কেউ পরিচিতি পান গায়িকা হিসেবে। কেউ শুধুই নায়িকা। রুমা গুহ ঠাকুরতা নিজেকে মেলে ধরেছিলেন দুটি ক্ষেত্রেই। যেমন অসাধারণ ছিল তাঁর গানের গলা, তেমন সাবলীল ছিল অভিনয়।
রক্তে ছিল গান। মা সতী ঘোষ ছিলেন সুগায়িকা। আলমোড়ায় উদয়শংকর কালচার সেন্টারের মিউজিক এন্সম্বলের সদস্যা ছিলেন সতী। পরে মুম্বইয়ে পৃথ্বী থিয়েটারে সংগীত পরিচালক হন। তাঁকে দেশের প্রথম মহিলা সংগীত পরিচালকও বলা যায়।
আরও পড়ুন-আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়
১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম রুমার। শৈশব কেটেছে আলমোড়া এবং মুম্বইয়ে। সতী ছিলেন সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়ের দিদি। রুমার গানের প্রাথমিক শিক্ষা মায়ের কাছেই। পরবর্তী সময়ে রুমা গান শিখেছেন আব্দুল রেহমান খাঁ, লক্ষ্মী শঙ্কর এবং দেবব্রত বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে। রুমার বাবা সত্যেন ঘোষ ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ।
গানের পাশাপাশি নাচও শিখেছেন রুমা। উদয়শঙ্কর কালচারাল সেন্টারে নিয়েছেন নাচের প্রশিক্ষণ। বহু নাচের আসরে অংশও নিয়েছেন উদয়শঙ্করের সঙ্গে। রুমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন নৃত্যাচার্য।
আরও পড়ুন-রাসযাত্রা, তত্ত্বে ও কাহিনিতে
সংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন রুমা। গেয়েছেন অসংখ্য ছায়াছবিতে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিনকন্যার ‘মণিহারা’য় কণিকা মজুমদারের লিপে ‘বাজে করুণ সুরে’ গানটি তাঁরই গাওয়া। ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে নিজের গাওয়া ‘তুমি আকাশ এখন যদি হতে’ গানটির দৃশ্যায়নে রুমার অভিনয় দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় ‘পলাতক’ ছবিতে গেয়েছিলেন ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে’। যাত্রার আসর। ঝুমুর নাচের তালে গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন রুমা নিজেই। এ-ছাড়াও ‘লুকোচুরি’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘বাঘিনী’, ‘বাক্স বদল’, ‘যদি জানতেম’ প্রভৃতি ছবিতে ছিল তাঁর গান।
কণ্ঠস্বরে ছিল নিজস্বতা। আর পাঁচজনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সহজেই চিহ্নিত করা যেত। সুরের গড্ডলিকাপ্রবাহে ভেসে যাননি কোনওদিন। যে-ক’টা গেয়েছেন, সবগুলোই প্রশংসিত।
আরও পড়ুন-জামা খুলিয়ে অত্যাচার করেছেন বিজেপি নেতা লোকনাথ, বিস্ফোরক যুব মোর্চা কর্মী
রুমা তখন কিশোরী। গানের সূত্রেই মুম্বইয়ে আলাপ কিশোরকুমারের সঙ্গে। কিশোর ছিলেন রুমার মতোই ভার্সেটাইল। তাঁর মধ্যেও প্রবল ভাবে মিশে ছিল সুর এবং অভিনয়। ফলে দুজনের কাছাকাছি আসতে বেশিদিন লাগেনি। অল্প সময়েই তাঁদের মধ্যে রচিত হয়েছিল মিষ্টি প্রেমের সম্পর্ক। ১৯৫২ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। পুত্র অমিতের জন্ম হয়। স্বামী-পুত্র নিয়ে রুমা সংসার করছিলেন সুখেই।
১৯৫৮। রুমার জীবনে ঘটে যায় দুটি মস্তবড় ঘটনা। প্রথমটি, কিশোরের সঙ্গে ভেঙে যায় দীর্ঘ ছয় বছরের দাম্পত্যজীবন। দ্বিতীয়টি, মুম্বই ছেড়ে বাংলায় এসে রুমা জন্ম দেন ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’-এর। তাঁদের দলগত পরিবেশনায় চমকে যায় বাংলা তথা গোটা দেশ। সম্মেলক সংগীত এবং কয়্যার অধ্যায়ের এক নবজাগরণ ঘটে। রুমার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ফিরে আসে সাধারণ মানুষের গান। তার মধ্যে ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’, ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম’, ‘আমরা করব জয়’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। বিনোদনের ছিটেফোঁটা ছিল না, গানগুলোর মধ্যে জনসাধারণ খুঁজে পেতেন নিজেদের জীবনসংগ্রামের কথা। রুমা এবং এই গানগুলো অচিরেই হয়ে উঠেছিল অবিচ্ছেদ্য। সংগঠক হিসেবে দেখিয়েছিলেন অসামান্য দক্ষতা। বহু মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় এবং সলিল চৌধুরির মতো মানুষদের। এইভাবেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বৃন্দগান। অংশ নিয়েছেন পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে।
আরও পড়ুন-জামা খুলিয়ে অত্যাচার করেছেন বিজেপি নেতা লোকনাথ, বিস্ফোরক যুব মোর্চা কর্মী
১৯৭৫ সালে কোপেনহাগেন ইয়ুথ ফেস্টিভালের আসরে দল নিয়ে গিয়েছিলেন রুমা। মঞ্চে উঠে যখন গাইতে শুরু করেন, সকলেই মুগ্ধ। শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার গান, রবীন্দ্রনাথের গান, অতুলপ্রসাদের গান, গণসংগীত।
ভারতের ২৫তম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। ডাক আসে রুমা এবং তাঁর দলের। ১৯৯০-এ নেলসন ম্যান্ডেলাকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠান। আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান। সেখানেও তাই। সমস্ত জায়গায় ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের উজ্জ্বল উপস্থিতি। একটা সময় ছিল কুড়ি জনের দল। পরে বাড়তে বাড়তে একশো ছাড়িয়ে যায়। অনুষ্ঠানে থাকত নির্দিষ্ট পোশাক। মধ্যমণি রুমা গাইতেন হারমোনিয়ামে প্রাণ সঞ্চার করে। সেই স্মৃতি আজও অনেকের মনে জেগে রয়েছে।
আরও পড়ুন-লড়াই করে আবার ফিরে আসব, বললেন ইমরান
এবার আসা যাক রুমার অভিনয়ের কথায়। ১৯৪৪ সালে ‘জোয়ার-ভাটা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। পরিচালক ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। কেবল রুমাই নন, এই ছবির হাত ধরে অভিনয় জীবন শুরু করেন দিলীপকুমার।
শুরুতে রুমা ‘মশাল’, ‘আফসার’, ‘রাগ রং’সহ বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবিতে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ১৯৫৯ সালে প্রথমবার তাঁকে দেখা যায় বাংলা ছবিতে। নাম ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে। কমেডি ছবিটি সেইসময় ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আরও একটি অসাধারণ ছবি ‘আশিতে আসিও না’। দমফাটানো হাসির এই ছবিতে রুমার সংবেদনশীল অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের।
আরও পড়ুন-শ্রমিকদের স্বার্থে, সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে কাজ করছে তৃণমূল
১৯৬২। মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’। একটি সিরিয়াস চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দেন রুমা। পরে সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ ছবিতে অভিনয় করেন। এই ছবিতে তিনি বিচলিত, চিন্তিত অসহায় এক গৃহবধূ। সূক্ষ্ম অভিনয়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে চরিত্রটিকে করে তুলেছিলেন জীবন্ত।
তরুণ মজুমদারের ‘পলাতক’, ‘পথ ও প্রাসাদ’, ‘বালিকা বধূ’ ছবিতে অন্যরকম তিনি। পাশাপাশি ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’য় স্নেহময়ী মা। তপন সিংহের ‘নির্জন সৈকত’ রুমার অভিনীত অন্যতম সেরা ছবি। এইরকম অসংখ্য কালজয়ী সিনেমায় নিজেকে মেলে দিয়েছিলেন। ‘গঙ্গা’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘হংসমিথুন’, ‘ত্রয়ী’, ‘আগুন’, ‘আশা ও ভালোবাসা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘আক্রোশ’ ছবিতে নার্স এবং পালিতা মায়ের চরিত্রে রুমা ছিলেন অনবদ্য। এখানেও ফুটিয়ে তুলেছিলেন নিজের চরম অসহায়তা। ইংরেজি ছবি ‘দ্য নেমসেক’ দিয়ে ইতি পড়ে তাঁর অভিনয় জীবনের।
আরও পড়ুন-লড়াই করে আবার ফিরে আসব, বললেন ইমরান
শুরু থেকেই রুমার অভিনয় ছিল নিচু স্বরে বাঁধা। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। পর্দায় তাঁকে দেখে মনেই হত না অভিনয় করছেন। নির্দিষ্ট ছকে আটকে পড়েননি। হননি কারও দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর অভিনয়ের আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্যময়তা। এক-একটি ছবিতে এক-এক রকম। সহজেই একটি চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে মিশে যেতেন। সেটা স্পষ্ট হয় বিভিন্ন ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো দেখলে।
কম বয়সে কিছু ছবিতে দুর্দান্ত নায়িকা। লাজুক। রোম্যান্টিক। আবার কিছু ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে পার্শ্ব চরিত্রে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছিলেন। নিজেকে করে তুলেছিলেন সময়োপযোগী এবং অপরিহার্য। উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে নয়, চিরকাল ছিলেন মাটির কাছাকাছি। কী গানে, কী অভিনয়ে। তাঁর মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা। মধ্যাহ্নে বাঁশবাগানের নরম ছায়ার মতো। তথাকথিত আহামরি সুন্দরী না হলেও, কিছুতেই চোখ ফেরানো যেত না। ঔজ্জ্বল্য নয়, অদ্ভুত এক মায়া লেগে থাকত চোখে-মুখে।
আরও পড়ুন-আমতলায় অভিষেকের মিলনোৎসব
বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল, তবে কিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ হয়নি। দুজনের যোগসূত্র ছিলেন গায়ক পুত্র অমিতকুমার। ১৯৬০ সালে রুমা বিয়ে করেন অরূপ গুহ ঠাকুরতাকে। শ্রমণা এবং অয়ন তাঁদের সন্তান।
সংসার-জীবনের প্রভাব শিল্পী-জীবনে পড়তে দেননি রুমা। চিরকাল সম্মান জানিয়েছেন নিজের সিদ্ধান্তকে। থেকেছেন অটল। ফলে বহুকিছু তাঁর সঙ্গে থেকে গেছে। কিছু গলে গেছে আঙুলের ফাঁক দিয়ে। ঘটেছে বাঁকবদল। বিচলিত হননি। গান এবং অভিনয়কে দুই পাশে নিয়ে আপন বেগে এগিয়ে গেছেন। নদীর মতো। তাঁর জীবনের গতি থেমেছে ২০১৯ সালের ৩ জুন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে।
গত ৩ নভেম্বর ছিল গায়িকা-নায়িকা রুমা গুহ ঠাকুরতার জন্মদিন। নানাভাবে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। সমবেতভাবে খোঁজা হয়েছে একটি প্রশ্নের উত্তর, সংগীতশিল্পী না অভিনেত্রী— কোনটা ছিল তাঁর মূল পরিচয়?