ছদ্মনামে আত্মগোপন
সবুজের প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। ছোটবেলায় বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। ধরার চেষ্টা করতেন কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি। সেই কারণে তাঁকে ডাকা হত জংলিবাবু বলে। মায়ের বুকের দুধ পাননি। এক মুসলিম মহিলার দুধ পান করে বড় হয়েছেন। ঘুরে-বেডানোর নেশা পেয়ে বসেছিল পরিণত বয়সেও। মাঝেমধ্যেই মিশে যেতেন গভীর অরণ্যে। পাখি চেনার জন্য ঘুরে-বেড়াতেন জঙ্গলে-জঙ্গলে। তিনি সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। ছদ্মনাম বনফুল। গভীর বনপ্রীতির কারণেই হয়তো নির্বাচন করেছিলেন এই ছদ্মনাম।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্ট : দেশের কোনও নির্বাচনে স্থগিতাদেশ জারি বা হস্তক্ষেপের অধিকার নেই আদালতের
একটা সময় কবিতা লিখতেন। প্রধানত ছাত্রদরদি শিক্ষক মহাশয়ের সস্নেহ শাসনের ভয়ে এই ছদ্মনামের মধ্যে করেছিলেন আত্মগোপন। কিন্তু বেশিদিন আড়ালে থাকতে পারেননি। তাঁর প্রতিভা এসেছিল আলোয়। লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন যথার্থই সব্যসাচী লেখক।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
আদর্শবাদী বাবার প্রভাব
প্রবাসী বাঙালি। বলাইচাঁদের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই। বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মনিহারি গ্রামে। বর্তমানে কাটিহার জেলা। তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল হুগলির শিয়াখালা। বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক। ছয় ভাই, দুই বোনের মধ্যে বলাইচাঁদ জ্যেষ্ঠ। তিনি নিজে এবং তাঁর অন্য তিন ভাই ডাক্তারি পেশাতেই স্বীকৃতিলাভ করেছিলেন। বাবা গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় এবং মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। আদর্শবাদী বাবার প্রভাব বলাইচাঁদের উপর পড়েছিল।
আরও পড়ুন-সিপিএমের দুই ‘স্টার’ নিজেদের বুথেই হেরে ভূত
চিকিৎসাকর্ম এবং সাহিত্যচর্চা
১৯১৮ সালে সাহেবগঞ্জে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯২০ সালে হাজারিবাগে সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। তারপর কলকাতায় করেন এমবি পাশ। মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় শিক্ষাগুরু বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’র লেখক। ডাক্তার বনবিহারী বনফুলের ছাত্রজীবনে ও সাহিত্যজীবনে এক স্মরণীয় পুরুষ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাসের নায়ক-চরিত্র এই ব্যক্তিত্বের আদলে আঁকা হয়। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ ও পাটনা মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষা শেষ করে প্যাথলজিতে ডিপ্লোমা নিয়ে ভাগলপুরে ল্যাবরেটরি সাজিয়ে চিকিৎসাকর্ম শুরু করেন। পাশাপাশি চালিয়ে নিয়ে যান সাহিত্যচর্চা।
কিশোরবেলায় ‘বিকাশ’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তারপর ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় কবিতা লেখেন। পরবর্তী সময়ে লিখতে থাকেন ‘শনিবারের চিঠি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বিজলী’, ‘প্রবাসী’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র মতো অভিজাত মননদীপ্ত পত্রিকায়। লেখা থেকে অর্থপ্রাপ্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল উৎসাহ।
আরও পড়ুন-১৭ মাস বেতন নেই চন্দ্রযানের যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী সংস্থায়
ছিল না আভিজাত্যের অহঙ্কার
বিহারের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘকাল থেকেছেন। প্রায় তেষট্টি বছর। তখন বছরে একবার কি দুবার কলকাতায় আসতেন। সাহিত্যিকদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। ভারী চেহারা। ধুতি-পাঞ্জাবি। গম্ভীর চাউনি। তারই মধ্যে সারল্য খেলে বেড়াত মুখেচোখে। বলতেন মজার মজার গল্প। ছোট থেকেই ভালবাসতেন ফুল, গান। দেখতেন আকাশের তারা। সেইসঙ্গে ছিলেন পশু-পাখিপ্রেমী, ভোজনরসিক, বন্ধুবৎসল, অতিথিবৎসল। ভালবাসতেন নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে। মেলামেশা করতেন সব ধরনের মানুষের সঙ্গে। আভিজাত্যের অহঙ্কার কোনওভাবেই স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর ছিল পরোপকারী মন। চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করতেন। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।
আরও পড়ুন-মহামেডানকে জেতালেন ডেভিড
কৃতিত্ব কথাশিল্পে
কবিতা দিয়ে সাহিত্যসাধনার শুরু। তবে বলাইচাঁদের কৃতিত্ব কথাশিল্পে। তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন নতুন ধারা ও বিচিত্র ধরনের কাহিনি নির্মাণে। উপন্যাস লিখেছেন একষট্টিটি, গল্প ছশোর মতো। উপন্যাসের বিষয় মূলত ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, চিকিৎসাবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, প্রেম প্রভৃতি। মানব জীবনের নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তাঁর লেখায়। ফুটে ওঠে যথার্থ শিল্পীর বেদনাবোধ। মানব জীবনকে দেখার চেষ্টা করতেন বিপুল কৌতূহলী মনে ও সহমর্মিতায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘তৃণখণ্ড’ (১৯৩৫), ‘জঙ্গম’ (তিন খণ্ড, ১৯৪৩-১৯৪৫), ‘অগ্নি’ (১৯৪৬), ‘ডানা’ (তিনখণ্ড, যথাক্রমে ১৯৪৮, ১৯৫০ ও ১৯৫৫), ‘স্থাবর’ (১৯৫১), ‘অগ্নীশ্বর’ (১৯৫৯), ‘হাটেবাজারে’ (১৯৬১), ‘ত্রিবর্ণ’ (১৯৬৩), ‘ভুবনসোম’ (১৯৬৩), ‘প্রচ্ছন্ন মহিমা’ (১৯৬৭), ‘উদয় অস্ত’ (দুই খণ্ড, ১৯৫৯ ও ১৯৭৪) প্রভৃতি। প্রত্যেকটি উপন্যাসের গঠনভঙ্গি স্বতন্ত্র এবং অভিনব। তিনি কিছু ইংরেজি উপন্যাস অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়। যেমন, অশোককুমার অভিনীত ‘হাটেবাজারে’, উত্তমকুমার অভিনীত ‘অগ্নীশ্বর’, উৎপল দত্ত অভিনীত ‘ভুবনসোম’।
আরও পড়ুন-গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এবার তৈরী করবে যুদ্ধজাহাজ
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাসী
তিনি ছিলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাসী। ছোটগল্প কত ছোট হতে পারে, সার্থকভাবে দেখিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ ‘বনফুলের গল্প’ (১৯৩৬), ‘বিন্দুবিসর্গ’ (১৯৪৪), ‘অদৃশ্যলোকে’ (১৯৪৬), ‘তন্বী’ (১৯৪৯), ‘অনুগামিনী’ (১৯৫৮), ‘দূরবীণ’ (১৯৬১), ‘মণিহারী’ (১৯৬৩), ‘বহুবর্ণ’ (১৯৭৬), ‘বনফুলের নতুন গল্প’ (১৯৭৬) প্রভৃতি। নাটক রচনাতেও অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। নাটিকা, প্রহসন, একাঙ্কিকা, চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবন নিয়ে নাটক রচনা করেন। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা নাটক ‘শ্রীমধুসূদন’ (১৯৪০) এবং ‘বিদ্যাসাগর’ (১৯৪১)।
আরও পড়ুন-উত্তরে নামল জল, দুর্গতরা ফিরলেন ঘরে
পুরস্কার ও সম্মাননা
সাহিত্যকর্মের জন্য পদ্মভূষণ পেয়েছেন। এ ছাড়াও পেয়েছেন শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৭৩ সালে ডিলিট উপাধি প্রদান করে। পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহ। বলাইচাঁদের উপন্যাস ‘কিছুক্ষণ’ পড়ে উচ্ছ্বসিত কবিগুরু চিঠি লিখেছিলেন। ‘কিছুক্ষণ’ নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
জীবনের শেষ পর্ব কাটে দমদমের লেক টাউনে। ১৯৭৯-র ৯ ফেব্রুয়ারি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।