যে-কোনও দাঙ্গা বা হিংসার প্রতিক্রিয়ায় শাসক যদি নীরব থাকে, তাহলে ঘাতকেরা, দাঙ্গাকারীরা আরও উৎসাহ পায়। প্রবল উদ্দীপনায় তারা আরও জঘন্য অপরাধ সংঘটনে প্রণোদিত হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এবং এটাই দেখা গিয়েছে মণিপুরে, নরেন্দ্র মোদির নীরব মোদি হয়ে থাকার সৌজন্যে।
আরও পড়ুন-ন্যাটোয় সুইডেনের যোগদানে কোনও আপত্তি নেই তুরস্কের
নরেন্দ্র মোদির কথা না হয় বাদই দিলাম। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বে রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকাটাই বা কী?
আসলে মিথ আর মহাকাব্য থেকে গালগল্প বানিয়ে ‘ইতিহাস’ নির্মাণে ওঁদের যা উৎসাহ, তার দু’শতাংশও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে কিংবা বিভিন্ন জনজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বার্থে উদ্যোগ কিংবা পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে নেই। ইম্ফলের মাটিতে পা রাখলেই এখন এটা যে কেউ টের পাবে।
আরও পড়ুন-অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কড়া বিরোধিতায় তেলেঙ্গানা মুখ্যমন্ত্রী
মহাকাব্যিক ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মণিপুরকে ব্যবহার করার ব্যাপারে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়াপক্ষের কোনও কালে কখনও উৎসাহের অভাব ছিল না। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের চতুর্থ পত্নী চিত্রাঙ্গদার জন্মস্থান মণিপুর। তাই আপামর মণিপুরবাসী অর্জুন- চিত্রাঙ্গদার বংশধর, এমন তত্ত্ব প্রচারে কদাচ অনাগ্রহ দেখায়নি এই গেরুয়া পক্ষ। এমনকী উত্তর-পূর্ব ভারতে মণিপুরের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতেও মহাভারতীয় সূত্র অণ্বেষণের কাজে তাদের তৎপরতার কোনও অভাব ঘটেনি। এই কারণেই তারা অরুণাচল প্রদেশের ইদু মিশমি উপজাতির মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পত্নী রুক্মিণীর পূর্বপুরুষদের খুঁজে পেয়েছে। কিংবদন্তিকে ইতিহাস হিসেবে চালানো ও গেলানোর কাজেই ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি ও তার সহচররা সর্বশক্তি ব্যয় করেছে।
আরও পড়ুন-লক্ষ্যর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
মেরুকরণের প্রণোদনায় এই অনৈতিহাসিক ইতিহাস অণ্বেষ, হিন্দুত্ববাদের এই ন্যারেটিভই মণিপুরের বিভিন্ন ধর্মীয় ও কৌম গোষ্ঠীকে তাদের শিকড়ের বিষয়ে অতিমনস্ক করে তুলেছে। তুই বনাম মুই মানসিকতা জাঁকিয়ে বসেছে সেখানকার মানুষের মধ্যে। জনজাতিগুলোর মধ্যে বিদ্বেষ-বিষ ঘনীভূত হয়েছে। তারই পরিণতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।
৩ মে থেকে শুরু-হওয়া হিংসার তাণ্ডবে রাজ্যটি সম্পূর্ণ অচলাবস্থায় কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী, উভয়েই হিংসার রাশ টানতে ব্যর্থ। ফলত, পাহাড় ও সমতল, উভয় অঞ্চলের মানুষই জীবন ও জীবিকা হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত। মেরুকরণের তীব্র বিষ মেইতেই ও কুকিদের পারস্পরিক বিশ্বাস লুপ্ত করে ছেড়েছে। তারা নিরন্তর একে অপরকে অবিশ্বাসের চোখে দেখছে। প্রশাসনের মলমে এই ব্যাধির উপশম দুরাশামাত্র।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের ৫ টি ম্যাচ আয়োজনের দায়িত্বে ইডেন গার্ডেন্স
সরকারি হিসাব বলছে সেনাবাহিনী ও আধা সাররিক বাহিনীর প্রায় ৬০ হাজার জওয়ান মণিপুরে মোতায়েন করা হয়েছে। তবু যুযুধান পক্ষগুলোর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়নি। হিংসার অবসান হওয়ার কিংবা স্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রত্যাবর্তনের নূন্যতম আভাসও পাওয়া যাচ্ছে না, কোনও পক্ষই শান্তি প্রক্রিয়ার কথাবার্তা শুরু করতে আগ্রহী নয়। সেনাবাহিনীর ভয় দেখিয়েও সেটা করা যাচ্ছে না। লক্ষণীয়ভাবে প্রতিপক্ষ জনজাতির ঘর ভেঙে ফেলেই কোনও পক্ষ শান্ত হচ্ছে না, ঘরটার ভিতটাও তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে ওই বাসিন্দা তাঁর ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করতে না পারেন কিংবা সেখানে পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা করতে না পারেন। মেইতেইরা সমতলে ও কুকিরা পাহাড়ি এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। উভয় অঞ্চলেই যারা সংখ্যালঘু, অর্থাৎ সমতলে কুকিরা এবং পাহাড়ি এলাকায় মেইতিরা দলে দলে এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন। এই এলাকা-ছাড়াদের মধ্যে কেবল গরিব-গুর্বো, অশিক্ষিতরাই রয়েছেন তা কিন্তু নয়। আমলা, রাজ্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও রয়েছেন। ফলে এমন বাস্তুহারা হওয়ার ঘটনা রাজ্য প্রশাসনকে অকেজো করে ছেড়েছে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় বাহিনীর মারে গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে দুই তৃণমূল কর্মী
মেইতিরা বলছেন, কুকিরা গেরিলা স্টাইলে আক্রমণ শানাচ্ছে। আর কুকিরা বলছেন, ওদের না তাড়ালে এলাকায় শান্তি পুনঃস্থাপিত হবে না, তাঁদের ভাষায় ‘SOS’ (Separation the only Solution) হল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। মণিপুর সামান্তবর্তী রাজ্য। সেই রাজ্যে এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বিপজ্জনক, এই সহজ সত্যিটা মোদি-অমিত শাহরা বুঝেও বুঝছেন না। ফলে তাঁদের নীরব ঔদাসীন্যের সৌজন্যে মণিপুরে হিংসা অব্যাহত।
ইন্টারনেট বন্ধ রাখার রাজ্যের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এই হিংসাদীর্ণ রাজ্যে। বিষয়টা অবহিত হওয়ায় পর মণিপুর হাইকোর্ট আংশিক ভাবে ইন্টারনেট চালু করার পক্ষে রায় দিয়েছিল, রাজ্য সরকার সেই নির্দেশ পালনের ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। সুপ্রিম কোর্টে সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা ঠুকে তারা তাদের মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন-স্পর্শকাতর বুথের তালিকা নিয়ে BSF-এর অভিযোগ খারিজ রাজীবের, জানালেন সুষ্ঠুভাবে চলছে গণনা
শিবিরে-শিবিরে কমপক্ষে ৫০ হাজার ঘরছাড়া আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে কান পাতলেই আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে বিনিদ্র রজনী যাপনের কথা শোনা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। পঠন-পাঠন শিকেয় উঠেছিল। সবেমাত্র গত সপ্তাহে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস শুরু হয়েছে।
ইম্ফলের কাছেই, কাঞ্চিপুরের গির্জা ও তৎসংলগ্ন স্কুলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিমানবন্দরের কাছে সাঙ্গাইপ্রৌতে গির্জায় ভাঙচুর হয়েছে। রাজ্যের বহু মন্দিরও ধূলিসাৎ করে দিয়েছে দাঙ্গাকারীরা। দাঙ্গার এই প্যাটার্ন, ধর্মস্থান ধ্বংসের এই প্রবণতা বুঝিয়ে দিচ্ছে দাঙ্গাকারীরা ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণের শিকার। আর নিঃসন্দেহে তার পেছনে, এই অসহিষ্ণুতার আবহ রচনার মুখ্য কারিগর মেরুকরণজীবী গেরুয়া পক্ষ।
এই ধ্বংসলীলা, এই হিংসার তাণ্ডব যদি অব্যাহত থাকে তবে মণিপুরও অচিরেই চির অশন্তিমুখর রাজ্যে পরিণত হবে। উত্তরের কাশ্মীরের মতোই উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর হয়ে উঠবে অত্যন্ত অশান্তির আঁতুড়ঘর। আর এ-নিয়ে কেন্দ্রের শাসকপক্ষ, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুখে কুলুপ আঁটাটাই শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে মনে করেন, তবে আরও কতিপয় জনজাতি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মুখর হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন-গ্রাম বাংলায় জিতছে তৃণমূল! বাংলা জুড়ে ঘাসের ফুল, জানালেন দেবাংশু
পশ্চিমবঙ্গে ভোট-হিংসা দেখার জন্য আমাদের রাজভবনের বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে শেলি, শেক্সপিয়ার আওড়াতে আওড়াতে দিল্লি থেকে গ্রাম-বাংলার নানাস্থানে ছুটে-ছুটে বেড়াচ্ছেন। মণিপুরের রাজ্যপালের এরকম তৎপরতা নেই কেন? সেখানে ডবল ইঞ্জিন সরকার বলে?
পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম আসছে। তারা কি মণিপুরের রাস্তা চেনে না। কেন? সেখানে ডাবল ইঞ্জিন সরকার বলে?