বুরা না মানো হোলি হ্যায়

আর সত্যি করেই কৃষ যেন বৃন্দাগ্রামের সুপার হিরো, নানান ঝুটঝামেলা থেকে বৃন্দাগ্রামবাসীদের বারবার রক্ষা করে সুপার হিরোর মতোই।

Must read

সেই বৃন্দাগ্রামে আসার পর থেকেই কৃষ সকলের নয়নের মণি। আর হবে নাই বা কেন, যেমন দেখতে শুনতে তেমনি মেধাবী, খেলাধুলায় সবার সেরা, তেমনি শরীর আর মনের জোর, এমন কোনও গুণ নেই যা কৃষের নেই, শুধু সমবয়সি কেন এককথায় বৃন্দাগ্রামের সব ছেলের নেতা আজ কৃষ। কিন্তু তার কি আজ এখানে থাকার কথা, তার বাড়ি ছিল দূরের শহর মধুবনে, কৃষের বাবা বসুবাবু ছিলেন সেই শহরের এক সজ্জন ব্যক্তি, স্থানীয় এক হোমরাচোমরার অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় মিথ্যে মামলার দায়ে সপরিবারে জেল খাটছেন, সেই আঁচ যাতে কোনওভাবেই কৃষের গায়ে না পড়ে তাই সেই থেকে এতটুকু কৃষকে রেখে গেছেন তার ফুলমায়ের বাড়ি এই বৃন্দাগ্রামে। বসুবাবু ছিলেন আবার হৃত্বিক রোশনের মারাত্মক ফ্যান, কৃষ সিনেমায় হৃত্বিকের ফার্স্ট লুক বেরোবার দিন জন্ম হওয়ায় ছেলের নাম রেখেছিলেন কৃষ, আর সিনেমাটি দেখার পর মনে মনে ভাবতেন এ ছেলে কৃষের মতোই সুপার হিরো হবে।

আরও পড়ুন-সূর্যের যাত্রা–দোল উৎসব

আর সত্যি করেই কৃষ যেন বৃন্দাগ্রামের সুপার হিরো, নানান ঝুটঝামেলা থেকে বৃন্দাগ্রামবাসীদের বারবার রক্ষা করে সুপার হিরোর মতোই। এর ঘরে সাপ বেরিয়েছে তো কৃষকে ডাক, পাগলা কুকুরের জ্বালাতন তো কৃষকে ডাক, এমনকী করোনা ভাইরাসের সময় সারা বৃন্দাগ্রামকে এমন কায়দায় কোয়ারেন্টাইন করেছিল যে কোভিড-কদমফুলের একটি পাপড়ি পর্যন্ত এ পথ মাড়াতে সাহস পায়নি। তবে তার উৎপাতও কম ছিল না গ্রামে, এর আচার তো ওর বাড়ির পেয়ারা তো কারও বাগানের আম— দলবল নিয়ে হামলে পড়ত, তবে অদ্ভুত ব্যাপার সব কিছুতেই কৃষের যেন সাতখুন মাফ, সবাই হাসিমুখে এ দুষ্টুমি মেনে নিত। এই তো সে বেশ কয়েকবছর আগের কথা, গোপীমাসির আচার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গান বাঁধল, ‘ছেড়ে দাও ও মোর মাসি, আর না করিব আচার চুরি’, আর সে গান এখনও পর্যন্ত গোটা গ্রামে ভাইরাল।

আরও পড়ুন-ঠাকুরবাড়ির উৎসবের দোল

সেই ছোট্টবেলা থেকে এখানেই বড় হওয়ায় বৃন্দাগ্রামই আজ নিজের বাড়ি হয়ে গেছে কৃষের। এই গ্রামের প্রায় সকলেরই মূল ইনকামের রাস্তা হল দুধ-ঘিয়ের ব্যবসা। গ্রামের প্রায় সকলেরই সব বিরাট বিরাট খাটাল। তবে সবচেয়ে বড় খাটাল হল আদান ঘোষের। আদান ঘোষ, মোষের মতো গায়ের রং, তেমনি শরীর, গ্রাম সম্পর্কে কৃষের মামা আর বয়সে কৃষের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হলেও লোকটাকে একেবারেই সহ্য হয় না কৃষের। সহ্য না হওয়ার কারণও যথেষ্ট, সবচেয়ে বড় খাটাল থাকার জন্য সে কী ফুটানি আদানের, যদিও গোটাটাই তার বাপের থেকে পাওয়া সম্পত্তি, নিজের কোনও মুরাদ নেই। আর নিজে ওইরকম অদ্ভুতদর্শন মোষের মতো দেখতে হলেও শুধু টাকার জোরে বিয়ে করেছে অপরূপ সুন্দরী আর তেমনি গুণের বিনোদিনী নামের এক মহিলাকে। বিনোদিনীও হয়তো বয়সে কৃষের চেয়ে অল্প বড়ই হবে, তবুও বিনোদিনীকে দেখলেই অদ্ভুত একটা মায়া হয় কৃষের। বিশেষ করে আলুথালু এলোমেলো বিনোদিনী যখন মুখটা কেমন যেন ভার করে পাড়ার টাইমকলে জল আনতে যায়, তখন ওই বিটকেল আদানের চেহারাটা ভেবে কৃষের মনে পড়ে মাইকেলের লাইন, ‘নন্দন কাননে ভ্রমে দুরাচার দৈত্য’। কখনও কখনও চোখে চোখ মিলে যায় কৃষ আর বিনোদিনীর, কৃষ হয়তো কোনওদিন আপন মনে গেছে নদীর ধারে বেড়াতে আর বিনোদিনী যাচ্ছে নদীতে স্নান করতে, মিলে যায় চোখে চোখ, কারোরই যেন পলক পড়ে না আর, কৃষের জানি না কেন মনে হয় বিনোদিনীর সঙ্গে তার যেন জন্মজন্মান্তরের বন্ধন। হঠাৎ করেই চোখ নামিয়ে নিয়ে অদ্ভুত এক করুণ মুখে ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে যায় বিনোদিনী, মোচড় দিয়ে ওঠে কৃষের ভেতরটা, কৃষ থাকতে না পেরে পকেটে রাখা মাউথ-অর্গানটা বের করে তাতে সুর তোলে, ‘কেশরিয়া তেরা ইস্ক হ্যায় পিয়া, রঙ যায়ু জো হাত লাগায়ু…’।

আরও পড়ুন-শ্রদ্ধায়-স্মরণে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ্য করেছিল বল্লুই। বল্লু, কৃষের ফুলবাবার ছেলে, এলাকার সেরা পালোয়ান, কুস্তি করে, মুগুর ভাঁজে যেন একশো হাতির বল তার শরীরে আর প্রচণ্ড ভালবাসে ভাইকে, কৃষ-অন্ত জীবন যেন, কৃষের ন্যায়-অন্যায় সকল কাজেই সব সময় ফুল সাপোর্ট বল্লুর। সেই বল্লুই একদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল,
— কী ব্রো, কোনও চক্করটক্কর চলছে না কি?
— ধুর দাদা কী যে বলিস!
— লুকিয়ে লাভ নেই ব্রো, আমি সব লক্ষ্য করেছি। চালিয়ে যা, ওই ব্যাটা আদানটাকে আমারও মোটেই সহ্য হয় না, ব্যাটা টাকার জোরে বিয়ে করেছে, সত্যিই মায়া হয় মেয়েটাকে দেখলে, ক্যারি অন ব্রো ক্যারি অন।
— আর তোর ক্যারি অন, দুটো কথা বলবি যে তার সুযোগ কোথায়, যেখানেই যায় আদানের মা আর বোন তো এঁটুলির মতো সেঁটে থাকে।
— ভাবিস না, খুব শীঘ্রই সুযোগ আসছে তোর হাতে, একটা যা প্ল্যান করেছি না, সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না।
— প্ল্যান? কী প্ল্যান!

আরও পড়ুন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার হুমকি

— এ-বছর বৃন্দাগ্রামে আমাদের পাড়ায় আমরা দোল উপলক্ষে একটা ঝাক্কাস প্রোগ্রাম করব ভাবছি। ও-পাড়ার ছেলেগুলো প্রতি বছর ওই ট্রাক্টরে ডিজে বক্স আর হাজারটা চোঙা লাগিয়ে বিয়ার গিলে আমাদের পাড়ায় এসে নেচে যায়, আনকালচার্ড ব্যাটাদের হল ওই দোল।
— হ্যাঁ, ব্যাপারটা জাস্ট অসহ্যকর, কিন্তু তুই কী ভাবছিস?
— ভাবছি আমাদের পাড়ার ওই মাঠে দোলের দিন সকাল থেকেই একটা সুন্দর প্রোগ্রাম করব, রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করব, এক্কেবারে ঝাক্কাস বসন্ত উৎসব।
— হ্যাঁ, সে ঠিক আছে কিন্তু ভাই আজকের দিনে শুধু রবীন্দ্রনাথ দিয়ে হবে না, পাবলিক একটু ঝিনচ্যাক ব্যাপার চায় সবেতেই।
— চাপ নিস না ভাই, অনুষ্ঠানটা শেষ হবে ডিজের সঙ্গে উদ্দাম নাচ দিয়ে।
প্ল্যান অনুযায়ী পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করে দিল বল্লু আর কৃষ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেই দিন পোগ্রামে কে কী পারফর্ম করবে তার একটা লিস্ট তৈরি করে প্রোগ্রামটার ব্লু-প্রিন্ট প্রস্তুত করে নিল সবাই মিলে। চাঁদা আদায় করল সকলে মিলে। বেশ মোটা অঙ্কের একটা চাঁদা ফেলল আদান ঘোষের নামে। আদান অবশ্য হাসিমুখে দিতে রাজি হয়ে গেল, কারণ সেদিন বিনোদিনী পারফর্ম করবে। জানা গেল নাচ-গান— সব কিছুতেই বিনোদিনীর জুড়ি মেলা ভার।

আরও পড়ুন-মিড ডে মিলের দায়িত্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠী

ঠিক হল অনুষ্ঠান শুরু হবে বিনোদিনীর গান দিয়ে, শুরুতেই ‘ওরে গৃহবাসী’ গাইবে বিনোদিনী, সঙ্গে গলা মেলাবে পাড়ার মেয়েরা। তারপর কিছু সমবেত গান-নাচ আর আবির খেলা, শেষের দিকে ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার’ গানে বিনোদিনীর সোলো ডান্স, মাউথ-অর্গানে সঙ্গত করবে কৃষ। আর একদম শেষে ঝিনচ্যাক ডিজে। তবে বল্লুর কড়া নির্দেশ, নো অ্যালকোহল, ড্রিংক হিসাবে কেবল অ্যালাও করা হবে হোম-মেড ভাংয়ের শরবত।
দোলের ক’দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেল রিহার্সাল, সেই সুবাদে কৃষ-বিনোদিনী কথাবলা শুরু করল একে অপরের সঙ্গে, চোখে-চোখে সম্প্রদান হতে লাগল কত যেন নির্বাক অনুভূতি।
ও পাড়ার ছেলেরাও কথা দিয়েছে যে ওই ট্রাক্টরে ডিজে বেঁধে এনে এত সুন্দর একটা অনুষ্ঠান তারা মাটি করবে না। এরা ডিজে শুরু করলে তখন তারাও পথে নামবে।

আরও পড়ুন-বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা

অবশেষে এল সেই দিন, অনুষ্ঠানের জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রেমকুঞ্জ’। পলাশফুল আর নানান লতাপাতা দিয়ে সাজিয়ে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে পাড়ার ছেলেরা। সকাল থেকেই সকলে বাড়ি ছেড়ে ভিড় জমাল প্রেমকুঞ্জে। বল্লু, কৃষ আর পাড়ার ছেলেরা ভীষণ ব্যস্ত। সবকিছুর মাঝেই কৃষের চোখ কিন্তু একজনের প্রতীক্ষায়, অনেকেই এল তবুও তার দেখা নেই কেন! আদান তো বাড়ি থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসে জমিয়ে বসে পড়েছে অনুষ্ঠান দেখবে বলে। বল্লু কৃষকে বলল, চাপ নিস না, মালটাকে ভাং খাইয়ে ঠিক আউট করে দেওয়া হবে। কিন্তু কৃষের মন অন্য কোথাও নেই আর, তার চোখ শুধু একজনাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। সত্যিই তো সে আসছে না কেন! আরও কিছুক্ষণ পর প্রেমকুঞ্জে এসে উপস্থিত হল বিনোদিনী, আজ কী সাজে সেজেছে বিনোদিনী, মোহিত হয়ে গেল কৃষ অবর্ণনীয় সে-রূপের ছটায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল অনুষ্ঠান। বিনোদিনীর কণ্ঠে ‘ওরে গৃহবাসী’ শুনে সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধ। চেয়ারে বসে আদানের ভাবখানা দেখে মনে হল যেন সে-ই গাইছে! হাবভাবের মাধ্যমে বোঝাতে চাইছে কার বউ দেখতে হবে তো! সেটা দেখে বল্লু বলল, ব্যাটার ভাবটা দেখ, ও বোঝেই না যে বিনোদিনী হল মুক্তার মালা আর ব্যাটা নিজে এক মুখপোড়া হনুমান।

আরও পড়ুন-বউবাজারে মেট্রোর কাজ এগোল

আস্তে আস্তে জমে উঠল অনুষ্ঠান, পাড়ার ছেলেদের আবদারে বেশ কয়েক গ্লাস ভাঙ খেয়ে আদান বেহুঁশ।
শুরু হল আবির খেলা, কৃষ তো সকলের নয়নের মণি, আজ সবাই যেন তাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায়, হাতের নাগালে পেতে চায়, সব মেয়েরাই ছুটে এসে আবির মাখিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে থাকল কৃষকে। আর কৃষের চোখ তো শুধু একজনের চোখে, সে বেশ বুঝতে পারল কৃষের প্রতি মেয়েদের এ-হেন আচরণ দেখে বিনোদিনীর চোখে যেন কপট রাগের ছায়া। না আর দেরি নয়, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে, জড়তা কাটিয়ে, কী বলবে, কী ভাববে এ-সব ভুলে নাচের তালে তালে বিনোদিনীর কাছে এগিয়ে গেল কৃষ, হাতের মুঠোয় রাখা আবির দিয়ে আলতো করে রাঙিয়ে দিল বিনোদিনীর গাল, বিনোদিনীর অঙ্গসুরভি এসে লাগল কৃষের নাকে, যেন মাতাল হয়ে গেল কৃষ। বিনোদিনীও কোনও বাধা দিল না। শুধু সলাজ চোখ দুটি দিয়ে তাকাতে থাকল মাটির দিকে, আর একটু দূরে গিয়ে একমুঠো আবির কৃষের শরীরে ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিশে মেতে উঠল নাচে।

আরও পড়ুন-মরুরাজ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ভুগছে বিজেপি

হঠাৎ করেই বল্লুর ঘোষণা, আর দেরি নয়, এবার ডিজে শুরু। অধিকাংশই তখন ভাং খেয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে, ডিজেওয়ালা বাজিয়ে দিয়েছে, ‘বালম পিচকারি তুনে জো মুঝে মারি সিধে সাধি ছোরি দিবানা হোগয়ি।’ শুরু হল উদ্দাম নাচ, হঠাৎ করে একটা গাছের আড়াল থেকে এক ঝটকায় কে যেন টেনে নিল বিনোদিনীকে। বিনোদিনী চিৎকার করে ওঠার আগেই একটা রং-মাখানো হাত এসে বন্ধ করে দিল বিনোদিনীর মুখ, বিনোদিনী দেখল তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে মিটমিট করে হাসছে কৃষ, কোনও প্রতিবাদ করল না বিনোদিনী, আত্মসমর্পণ করল কৃষের কাছে, তিরতিরিয়ে কাঁপতে-থাকা দু-জোড়া ঠোঁটের একে অপরকে খুঁজে নেওয়া তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। হঠাৎ করেই তাল কেটে গেল এক বিকট আওয়াজে। ও পাড়ার ছেলেরা তখন ট্রাক্টরে বাঁধা সাউন্ড সিস্টেমে প্রচণ্ড জোরে গান বাজিয়ে দিয়েছে— কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা…। অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article