ঐন্দ্রিলা স্মরণে

গত বছর ঠিক এই সময় চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা। তারপর একটি বছর অতিক্রান্ত। মেয়েকে তাঁর স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চান মা শিখা শর্মা। আগামী ২০ নভেম্বর তাঁর প্রয়াণবার্ষিকী। এই উপলক্ষে বললেন অনেক কথা। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অনেক স্বপ্ন ছিল তাঁর জীবন নিয়ে। এতটুকু বয়সে করেও ফেলেছিলেন অনেককিছু। জীবন তাঁকে বারবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, বিদ্রুপ করেছে, কিন্তু তিনি থেমে যাননি। অ্যাকসেপ্ট করেছেন সেই চ্যালেঞ্জ। বার বার ফিরে এসছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। উঠে দাঁড়িয়েছেন। এই ইট-কাঠ-পাথরের যুগে দাঁড়িয়েও তাঁর ভালবাসা হয়েছিল উদাহরণীয়। তিনি অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্ম। মাকে ছাড়া জীবন এক মুহূর্ত ভাবতেই পারতেন না তিনি। ছোট্ট থেকে ধাপে ধাপে বড় হবার অজস্র মুহূর্ত মা-মেয়ের। মা শিখা শর্মা করলেন স্মৃতিচারণ।

আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে চলছে শেষ দফার ভোট, ২৩০ কেন্দ্রে নির্বাচন হচ্ছে মধ্যপ্রদেশে

অলরাউন্ডার এক মেয়ে
ছোট্ট থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত ঐন্দ্রিলা। এক কথায় অলরাউন্ডার। গান-বাজনা থেকে শুরু করে আঁকাজোকা, আবৃত্তি, নাচ এবং খেলাধুলো সবেতেই সেরা। আবৃত্তিতে রাজ্যে প্রথম হওয়া মেয়ে হিসেবে পেয়েছিলেন স্বীকৃতি। খুব ভাল নাচ করতেন। বহরমপুরের এমন কোনও স্টেজ নেই যেখানে ঐন্দ্রিলা পারফর্ম করেননি। ওঁকে ছাড়া সব অনুষ্ঠান ছিল অচল। দারুণ গান করতেন। ছিলেন খুব ভাল অ্যাঙ্কর। ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টসে খেলেছেন তিনি। বহরমপুর কাশীশ্বরী গার্লস হাইস্কুল থেকে পড়াশুনো। এরপর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতা আসা। কিন্তু মজার বিষয় ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নয় ঐন্দ্রিলার স্বপ্ন ছিল অন্য। চেয়েছিলেন অভিনেত্রী হতে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে ইন্টার কলেজ বিউটি কনটেস্টের বিজয়ী হন। সেখানেই চোখে পড়ে যান অনেক নামী মানুষের। অডিশন দিয়েছিলেন। প্রথমবারেই সিলেক্ট হয়ে যান। তখন তিনি ক্যানসার সার্ভাইভার।

আরও পড়ুন-মিধিলির ল্যান্ডফল বাংলাদেশে, সামান্য বৃষ্টি বিভিন্ন জেলায়

ছোট থেকেই বেশ ডানপিটে ঐন্দ্রিলা। মাঝে মধ্যেই গার্জেন কল হত। মা হয়ে যেতেন নাজেহাল কিন্তু ঐন্দ্রিলা প্রতিবাদী তাই অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। মেয়ের জন্য গর্বিত হতেন মা। মা ছিল তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন খুব সুন্দর। কাজের প্রতি ছিলেন ডেডিকেটেড। দিদি, বাবা, মা সবার ছিলেন ভরসা।
যখন মারণব্যাধি বাঁধল বাসা
তখন ক্লাস ইলেভেন। একদিন পাশপাশি শুয়ে চলছিল মা-মেয়ের জন্মদিনের প্ল্যানিং। কী রান্না হবে, মাকেই যে পায়েসটা করতে হবে। আর বন্ধুদের জন্য থাকবে বিকেলটা বরাদ্দ। বরাবরই ঘরকুনো ঐন্দ্রিলা। পরিবারকেন্দ্রিক। কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে মাকে পেটে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘মা দ্যাখো কেমন শক্ত।’

আরও পড়ুন-তৃণমূল নেতা খুনে ৫ লাখি সুপারি, ধরপাকড়

পাতলা ছিপছিপে সুন্দর মেয়েটার পেটে হাত রেখেই মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। একটা শক্ত লাম্প মতো। তিনি যে নার্স। বহু বছরের অভিজ্ঞ। তাঁর ভাল লাগল না। তখন স্বামীকে ডেকে দেখালেন। বাবা একটি হাসপাতালের ইনচার্জ। বললেন, ‘ও কিছু না, মাসল হার্ড হয়ে যায় খেলাধুলো করলে, তাই হয়তো শক্ত।’ কিন্তু মায়ের মনের আশঙ্কা কমছে না। স্বামীকে আবার বললেন দেখতে। এবার বাবা মেয়ের পেটে হাত দিয়ে দেখলেন। দেখার পর চুপ করে গেলেন। একটাও কথা বললেন না। তারপর থেকে দুজনেরই অস্বস্তিতে ভোগা শুরু। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। পরের দিনই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আলট্রাসোনোগ্রাফি এবং একটা সিটি স্ক্যান। তাতেই জানা গেল ক্যানসার বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। আর দেরি করেননি শিখা দেবী। সোজা চলে গেলেন দিল্লি এইমস-এ। সেখানে গিয়ে জানা গেল টিউমারটা অনেকটা বড়। এই রোগটির সঙ্গে তিনি বেশ পরিচিত কারণ তাঁর মা-ও যে ক্যানসার সার্ভাইভার। তিন-তিনবার ক্যানসার আক্রান্ত। অদ্যম সাহসে ভর করে তেত্রিশটা রেডিয়েশন এবং ষোলটা কেমো নিলেন। এক-একটা কেমোর ডিউরেশন ছিল পাঁচদিন। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু দমে যাননি। পাশে থেকে পরিবার জুগিয়েছেন সাহস। সেখান থেকে ফিরে এলেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে। ছ’বছর আর কোনও সমস্যা ছিল না। আবার ২০২১ সালে ক্যানসার রিল্যাপ্স করল। এবার ক্যানসার লাং-এ ছড়িয়েছে। ক্রিটিকাল একটা ওটি হয়। সেই অপারেশনও সাকসেসফুল হলেও একটা সময় শেষরক্ষা হয়নি।

আরও পড়ুন-গরিবের টাকা মেরে আত্মপ্রচারে মগ্ন নমো, রোহিতদের প্র্যাকটিস জার্সির রং নিয়ে মোদিকে নিশানা মুখ্যমন্ত্রীর

অমর সেই প্রেম
এক অমূল্য প্রেম। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এমন এক প্রেমকাহিনি বিরল। কোনও একটা সুন্দর ছবির গল্প হয়ে যেতে পারে। অসুস্থতার এই পুরো সময়টা পাশে পেয়েছেন প্রিয় সব্য অর্থাৎ সব্যসাচীকে। করোনাকালে ঐন্দ্রিলা এবং সব্যসাচী মিলে প্রচুর মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ওইসময় ওদের হয়ে প্রায় পাঁচশো ভলান্টিয়ার কাজ করত। চাল-ডাল থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিতেন তাঁরা। কেউ বিপদে রয়েছেন জানলে নিজের জীবনের পরোয়া করতেন না ঐন্দ্রিলা। মৃত্যুর পরেও যা চিরভাস্বর হয়ে আছে সবার মনে আর সব্যসাচী চলে গেছেন অন্তরালে। কাজের মধ্যে থেকেই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খুঁজেছেন তিনি।

আরও পড়ুন-রাতভর গুলির লড়াই, কাশ্মীরে নিকেশ ৫ জঙ্গি

তাঁর স্বপ্নপূরণের মা
ছোট ছোট অনাথ ছেলেমেয়ের জন্য অনাথ আশ্রম এবং একটি বৃদ্ধাশ্রম করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার গুরুভার এখন ঐন্দ্রিলার মায়ের ওপর। বহরমপুরে প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ঐন্দ্রিলার মায়ের ইচ্ছে ও উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ শুরু হয়। বহরমপুরের মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গেই যুক্ত মা শিখা শর্মা। সেখানকার ক্যানসার বিভাগের বিল্ডিংয়ে এবং বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় একশোর বেশি গাছ লাগানো হয়েছে ইতিমধ্যেই। এখানেই শেষ নয়। আরও হাজারের উপর বৃক্ষরোপণ করা হবে ঐন্দ্রিলার স্মরণে। বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠনের সহায়তায় মা শিখাদেবী এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে শামিল হয়েছেন। ২০ তারিখ ঐন্দ্রিলার প্রয়াণদিবসের দিন বিভিন্ন এনজিও-র সহযোগিতায় দুঃস্থ মানুষ, বয়স্ক এবং পথশিশুদের খাওয়াদাওয়া এবং বস্ত্রদান করবেন ঐন্দ্রিলার মা শিখা শর্মা। মেয়ের স্বপ্নপূরণে ভবিষ্যতে অনাথাশ্রম বা বৃদ্ধাশ্রম করার ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়েছেন, সঙ্গে রয়েছে আরও পরিকল্পনা।

Latest article