‘আজ আমাদের নেড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরি বোল।’
দোলযাত্রা, বসন্ত উৎসব, হোলি, হোরি খেলা যে নামেই ডাকা হোক না কেন, দোল আসলে পুরনোকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতি আর ফাগের রঙে মেতে ওঠার এক প্রাচীন উৎসব। দোলযাত্রার বিশেষ একটি অংশ হল ‘চাঁচর পোড়া’ যা পালিত হয় এই উৎসবের আগের দিনে। এটিও প্রাচীন এক রীতি। শুকনো লতা-পাতা আর জঞ্জালকে একত্রে পুড়িয়ে এক কথায় ‘বুড়ির ঘর’ জ্বালিয়ে নতুনের সূচনাই হল চাঁচরের মূল লক্ষ্য। দোলযাত্রার আগের দিন ফাল্গুনী শুক্লা চতুর্দশীতে বাংলা ও ওড়িশায় অনুষ্ঠিত হয় বহ্ন্যুৎসব। উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে এই উৎসবটি প্রকারান্তরে হোলিকা দহন হিসাবেও পরিচিত।
আরও পড়ুন-বুরা না মানো হোলি হ্যায়
বাংলায় দোল পূর্ণিমার আগের দিন বিষ্ণু এবং কৃষ্ণ মন্দিরে, নিতাই গৌরহরির দেবালয়ের কাছে, গৃহস্থের বাড়ির আঙিনার সামনে উদ্ভিজ্জ দাহ্যবস্তু বাঁশ, কাঠ, বিচালি, শুকনো লতা, পাতা, সরকাঠি, পাকাটি-নির্মিত একটি ঘর কিংবা কুশপুত্তলিকা তৈরি করে রাখা হয়। এরপর পূজার্চনা করে সেটিতে আগুন লাগানো হয়। প্রজ্জ্বলিত ‘মেড়া’টির চারপাশে বিগ্রহমূর্তিটিকে শোভাযাত্রা সহকারে ঘোরানোও হয়। শোভাযাত্রায় হয় হরিনামও। পরদিন সকালে বিগ্রহমূর্তিকে মন্দিরে সুসজ্জিত দোলনায় বসিয়ে পূজার্চনা করে তিনবার দোল দেওয়া হয় এবং বিগ্রহে আবির দেওয়ার পর উপস্থিত সকলে রঙখেলা শুরু করেন। এটাই রীতি।
সূর্যের উত্তর-যাত্রা
আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, অতি প্রাচীনকালে শীতের শেষে এই সময় সূর্যের উত্তরায়ণের গতি শুরু হত৷ এখনকার দোল-উৎসব বস্তুত সেই সময়েরই স্মৃতি বহন করে আসছে। তাঁর মতে, চাঁচর অনুষ্ঠানে যে গৃহ বা কুশপুত্তলিকা দগ্ধ করা হয়, তা মেষরূপী ভাদ্রপদা নক্ষত্রের প্রতিরূপ। ঋগ্বেদে এই নক্ষত্রের নাম ‘অজ একপাদ’ (একপদবিশিষ্ট ছাগ)। এই বহ্ন্যুৎসবে অসুররূপে কল্পিত ওই মেষ বা ছাগকে ভস্মীভূত করা হয়। যার বিনষ্টির ফলে সূর্যের উত্তরায়ণের বাধা অপসৃত হয় এবং সূর্যের তাপ ও দিনের বৃদ্ধি ঘটে।
আরও পড়ুন-সূর্যের যাত্রা–দোল উৎসব
ইতিহাসে নেড়া পোড়া বা হোলিকা দহন
যে নামেই প্রচলিত হোক না কেন, এটির উৎপত্তি কিন্তু স্কন্দপুরাণের কাহিনি থেকে। যেখানে আছে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কথা। কথিত আছে, রাক্ষসরাজা হিরণ্যকশিপু তাঁর প্রজাদের পুজো অর্চনা করা বন্ধ করে দেন। অমরত্ব লাভের জন্য তিনি ব্রহ্মার তপস্যা করা শুরু করেন। তাঁর তপস্যায় খুশি হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে পাঁচটি ক্ষমতা দান করেন। ব্রহ্মার দেওয়া এই পাঁচটি বর হল— কোনও মানুষ বা কোনও প্রাণী তাঁকে মারতে পারবে না। ঘরের ভেতরে বা বাইরে তাঁর মৃত্যু হবে না। তাঁর মৃত্যু দিনেও হবে না, রাতেও হবে না। অস্ত্র বা শস্ত্র দ্বারাও হবে না। জমিতে অথবা জলেও হবে না, শূন্যেও হবে না। এই বর পাওয়ার পর হিরণ্যকশিপুরের অত্যাচার বাড়তে থাকে। তাঁর সন্তান প্রহ্লাদ বিষ্ণুর পরম ভক্ত। তাই প্রহ্লাদকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাঁর জন্য নিজের বোন হোলিকার সাহায্য নেন হিরণ্যকশিপু। হোলিকা ব্রহ্মার কাছ থেকে একটি শাল পেয়েছিলেন। এই শাল তাঁকে সবসময় রক্ষা করবে বলে জানিয়েছিলেন ব্রহ্মা। হোলিকা বলেন তিনি প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনের মধ্যে বসবেন। শাল থাকায় তাঁর কিছু হবে না অথচ প্রহ্লাদ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। যেই প্রহ্লাদকে নিয়ে হোলিকা আগুনে প্রবেশ করেন, তখনই গায়ের শালটি তাঁর কাছ থেকে প্রহ্লাদের গায়ে গিয়ে পড়ে। তাই প্রহ্লাদের কিছু না হলেও পুড়ে ছাই হয়ে যান হোলিকা। হোলিকার মৃত্যু থেকেই শুরু হয় হোলিকা দহন প্রথা। যার মধ্যে দিয়ে মনের সব পাপ, অশুচি, লোভ, হিংসে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই হোলিকা দহনই হল বাংলায় নেড়া পোড়া।
ভারতের হিন্দিভাষী বিভিন্ন রাজ্যে বহু বছর ধরেই চাঁচরে হোলিকার কুশপুতুল দাহ করার রেওয়াজের চল রয়েছে। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে, হোলিকা দহন উৎসবের সূচনা হয়েছিল পাঞ্জাবের মুলতান অঞ্চলের প্রহ্লাদপুরী মন্দিরে। তবে নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে, চাঁচর আদিম শবর জাতির জীবনচর্যার সঙ্গে যুক্ত।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লাগামহীন কুৎসা, আইনি জালে কং-নেতা
এই রাজ্যের চাঁচর
বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরি
সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবারের গৃহদেবতা রাধাকান্ত। এই রাধাকান্তকে নিয়েই প্রতি বছর দোল উৎসবে মেতে ওঠে পরিবারের সদস্যরা। দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় পরিবারের চণ্ডীমন্দিরের সামনের মাঠে চাঁচর বা নেড়া পোড়ানো হয়। ওইদিন মন্দিরের নারায়ণ শীলাকে চাঁচর উৎসবে আনা হয়।
আমাদপুর চৌধুরি বাড়ি
পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারির এক প্রাচীন গ্রাম আমাদপুর। গ্রামে বিশাল বড় চৌধুরি পরিবারের অট্টালিকা, মা আনন্দময়ীর মন্দির, চারটে আটচালা শিবমন্দির, গৃহদেবতা রাধামাধবের টেরাকোটা মন্দির আর দোলমঞ্চ। প্রতি বছর এই দোলমঞ্চেই গৃহদেবতা রাধামাধবকে নিয়ে হয় দোল উৎসব। দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় পালিত হয় চাঁচর।
শোভাবাজার রাজবাড়ি
১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজারে তাঁর রাজপ্রাসাদের ঠাকুরদালানে শ্রীশ্রী গোবিন্দ জিউর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে আজও শোভাবাজার রাজবাড়িতে শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দজিকে নিয়ে মহাসাড়ম্বরে দোল উৎসব পালিত হয়। দোলের আগের দিন হয় চাঁচর অর্থাৎ নেড়া পোড়া।
আরও পড়ুন-উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ
দশঘরার চাঁচর
হুগলি জেলার শৈবতীর্থ তারকেশ্বরের কাছে এক প্রাচীন আর বর্ধিষ্ণু গ্রাম দশঘরা। এই দশঘরার বিশ্বাস পাড়ায় রয়েছে এখানকার একসময়ের জমিদার বিশ্বাস পরিবারের অসাধারণ কীর্তি। গোপীসাগর নামে এক দিঘির পাড়ে বিশ্বাস পরিবারের কাছারি বাড়ি, নহবত খানা, শিবমন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ ও অসাধারণ টেরাকোটার কাজসমৃদ্ধ পঞ্চরত্ন গোপীনাথ জিউর মন্দির। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে সদানন্দ বিশ্বাস গোপীনাথ মন্দির করে গোপীনাথ জিউয়ের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে দোল ও দোলের আগের দিন চাঁচর পোড়ানো হয়।
রমনগড়ের দোল ও চাঁচর
প্রাচীন রমনগড় আজকের রামনগরের মহাপ্রভুর দোল উৎসবের সূচনা করেন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ। আজও এই সম্প্রীতির দোলে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগরের অধিকারী বাড়িতে আসেন পার্শ্ববর্তী খোর্দা দেরিয়াপুরের মুসলমানরা। এখানেও দোলের আগের দিন হয় চাঁচর পোড়া।
আরও পড়ুন-সিআইআই-এর রাজ্য শাখার নয়া চেয়ারপার্সন সুচরিতা
দেশের হোলিকা দহন
বৃন্দাবন মথুরার ছোটা হোলি
ব্রজ বা বৃন্দবনের ফাল্গুনের শুক্ল একাদশীতে (আনওয়ালা একাদশী) পালিত হয় আর এই দিনটা দিয়ে শুরু হয় দোল উৎসব এরপরেই ফাল্গুন শুক্ল পূর্ণিমার দিনটা হল হোলিকা দহনের দিন। একে এখানে ছোটা হোলিও বলে। হোলি উৎসব পালনের রীতিনীতিতে সারা দেশের মানুষের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বৃন্দাবন, মথুরা এবং আশপাশের এলাকা। পাঁচদিন ধরে চলে সব উৎসব।
উত্তরাখণ্ডের নেড়া পোড়া
উত্তরাখণ্ড অঞ্চলে কুমায়ুন অঞ্চলের বৈথকি হোলি খুবই জনপ্রিয়, সেখানে মহাপ্রভুকে স্মরণ করা হয়। এখানে চাঁচরের রেওয়াজ রয়েছে। যাকে বলে হোলিকাদহন । এর পাশাপাশি খড়ি হোলির প্রথাও রয়েছে এখানে। এখানে শাস্ত্রীয় সংগীত এবং গানের মাধ্যমে হোলি উৎসব পালিত হয়।
আরও পড়ুন-করোনা টিকা স্পুটনিক ভি তৈরি করা বিজ্ঞানীকে খুন
ভাগোরিয়া হোলি
ছত্তিশগড় এলাকায় হোলিতে লোকগানের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের৷ যেখানে মধ্যপ্রদেশের মালওয়া অঞ্চলের আদিবাসী এলাকায় হোলি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। এখানে ভাগোরিয়া হোলি হিসাবে পালিত হয়। বিহারের ফাগুয়াও খুবই অনন্য— আজও। এই সব জায়গাতেই হোলিকা দহন করা হয়। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের প্রতীক হিসেবে হোলিকার কুশপুত্তলিকায় আগুন দেওয়া হয় প্রদোষকালে। মন্ত্রপাঠ, পুজো অর্চনা এবং সেই আগুনের চারপাশ ঘিরে চলে নাচগানও।
মারাঠিদের রং পঞ্চমী
মহারাষ্ট্রের পাঁচ থেকে সাতদিন ধরে এই রং পঞ্চমী উদযাপিত হয়। হোলির এই মহা সমারোহের আগের দিন এখানে হোলিকা দহন উৎসবের আয়োজন হয় যাকে ছোটা হোলিও বলা হয়। এই দিন সন্ধেবেলা হোলিকার কুশপুত্তলিকা জ্বালানো হয়, এখানকার অনেক জায়গায় পুরোহিতরা ঋগ্বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে। হোলিকা যখন পোড়ে স্থানীয় মানুষ মুখ থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করে। পরের দিন রাধা-কৃষ্ণকে রঙিন আবির নিবেদন করে এবং দিনেরবেলা গান-বাজনার পাশাপাশি শোভাযাত্রা বের হয়। রং পঞ্চমীকে দেবতাদের হোলি হিসাবেও সম্বোধন করা হয়।
আরও পড়ুন-করোনা টিকা স্পুটনিক ভি তৈরি করা বিজ্ঞানীকে খুন
হোলা মহল্লা
পাঞ্জাবে হোলির আগের দিনে সন্ধেবেলা হোলিকা দহন উদযাপিত হয়। অনেক এলাকায় ভক্তরা নরসিংহের পুজো করে এবং কয়েকটি পবিত্র স্তোত্র উচ্চারণের মাধ্যমে প্রহ্লাদের মাহাত্ম্য স্মরণ করা হয়। পরের দিন হোলা মহল্লা পালিত হয়। এই দিনে শিখরা শক্তি প্রদর্শন করেন। এটি তাঁদের পুরনো ঐতিহ্য।৭