বিস্মৃতির আবডাল সরিয়ে

ভারতবর্ষের হিরন্ময় অতীতের চর্চা যেমন প্রয়োজন তেমনই আবশ্যক আত্মবিশ্লেষণ। একপেশে আত্মাভিমানের ঢক্কনিনাদে যেন সত্যের ব্যবকলন না ঘটে।

Must read

ভারতবর্ষের হিরন্ময় অতীতের চর্চা যেমন প্রয়োজন তেমনই আবশ্যক আত্মবিশ্লেষণ। একপেশে আত্মাভিমানের ঢক্কনিনাদে যেন সত্যের ব্যবকলন না ঘটে। চিনে নিই আমাদের গৌরবের ইতিহাস। সেইসঙ্গে বুঝে নিই, কোন আপজাত্যে থেমে গিয়েছিল প্রাচীন ভারতের অগ্রসরমানতা। ইতিহাস চেতনার তর্কাতীত প্রয়োজনীয়তার কথা রাজ্যসভায় যেমন তুলে ধরেছেন, তেমন এখানেও আত্মবীক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সাংসদ জহর সরকার

আরও পড়ুন-ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেন বাইডেন, ফের পরমাণু যুদ্ধের ভয় দেখাল রাশিয়া

ক’দিন আগেই সংসদের উচ্চকক্ষে, অর্থাৎ রাজ্যসভায়, প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল দিকটির বিষয়ে ভাষণ দেন অধ্যাপক রাকেশ সিনহা। হিন্দুত্ববাদী বিভ্রমে সেই আলোচনায় পরিস্ফুট একটি বিষয় — নির্বাচিত সত্যের ওপর আলোকপাত এবং তার পরিণতিতে বৃহত্তর সত্যের অনালোকিত থেকে যাওয়া। এই অনালোচিত পরিসরে আলো ফেলার গুরুত্ব বোঝাতেই আমার এই উপস্থাপনা।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস যে গৌরবময়, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। সেই গরিমা গাথা স্মরণ প্রসঙ্গে বারংবার উঠে আসে ভারতীয় জ্ঞান, চিন্তা, দর্শনের পরম্পরার বিষয়টি। এই জ্ঞানের প্রবহমানতা কেবল প্রাচীনকালের সময়সীমায় আবদ্ধ ছিল, এমনটা নয়। সেই পরম্পরা মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগেও সম্প্রসারিত। তাই, প্রাচীন ভারত ও ভারতের জ্ঞান পরম্পরাকে এক বন্ধনীতে আটকে রাখলে বিষয়টির প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না।

আরও পড়ুন-পুতিনের বকুনিতে হৃদরোগ!

এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই, ব্রিটিশ শাসনে ভারত শোষিত হয়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে ব্রিটিশরা আমাদের চিন্তা ভাবনার জগতটাকেও বন্দি করার চেষ্টা করেছিল। ব্রিটিশরা আমাদের ধ্যানধারণা চিন্তা-ভাবনাগুলোকে নিজেদের মতো করে বদলে দিতে চেয়েছিল, পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বলয়েও, স্রেফ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনকে টিকিয়ে রাখার প্রণোদনায়। এসব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
কিন্তু একথা স্বীকার করলেও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর অধরাই থেকে যায়।

আরও পড়ুন-নাইট জার্সিতে গর্বিত শ্রেয়স

প্রাচীন ভারতবর্ষে চড়ক–সুশ্রুতের কল্যাণে চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল, সেকথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু কেন আমরা বিস্মৃত হলাম শল্য চিকিৎসার সেই সুপ্রাচীন বিদ্যা? কেন বিস্মরণের বিতংসে জড়িয়ে গেল পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো শাখাগুলোতে আমাদের লব্ধ তাবৎ জ্ঞান? কেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা ভুলে আমরা মেতে থাকলাম জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে? কেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমাদের যাবতীয় সাফল্য কালান্তরে বাঁধা পড়ল স্রেফ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ফাঁসে, যে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র আজও আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে স্বীকৃত কোনও চিকিৎসা বলে বিবেচিত নয়?
এহ বাহ্য! আমাদের বিস্মৃতি এমনই সর্বগ্রাসী যে আমরা সবকিছু ভুলে গেলাম!

আরও পড়ুন-নতুন পরীক্ষায় বিরাট-মায়াঙ্ক

যেমন সম্রাট অশোকের কথা। একথা সর্বজ্ঞাত যে প্রাচীন ভারত – ইতিহাসের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন সম্রাট অশোক। কিন্তু কী আশ্চর্য! শত শত বছর ধরে ভারতের পুঁথি – পুস্তকে তিনি অনালোচিত উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন। কয়েক সহস্রাব্দ কেটে গেল তাঁর অনবলোকনের আস্তাকুড়ে যতক্ষণ না জনৈক তরুণ ইংরেজ, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জেমস প্রিন্সেপ, ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুনরাবিষ্কার সম্ভবায়িত করলেন। পরের বছরেই, অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে প্রিন্সেপের জীবনাবসান ঘটে, কিন্তু প্রয়াণের পূর্বে বিস্মরণের অন্ধকার থেকে তিনি সম্রাট অশোককে পুনরুদ্ধার করেন।

আরও পড়ুন-আজ থেকে একসপ্তাহ উত্তরবঙ্গ সফরে মুখ্যমন্ত্রী, দার্জিলিংয়ে একাধিক কর্মসূচি

কেন সম্রাট অশোককে সম্পূর্ণ বিস্মরণের মতো মহাপাপ করেছিল ভারতের জনমানস? তা কি এজন্য যে তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন? তা কি এজন্য যে তিনি জাতিভেদ বর্ণভেদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন? উত্তরগুলো খুঁজে বের করতে হলে আমাদের আত্মবীক্ষণ করতে হবে। বিস্মরণের কারণসমূহ জানতে গেলে কেবল ‘বাহির-পানে’ চোখ মেলে থাকলে হবে না, চাইতে হবে ‘ভিতর পানে’, আত্মবিশ্লেষণের মানসিকতায়।
অজন্তার কথাও তো আমরা বিস্মরণের কৃষ্ণগহ্বরে ঠেলে দিয়েছিলাম। আমাদের জাতীয় মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছিল অজন্তা গুহার গর্বগাথা যতদিন না তা পুনরাবিষ্কৃত হল ১৮১৯ সালে।

আরও পড়ুন-ক্ষতিগ্রস্ত দশটি পরিবারকে চাল, ডাল, বিস্কুট – মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ পৌঁছল বগটুই

১৮৩৭এ পুনরাবিষ্কৃত হল সারনাথ। সারনাথ তো আর বখতিয়ারউদ্দিন খিলজির আক্রমণের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। তবে কেন আবার সেটিকে নতুন করে খুঁজে বের করতে হল মাটির নিচ থেকে, খননকার্য চালিয়ে? একইভাবে, ১৮৫১-তে পুনরাবিষ্কৃত হল সুবিখ্যাত সাঁচি স্তূপ।
আমরা তো ভুলে গিয়েছিলাম হরপ্পা সভ্যতার কথাও। ১৯২২ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যবর্তী কালপর্বে আমরা আমাদের স্মৃতিকোষ থেকে সরিয়ে রেখেছিলাম হরপ্পা সভ্যতার কথা। ১৯৫৪তে কলকাতার পাঠ্য পুস্তকে প্রথম উল্লেখ করা হল এই সুপ্রাচীন সভ্যতার বৃত্তান্ত। ১৯৫৪-র আগে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন তাঁরা হরপ্পা সভ্যতার বিষয়ে অবগত হওয়ার সুযোগ পাননি। পূর্ববর্তী যাবতীয় পাঠ্যপুস্তকে এবিষয়ে একটি কথাও লেখা নেই।
এসবের ভেতর থেকে একটা সত্যিই বেড়িয়ে আসে, তা হল, ভারতের জ্ঞান পরম্পরা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কেই মনে রাখতে চেয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা কীর্তির ওপর আলোকসম্পাতেই তৃপ্ত হতে চেয়েছে। ফলত আনলোকিত থাকতে থাকতে কালের গ্রাসে পড়ে বিস্মরণের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে আরও অনেক ব্যক্তি, বিষয়, বিস্ময়, গরিমার উপলক্ষ ও সূত্র।

আরও পড়ুন-বগটুই কাণ্ডে তদন্ত শুরু করলো সিবিআই

সুনির্বাচিত স্মৃতির চর্চা সর্বতোভাবে খারাপ কিছু, এমনটা বলা বোধ হয় ঠিক নয়। ঠিক নয়, কারণ তা অতীত সংঘাতের ইতিবৃত্ত লালন করে না। ইতিহাস চর্চা যদি কেবল সংঘাত আর সংঘর্ষের কথাই বলে, তবে তা আমাদের আরও সমস্যাদীর্ণ করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু যুগপৎ এই সত্যও অনস্বীকার্য যে প্রায় আড়াই সহস্রাব্দ ধরে ভারতে জ্ঞান পরম্পরা শুধু একটি বর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শুধু বিদেশিদের আক্রমণেই আমরা অতীত গৌরব হারিয়েছি বা ধরে রাখতে পারিনি, এমনটা নয়। এসবের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল ওই বর্ণাশ্রম, ওই জাতিভেদ প্রথার সংস্কারও। শবব্যবচ্ছেদের উপায় ছিল না কারণ মৃতদেহ অশুদ্ধ, তাই অস্পৃশ্য। চিকিৎসক হিসেবে সবার শরীর স্পর্শ করার অনুমতি দিত না প্রাচীন সমাজ।

আরও পড়ুন-ফিফা ফ্রেন্ডলিতে আজ ভারতের সামনে বেলারুশ, দল ও কৌশল বদল স্টিমাচের

সুতরাং প্রাচীন ভারতের প্রজ্ঞার বিষয়ে যেমন কোনও দ্বিমত নেই তেমনই অনুধাবন করতে হবে কেন অতীতে অসামান্য সাফল্য সত্ত্বেও বিজ্ঞান- প্রযুক্তি ও সমরবিদ্যায় আমরা বিশ্বের নেতৃস্থানীয় হতে পারলাম না। কেবল প্রাচীন ভারত আমাদের স্বর্ণযুগ, এই আত্মশ্লাঘায় আবিষ্ট হয়ে প্রচারের ঢাক পেটালে চলবে না। প্রাচীন ভারতের গরিমার আলোর পেছনে সীমাবদ্ধতার অন্ধকারও ছিল এবং সেই অন্ধকারে প্রত্যাবর্তন আমাদের কারওরই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না, সেটাও মনে রাখা দরকার।

Latest article