রোজ সন্ধেবেলা হলেই আমাদের পাড়ার মোড়ের ছোটুর রোলের দোকানে ভিড় উপচে পড়ে। চিকেন রোল হোক বা মটন রোল অথবা এগ রোল কিংবা এগ-চিকেন রোল, ছোটুর হাতে তৈরি রোল খেতে আট থেকে আশি সবাই সন্ধেবেলা ভিড় করে ছোটুর দোকানে। আমি আর আমার ছেলেও কিন্তু ছোটুর রোল সেন্টারের এক নম্বর কাস্টমার।
আরও পড়ুন-তেলেভাজা থেকে মোমো
আজ না হয় ছোটুর রোলের দোকান এত জমজমাট, কিন্তু সন্ধেবেলায় পেটের সঙ্গে মন ভোলানোর মতো এই ফাস্ট ফুডের কিংবা এই স্ট্রিট ফুডের আবিষ্কার কর্তাকে সত্যিই কুর্নিশ জানাতে হয়, এই রকম একটা জবরদস্ত্ সান্ধ্যকালীন মনভরানো এবং অবশ্যই পেট ভরানো এই মুখরোচক খাবারটি আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
তবে অন্যান্য স্ট্রিট ফুডের জন্ম আর যেখানেই হোক না কেন, এই মুখরোচক রোলের জন্ম কিন্তু খোদ কলকাতার বুকেই। আর এই রোলের পথচলা শুরু হয়েছিল এসপ্ল্যানেড বা ধর্মতলা থেকেই।
আরও পড়ুন-কালজয়ী সাহিত্যিক বিমল কর
রোলের জন্ম-ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে সেই ১৯০০ সালে। তখন আমাদের দেশ ইংরেজরা শাসন করত। বর্তমানে কলকাতা কর্পোরেশন যেখানে সেখানেই একজন লোক প্রতিদিন কাবাব আর পরোটা বিক্রি করতেন। সেই লোকটির নাম ছিল হাসান রেজা। হাসান রেজা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের লোক। তিনি কাজের সন্ধানে নিজের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। কলকাতায় এসে তিনি একটা তাওয়াকে সঙ্গী করে পরোটা আর বিফ কাবাব তৈরি করা শুরু করেন।
আরও পড়ুন-রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি করছেন কে?
প্রতিদিন সন্ধেবেলার সেই কাবাবের দোকানে ভিড় উপচে পড়ত। আর সেই ভিড় ইংরেজরা বেশি জমাত। আসলে হাসান রেজার তৈরি বিফ কাবাবের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। আর সেই কারণে অনেকেই তারঁ ঊর্ধ্বতন বসকে খুশি করার জন্য হাসান রেজার কাছ থেকে কাবাব কিনে নিয়ে যেতেন এবং বসকে খাওয়াতেন।
আরও পড়ুন-লড়াই করেও হার প্রণয়ের
এরকমই একদিন একজন ইংরেজ আধিকারিকের ইচ্ছে হয়েছিল যে, তাঁর ঊর্ধ্বতন বসকে হাসান রেজার কাবাব খাওয়াবেন। কিন্তু কাবাব কিনতে গিয়ে তিনি এক সমস্যার সম্মুখীন হন। সমস্যাটি হচ্ছে তাঁর বস প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে ধরনের মানুষ ছিলেন এবং হাতে কাবাবের তেল লেগে যাওয়াটাকে তিনি একদমই বরদাস্ত করতে পারতেন না। এই সমস্যার কথা সেই ইংরেজ আধিকারিক হাসান রেজাকে জানান। হাসান রেজা শত চিন্তা করেও ঠিক করতে পারছিলেন না যে, কীভাবে তিনি এই সমস্যার সমাধান করবেন। রাতের বেলা সমস্ত বিক্রিবাটা হয়ে যাওয়ার পর সমস্যার কথা চিন্তা করতে করতে হাসান রেজা বাড়িতে ফেরেন। বাড়িতে গিয়ে তিনি তাঁর বউকে এই সমস্যার কথা খুলে বলেন। এরপরে তাঁর স্ত্রী অনেক ভাবনাচিন্তার পর একটি বুদ্ধি বার করেন। বউয়ের বুদ্ধিমতো হাসান রেজা পরদিন যথাসময়ে তাঁর কাবাব আর পরোটার দোকান খোলেন।
আরও পড়ুন-নতুন আর্ট গ্যালারি
এরপরে পরোটা তৈরির মাখা ময়দা থেকে লেচি কেটে নিয়ে সেটাকে গোলাকার রুটির আকারে বেলে নেন, তারপরে সেটা হালকাভাবে তেলে ভেজে নেন, আর তার মধ্যে তুলতুলে বিফ কাবাব পুরে সেটা রোল করে নেন এবং সেই রোলটা একটা ব্লটিং পেপারে মুড়িয়ে দেন, যাতে পরোটার তেলটা হাতে না লাগে। এরপরে ব্লটিং পেপারে মোড়ানো রোলটা সেই ইংরেজ আধিকারিককে দেন হাসান রেজা। আর এই পদ্ধতিতে বানানো বিফ-কাবাব সেই ইংরেজ আধিকারিকের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়। আর এরপর থেকেই এই অভিনব পদ্ধতিতে কাবাব খাওয়ার চল শুরু হয়। কারণ তারপর থেকেই হাসান রেজা প্রতিদিন লবণ-লেবু-মশলা মাখানো কাবাবটাকে পরোটার মধ্যে ঢুকিয়ে রোল করে তাওয়ার একপাশে থরে থরে সাজিয়ে রাখতে শুরু করেন। সেই ইংরেজ আধিকারিকের সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি কলকাতার বুকে লোভনীয় একটি খাবারের জন্ম হয়। যার নাম হয় ‘রোল’।
আরও পড়ুন-চন্দ্রযানের সাফল্যে জড়িত বাঙালি বিজ্ঞনীদের সংবর্ধনা দিতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
রোলের উৎপত্তি নিয়ে আরও একটি জনশ্রুতি রয়েছে। সেটি হল, একবার নাকি একজন অশ্বারোহী ইংরেজ আধিকারিক হাসান রেজার কাবাবের সুখ্যাতি শুনে তাঁর কাছে কাবাব খেতে এসেছিলেন। কিন্তু সেই ইংরেজ আধিকারিকের হাতে খুব কম সময় ছিল। তাঁর তাড়াহুড়ো দেখে হাসান রেজা তখন তাড়াতাড়ি করে পরোটার মধ্যে নুন-লেবু মাখানো কাবাবগুলো পুরে রোল পাকিয়ে তাঁর হাতে দিয়েছিলেন। আর এটার দেখাদেখি হাসান রেজার দোকানে ভিড়-করা অন্যান্য ইংরেজরাও হাসান রেজাকে বলেন যে, এভাবেই যেন তাঁদের পরোটার মধ্যে কাবাব দিয়ে রোল বানিয়ে দেওয়া হয়। আর এভাবেই নাকি জন্ম নেয় রসনা তৃপ্তির নতুন খাবার রোলের।
আরও পড়ুন-গণপিটুনি, ঘৃণাভাষণ: কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট তলব সুপ্রিম কোর্টের
তবে লেখক মোহনা কাঞ্জিলালের লেখা থেকে রোলের জন্ম কথার অন্য একটি তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তাঁর মতে, হাসান রাজা যখন উত্তরপ্রদেশ থেকে কলকাতায় আসছিলেন তখন আসার পথে তাঁর সঙ্গে খলিফা নামে একজন রাঁধুনির পরিচয় হয়েছিল। এবং এরপর তাঁরা কলকাতায় এসে একসঙ্গে কাবাব এবং পরোটা বানাতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের বানানো নরম তুলতুলে বিফ কাবাব এবং পরোটা সাহেব-মেমদের খুব পছন্দের ছিল। এই সাহেব এবং মেমরাই হাসান রাজাদের কাছে পরোটার মধ্যে কাবাব দিয়ে সেটাকে রোল করে বিক্রি করতে বলেন এবং আরও বলেন যে, ওই পরোটার তেল যাতে হাতে না লাগে সেই ব্যবস্থাও করতে। সেই সাহেব-মেমদের কথামতোই হাসান রাজারা পরোটার মধ্যে কাবাব দিয়ে সেটাকে রোল করে তারপর ব্লটিং পেপারে মুড়িয়ে সাহেব-মেমদের হাতে তুলে দিয়েছিল। আর এভাবেই জন্ম হয়েছিল রোলের।
আরও পড়ুন-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই প্রচারে, পথসভায় নির্মলচন্দ্র
তবে রোলের জন্ম যেভাবেই হোক না কেন, সেটা হাসান রাজার হাত ধরেই হয়েছিল এবং এই কলকাতার বুকেই হয়েছিল। ১৯৩২ সালে কলকাতা কর্পোরেশন থেকে দোকান দেওয়ার জন্য প্লট নিলাম করা হয়েছিল। সেই সময় হাসান রাজা তাঁর ছেলে শেখ নিজামুদ্দিনের নামে একটি প্লট কেনেন। তার নাম রাখা হয় নিজাম’স।
আরও পড়ুন-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই প্রচারে, পথসভায় নির্মলচন্দ্র
রোলের জন্ম বিফ রোল দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীকালে অবশ্য রোলের মধ্যে চিকেন, মটন, এগ, শসা-পেঁয়াজ-লঙ্কাকুচি প্রভৃতি ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু রোল-এর আবিষ্কর্তা বলতে যাঁর নাম সর্বপ্রথমে আসে, তিনি হলেন হাসান রেজা। তিনিই প্রথম রোলকে সবার সামনে উপস্থিত করেছিলেন। আর এই হাসান রেজাই হলেন বিখ্যাত নিজাম’স-এর মালিক।