… রাস রসও গোরাচাঁদও চাঁদও হে…

আগামী মঙ্গলবার হল রাস পূর্ণিমা। রাসনৃত্য মণিপুরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্রুপদী ধারার এক অপূর্ব শৈল্পিক সৃষ্টি। সেখানকার রাজার হাতেই শুরু হয়েছিল এই অপূর্ব উৎসবটি। রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহর উদ্যোগে মণিপুর রাজ্যে প্রথম রাসলীলা মঞ্চস্থ হয় ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে। সেই রাসেই রাজকন্যা বিম্ববতী রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন। মণিপুরের রাস নিয়ে লিখলেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

‘‘অগৌর চন্দন চুয়া দিব কার গায়।
পিয়া বিনু হিয়া মোর ফাটিয়া যে যায়।।
তাম্বুল কর্পূর আদি দিব কার মুখে।
রজনী বঞ্চিব আমি কারে ল’য়া সুখে।।
কার অঙ্গ পরশে শীতল হবে দেহা।
কান্দিয়া গোঙাব কত না ছুটিল লেহা।।
কোন্ দেশে গেল পিয়া মোরে পরিহরি।
তুমি যদি বল সই বিষ খাইয়া মরি।।”

আরও পড়ুন-বিরোধী দলনেতার সঙ্গীরা দলবেঁধে তৃণমূলে: “আগে ঘর সামলা, পরে ভাববি বাংলা”, বিজেপি কটাক্ষ কুণাল ঘোষের

ভারতবর্ষে নাট্যাভিনয় এবং নৃত্যগীত নির্ভর রাস উৎসবের প্রবর্তন করে ছিলেন মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ (১৭৪৮-১৭৯৯)। তিনি রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে সাজান। রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহর উদ্যোগে মণিপুর রাজ্যে প্রথম রাসলীলা মঞ্চস্থ হয় ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে। সেই রাসেই রাজকন্যা বিম্ববতী রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন। আর রাজা নিজে মৃদঙ্গবাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
জনশ্রুতি আছে, মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে রাসলীলা করার তাগিদ পান। জাঁকজমকপূর্ণ আর শৈল্পিক কারুকার্য খচিত রাসের পোশাকগুলোও তিনিই নাকি স্বপ্নে দেখেছিলেন বলে মণিপুরী লেখকরা জানান। রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে রূপ দিতে তিনি অহর্নিশ পরিশ্রম করেছিলেন। পঠনপাঠন ধ্যান করতে করতে তিনি মন্দিরেই ঘুমিয়ে পড়তেন শোনা যায়। রাসের নাচ, গান, সুর, তাল আর মুদ্রাগুলোকে তিনি একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। তার নাম ‘গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস’। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধ হয়। মণিপুরী নৃত্যধারা উৎসবের আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়। এর প্রধান কারণ রাধাকৃষ্ণের লীলা।

আরও পড়ুন-জামা খুলিয়ে অত্যাচার করেছেন বিজেপি নেতা লোকনাথ, বিস্ফোরক যুব মোর্চা কর্মী

রাসপূর্ণিমা উৎসবটি মণিপুরী আদিবাসীদের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী লোক উৎসব। বছর বছর কার্তিক পূর্ণিমাতে এই লোক উৎসব পালন করা হয়। রাস উৎসব উপলক্ষে আজও আয়োজন করা হয় রাসনৃত্যের। রাসনৃত্য মণিপুরী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্রুপদী ধারার এক অপূর্ব শৈল্পিক সৃষ্টি। মণিপুরীদের রাসলীলাটি একটি নাট্য আঙ্গিক। ক্লাসিক্যাল নাট্য আঙ্গিক। মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এই ঐতিহ্যগত লোকনৃত্যই কালক্রমে ধ্রুপদী নৃত্যধারায় পরিণত হয়েছে। মণিপুরীদের রাস আর রাসের থিম আজকে ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্যান্য রাসের চেয়ে আলাদা। মণিপুরী পুরাণ লেখকরা বলেছেন, মণিপুর রাজ্যই হল সেই স্থান যেখানে রাধাকৃষ্ণের অনুস্মরণে শিব পার্বতী রাসলীলা করেছিলেন। পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী মণিপুরের কৌব্রু পর্বতকে রাসলীলার উপযুক্ত করে তোলার জন্য শিব, সূর্য, চন্দ্র এবং পাঁচটি গ্রহকে আহ্বান করেছিলেন। সাতদিন সাতরাত শিব-পার্বতীর রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন গন্ধর্ব এবং অন্যান্য দেবতাগণ। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য কথিত আছে, নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দান করেন। কথিত আছে, নাগদেবের মণির নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় মণিপুর।

আরও পড়ুন-গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হলদিয়ার ৫৪টি কারখানায় আইএনটিটিইউসি ইউনিট হবে

দ্বাদশ শতকে শৈব ধর্মের প্রকট প্রভাব ছিল এই অঞ্চলে। ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকেরা এরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা ভিন্নমতের গ্রন্থাদি এবং নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়। মণিপুরের বৈষ্ণবরাও শিবকে শ্রদ্ধার পাশাপাশি পুজোও করত। শিব-পার্বতীর লীলাভিত্তিক গীত আর নৃত্য থেকে যায় রাসে। তারপর ইতিহাসের এক সময়ে বাংলার ভাবান্দোলন যখন মণিপুর গিয়ে পৌঁছয় তখন বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচনাবলি মণিপুরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলির উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় মণিপুরী রাসলীলার নতুন আঙ্গিক। ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার সঙ্গে মণিপুরের লোকনৃত্যের সংমিশ্রণে গড়ে উঠে এই নতুন ক্লাসিক্যাল শিল্পআঙ্গিক। সে সময় রাধাকৃষ্ণের দর্শন গিয়েছিল বঙ্গ থেকেই।

আরও পড়ুন-শ্রমিকদের স্বার্থে, সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে কাজ করছে তৃণমূল

মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে থেকে শূরু করে নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে সর্বত্র রয়েছে রাজকীয় গাম্ভীর্য। রাসের পোশাকের নাম ‘পল্লই’। এটি কমপক্ষে ১০টি ভাগে বিভক্ত। মাথার উপরিভাগে থাকে ‘কোকতোম্বি’। মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ ওড়না ‘মেইখুম্বী’। গায়ে থাকে কারুকাজ করা ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ ‘ফুরিৎ’। কোমর পর্যন্ত থাকে ‘থাব্রেৎ’। পল্লইয়ের মুল অংশের নাম ‘কুমিন’। আর থাকে পেশোয়ান, খোওল, খাঙ্গই । মণিপুরী স্বর্ণালঙ্কারের সঙ্গতে পুরো সাজ মনোমুগ্ধকর।
মণিপুরী রাসের শুরুতে রাজা ভাগ্যচন্দ্রকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলা হয়, ‘রাস আরম্ভিলা ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’। এরপর থাকে বৃন্দা নর্তন ও কৃষ্ণ নর্তন। ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণ অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মণ্ডলী সজ্জা, গোপীদের রাগালাপ, কৃষ্ণ-রাধা নর্তন এরকম কয়েকটি পর্বে থাকে মণিপুরী মহারাসে। টানা সাত থেকে আট ঘণ্টা এই নৃত্যগীত চলে একটু সময়ও না থেমে ৷

আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশ: বাসের সঙ্গে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত বহু

মণিপুরী রাসের গানগুলিও বাংলা আর ব্রজভাষা। অধিকাংশই বাঙালি বৈষ্ণব পদকর্তাদের লেখা ৷
রাসলীলা যেটি ছিল দ্বাপর যুগের ঘটনা। সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম, সেটাই এই যুগে পূণ্যতিথি রাসপূর্ণিমা। শাক্তরা পূর্ণিমার এই দিনে দেবদেবীদের নানান মূর্তি বানিয়ে পুজো দিত। নবদ্বীপের রাস উৎসবে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে রাখা হত। তাই রাসপূর্ণিমার আরেক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে চারপাশে অষ্টসখীর মূর্তি বসানো হয়। সেই চাকার সঙ্গে অষ্টসখীদের ঘোরানো হত। এই ছিল রাস। এই রীতি এখনও রয়েছে বাংলায়।
শ্রী রাধার শৈশব আর যৌবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ‘অষ্টসখী’। বিশ্বাস করা হয় যে সমস্ত অষ্টসখীরাই রাধা-কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। আর আটজন সখীর মধ্যে ললিতা এবং বিশাখা বিশিষ্ট ছিলেন।

আরও পড়ুন-লড়াই করে আবার ফিরে আসব, বললেন ইমরান

শ্রীকৃষ্ণের অষ্টসখী হচ্ছে, ললিতা, বিশাখা, চিত্রা, ইন্দুরেখা, চম্পকলতা, রঙ্গদেবী, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবী। আজও কার্তিক পূর্ণিমার রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাঁদের প্রাণের উৎসব রাস উদযাপিত হয়। তাই তাঁদের সাধনভজন কুটিরের নিকোনো উঠোনে আলপনা দিয়ে, উঠোনের পূর্ব কোণে টাঙানো হয় ছোট্ট একখানি চাঁদোয়া। তার নিচেই রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ রাখা হয়। কোথাও কোথাও রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির চারদিকে রাখা হয় অষ্টসখীকে। বড় মায়াময় সে মূর্তি এবং পরিবেশটি। উঠোনের এক কোণে মঞ্জরী ভরা তুলসীগাছের ঝাড় রাখা হয়। কার্তিকের জ্যোৎস্নার দুধ-সাদা আলোয় আটপৌরে ভজন প্রেমের চেনা পরিবেশ কেমন যেন অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। কাঠের ছোট সিংহাসনে বসানো হয় যুগল বিগ্রহের চারপাশে গোল করে সাজানো অষ্টসখীর মূর্তি। পরনে জমকালো পোশাক। সামনে ফরাস পাতা। তাতে সাজানো মৃদঙ্গ, মন্দিরা, হারমোনিয়াম, করতাল এবং আড়বাঁশি। সুগন্ধী ধূপ, আতর এবং ফুলের গন্ধে ম ম করে চারপাশ। এমনই পরিবেশেই অষ্টসখীর নামকীর্তনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়, পদাবলি রাসলীলা পরিবেশন, আরতি। এতেই অন্তরমহল জেগে ওঠে যেন। বীরভূমের ময়নাডালের প্রভাত মিত্রঠাকুর ও নদিয়ানন্দন মিত্র ঠাকুরও এই রাসের পদ গাওয়াতে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁদের রাসের নৃত্য ও গানের জন্য, তাঁরা বিভিন্ন রাস উৎসবে গাইতে যেতেন। তাই তাঁদের অষ্টসখীর নামকীর্তনের নিজস্ব ঘরানা তৈরি হয়েছিল মণিপুরেও।

Latest article