। হিজরি সনের ৯ম মাস। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের তৃতীয় হল রোজা। মহান আল্লাহ্পাক তাঁর বান্দাদের জন্য রোজা বাধ্যতামূলক করেছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান মাসে উপস্থিত থাকবে, বর্তমান থাকবে, তার উপর রমজান মাসের রোজা রাখা অবশ্য-কর্তব্য।’ তাঁর নির্দেশমতো ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এই মাস জুড়ে রোজা বা সিয়াম সাধনায় ব্রত থাকেন। সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে নির্জলা উপবাস। রোজা পালন সমাজে সাহায্য-সহযোগিতা, সমবেদনা তথা সহমর্মিতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। ধনীরা গরিবের দুঃখ অনুভব করবে, বুঝবে ক্ষুধা-পিপাসার জ্বালা। উপলব্ধি করবে, কেন অন্নহীন মানুষ একমুঠো খাবারের জন্য অন্যের কাছে হাত পাতে। খাবারের জন্য কেন তারা মান-ইজ্জত বিকিয়ে আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়? এই এক মাস ধরে তারই অনুভূতি জাগ্রত করে রোজা, শেখায় সামাজিক দায়বদ্ধতার নানা দিক। তাই তো প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলে গিয়েছেন, ‘এ মাস (রমজান) সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস।’
আরও পড়ুন-আনন্দ বসন্ত
রাত শেষের সৌন্দর্য
ফজরের সময় শুরুর পূর্ববর্তী মূহূর্তের খাবার খাওয়াকে বলা হয় ‘সাহরি’। সাহরি শব্দটি আরবি ‘সাহর’ থেকে উদ্ভূত। সাহর শব্দের অর্থ হল রাতের শেষাংশ বা ভোররাত। আর সাহরি অর্থ হল শেষ রাতের খাবার। বাংলা উচ্চরণে অনেকেই সেহেরি বলে থাকেন। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও; নিশ্চয় সাহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত নিহিত আছে।’ এই সময় ভোরে মসজিদে-মসজিদে মাইকে জানান দেওয়া হয় সেহেরির সময়সীমা, বলা হয় কোন সময় পর্যন্ত সেহেরি খাওয়া যাবে। ভোরের তিলোত্তমা তখনও থাকে জেগে৷ বিশেষ করে জাকারিয়া স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, জানবাজার, পার্কসার্কাস, তপসিয়া, খিদিরপুর, মোমিনপুরের মতো এলাকাতে শেষরাতের সৌন্দর্য নজর কাড়ে। একটা কঠিন সংযমকে বাস্তবে রূপায়িত মানুষের উৎসাহ সত্যিই চমৎকৃত করে। গ্রামগঞ্জে এখনও পাড়ার কমবয়সি ছেলেরা দলবেঁধে ভোরে বের হয় মানুষকে জাগাতে। তারা হাঁকতে থাকে,
‘… ওঠোরে মুসলিম, জাগোরে জাগো, তিরিশে রোজা সেহেরি খাবে’। সেই ভোররাত থেকেই শুরু হয়ে যায় রোজার সুন্দর পরিবেশ।
আরও পড়ুন-‘গণতান্ত্রিক ভারত’ আজ ‘বিরোধাভাস’
দিন শেষের আনন্দ
সূর্যাস্তের পরবর্তী সময়ের খাওয়াকে বলা হয় ইফতার। আরবি শব্দ ইফতারের অর্থ রোজা ত্যাগ করা। নিজে ইফতার করার পাশাপাশি অন্যকে ইফতার করানোর মধ্যে প্রচুর সওয়াব বা পুণ্য ও বরকত নিহিত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ রোজাদার ব্যক্তিকে একটি মাত্র খেজুর বা পানি দ্বারা ইফতার করালেও সে সমপরিমাণ সওয়াব বা পুণ্য লাভ করবে। এতে রোজাদারের সওয়াবের কোনও কমতি হবে না বরং আল্লাহ্ নিজের রহমতের ভাণ্ডার থেকে এ সওয়াব প্রদান করবেন।’ সারাদিনের উপবাসের ক্লিষ্ট যাতনার অবসানে যখন ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন আর তর সয় না। দিনের শেষে ইফতারের অপেক্ষা করা সত্যি এক অদ্ভুত আনন্দের মাত্রা জোগান দেয় রোজাদারদের। পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়তেই বাড়ির সকল সদস্য বসে পড়েন ইফতারের থালি সাজিয়ে। শহরাঞ্চলের ফুটপাত বা বাজারে দেখা যায় নানাররকম ফলে সাজানো খাঞ্চাভরা (বড় থালা) ইফতারসামগ্রীকে সামনে রেখে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছেন রোজাদাররা। এমন সময় আশপাশের মানুষ বা পথচলতি রোজাদারও তাদের সঙ্গে খুব সহজেই শামিল হয়ে যান। এই তো সময়, যখন ইফতারের দস্তরখানে ধরা দেয় ধনী-গরিবের হাত একই খাবারের থালায়।
আরও পড়ুন-কড়া পদক্ষেপ নিল রাজ্য, ২৩ হাজার শিক্ষককে শো-কজ, অনুপস্থিত কর্মীদের বেতন কাটার নির্দেশ
জৈব বিষ দূরীকরণ
পৃথিবীর অনেক ধর্মে উপবাস বা রোজা রাখার বিধান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে রোজা কল্যাণকর। মুহাম্মদ (সাঃ) আগেই বলে গেছেন, ‘খাবার পেট ভরে খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করার চেষ্টা করুন। পেটের একভাগ খাবার, একভাগ পানি ও আরেক ভাগ খালি রাখুন।’ যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, দেহের বেশিরভাগ রোগের সৃষ্টি হয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ফলে। নিত্যদিনের খাবার, অতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ার কারণে শরীরে একপ্রকার জৈব বিষ জমা হয়। এই বিষগুলো আমাদের শরীরের ঘাম, মল, মূত্রের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত বিষের কারণে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের এইসব বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো নির্মলকরণের জন্য পরিপাক যন্ত্রকে মাঝেমধ্যে খালি করা প্রয়োজন। তাই রোজার ফলে পাকস্থলীকে খালি রাখার কারণে দেহের অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ ও সঞ্চিত বিষাক্ত জৈব ঘাম, মল, মূত্রের সঙ্গে বের হয়ে যায়। রোজা মানবদেহে অটোফেজি সিস্টেম পরিচ্ছন্ন করে৷ দেহের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার নাম অটোফেজি। এর মাধ্যমে দেহের অপ্রয়োজনীয় কোষগুলো ধ্বংস ও পরিচ্ছন্ন হয়— অর্থাৎ কোষের আবর্জনা পরিচ্ছন্নকরণ প্রক্রিয়াও বলা যেতে পারে। রোজা রাখলে দীর্ঘ সময় দেহে খাবার বা পানীয় প্রবেশ করে না— দেহের যে অবস্থায় অটোফেজি সক্রিয় হয়।
আরও পড়ুন-হাতির উপদ্রব রুখতে খাদ্যভাণ্ডার
অটোফেজির মাধ্যমে এ-সময় দেহ সচল থাকে। এই প্রক্রিয়ায় দেহ তখন প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে। অর্থাৎ বাইরের খাবারের ওপর দেহ তখন নির্ভর করে না। নিজেই নিজের রসদ সৃষ্টি করে এবং শক্তি জোগায়। রোজা রাখলে ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এটি সক্রিয় হয়ে থাকে। এছাড়া শরীরের মেদ কমাতে রোজা অনেক কার্যকর। রোজা রাখার কারণে মানবদেহে বিপাক ক্রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কারণ রোজা পালনকালে মানবদেহে স্ট্রেস হরমোন করটিসোলের নিঃসরণ হ্রাস পায়। অপরদিকে রোজা রাখার ফলে কর্ম-উদ্দীপনা ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি পায়।
পবিত্র রমজানের অন্য একটি ইবাদত হল তারাবি নামাজ। অতিরিক্ত এই নামাজ কেবলমাত্র রমজান মাসে পড়া হয়। নামাজ হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও শরীরের পেশি মজবুত করে। মেরুদণ্ড-সহ শরীরের অন্যান্য সংযোগস্থল নমনীয় করে ও রক্তপ্রবাহকে ক্রিয়াশীল করে। তারাবি নামাজের জন্য শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অনেক বেশি নড়া-চড়া করে। ফলে রক্ত চলাচল ও শ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়। গবেষকরা বলছেন, পিঠ, জয়েন্ট ও মাংসপেশিতে যত ব্যথাই থাকুক না কেন, তার উচিত তারাবি পড়া।
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে অচেতন পাইলট, বিমান নামালেন যাত্রী কাম পাইলট
সহনশীল সমাজ গঠন
রমজান মাসে কঠোর সিয়াম-সাধনার মাধ্যমে রোজাদাররা অপরের বদনাম থেকে দূরে থাকেন। তাঁরা ঝগড়া-বিবাদ, অযথা বাগ্বিতণ্ডা ও যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের মুখ থেকে অশ্লীল কথাও বেরোয় না। সমাজের স্থিতিশীলতা, শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি মাহে রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দল–মতনির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনওরকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। মুহাম্মদ সা. এ-বিষয়ে বলে গিয়েছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনও দিন রোজা রাখে, তখন তার মুখ থেকে যেন কোনওরকম খারাপ কথা বের না হয়।’ তিনি এমনও সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘‘যদি কেউ তাকে গালিগালাজ করে বা ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় তখন সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার ব্যক্তি।’’ বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায়, কোনও রোজাদার লোককে কেউ গালিগালাজ ও ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায়, সেই রোজাদার যদি উত্তেজিত না হয়ে ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে সরে যান, তাহলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় না এবং একটি আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-হাতির উপদ্রব রুখতে খাদ্যভাণ্ডার
গরিবের হক আদায়
রমজানে সমাজের অবহেলিত–বঞ্চিত মানুষের জন্য সাহায্য, দান–খয়রাত, ফিতরা–জাকাত ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জাকাত হল ফরজ৷ ধনীদের জন্য বাধ্যতামূলক এই বিধান ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ৷ জা)কাত করুণার দান নয়, দয়া–দাক্ষিণ্যও নয়। এই পাওনা বঞ্চিতদের অধিকার। ঠিক যেমন নির্দিষ্ট আয়ের মাত্রা উত্তীর্ণ হলে সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়, ইসলামেও তেমনই বিধান রয়েছে৷ কোনও ব্যক্তির আয় বা সঞ্চয়ের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে তার একটি অংশ অসহায়, হতদরিদ্র, দুর্বল, পীড়িত, এতিমদের সাহায্য করতে হবে৷ আল্লাহ্পাক কোরআন–এ বলেছেন, ‘তাদের সম্পদে বঞ্চিতদের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে’৷ সেজন্য বহু মানুষ এইসময় সমাজের অসহায় গরিব-দুঃখী, এতিম-মিসকিন ও নিরন্ন মানুষের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁদের জন্য সেহরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দান-খয়রাত, জাকাত-সাদকা প্রদান-সহ বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। প্রিয় নবি সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ-মাসে একটি কল্যাণময় কাজের মাধ্যমে আল্লাহ্ নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবে, সে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে এবং যে-ব্যক্তি এ-মাসে একটি ফরজ ইবাদত আদায় করবে সে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আমলের সওয়াব পাবে।’
আরও পড়ুন-মেরামতির পরেও শিয়ালদহে দুর্ভোগ
সারা বছরের দিশারি
সমাজের প্রত্যেক মানুষ যদি রমজান মাসের মতো সারাবছর আত্মসংযমের সঙ্গে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে তো কোনওরকম সামাজিক বিশৃঙ্খলাই তৈরি হয় না! সমাজজীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এবং সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববন্ধনের ক্ষেত্রে তাই রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে রোজার মধ্যে দিয়ে ধনী ব্যক্তিরা যেহেতু গরিবের দুঃখ-কষ্ট এবং অনাহারের জ্বালা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করেন সেজন্য হয়তো অসহায়, হতদরিদ্র ও দুস্থদের প্রতি অত্যন্ত সদয় আচরণ করেন। সারা বছরই যদি একে অপরের প্রতি সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখায় সেটাই হল মাহে রমজানের আসল শিক্ষা।
আরও পড়ুন-নীতু-সুইটির জোড়া সোনা, অভিনন্দন মুখ্যমন্ত্রীর
অবশেষে খুশির উৎসব
টানা একমাস রোজা পালনের পর সেই খুশির দিনের অপেক্ষায় থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা৷ উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে বিশ্বজাহান৷ অনাবিল আনন্দ ও উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় ঈদ–উল–ফিতর। তাই তো কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ইসলামি গানের মধ্যে আনন্দ-খুশির বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছেন—
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ,
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।…’