কেন রক্তপরীক্ষা
বিশ্বায়নের প্রভাব আজ গোটা পৃথিবী জুড়ে। উন্নয়নশীল দেশগুলি যেমন সবদিক থেকে এগিয়ে আবার কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েও। এ যুগে একসঙ্গে থাকতে গেলে আর বিয়ে নিয়ে বড় একটা মাথাব্যথা করেন না একশ্রেণির মানুষ আবার কেউ চাইলেই ‘একক পিতা’ কিংবা ‘একক মাতা’ হতে পারেন— সবটাই বিজ্ঞানের দৌলতে! তবে বিয়ের প্রচলন আজও আছে; চিন্তার বিষয় হল এই যে, বিয়ে কিংবা নিছকই ‘একসঙ্গে থাকা’ কিন্তু সবসময় বিজ্ঞানসম্মত নয়। কার শরীরে কী আছে কে তা বলতে পারে! নারী-পুরুষের মিলনের ফলে যে সন্তান-সন্ততির জন্ম হবে তার কপালে নেমে আসতে পারে দুর্ভোগ, জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ! তাই সংকরায়ণের প্রথমেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেওয়া উচিত আমাদের শরীরে কোনও রোগ বাসা বেঁধে নেই তো— যা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিকষ তমসাচ্ছন্ন করে দিতে পারে।
আরও পড়ুন-ইউক্রেনে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মৃত পাঁচ, রুশ সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণে মৃত তিন
সিকল সেল কী
‘সিকল সেল’ এমনই একটি রোগ যা মা-বাবার শরীর থেকে সন্তানের শরীরে আসে; এটি একটি জিনগত অসুখ। এই রোগে বহু মানুষ মারা যান; এটি বংশগত বিকার তাই এ-ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের শরীরে যে প্রথম বাইশ জোড়া ক্রোমোজোম আছে যা লিঙ্গ নির্ধারণে কোনও ভূমিকা গ্রহণ করে না, তাদের মধ্যেই ‘সিকল জিন’ অবস্থান করে। তাই সিকল সেল রোগের জন্য দায়ী বাবা ও মা দু’জনেই হতে পারেন।
মা ও বাবা উভয়ের শরীর থেকে এই অসুখটি অপত্যের দেহে আসতে পারে। এটি কখনওই অন্যের শরীর থেকে কারওর শরীরে প্রবেশ করে না। যদি মা ও বাবা দু’জনের মধ্যে যে কোনও একজনের শরীর থেকে সিকল জিন বাচ্চার দেহে প্রবেশ করে তাহলে শিশুর দেহে সিকল সেল রোগের কোনও লক্ষণ দেখা দেবে না কিন্তু ওই জিনের বাহক হয়ে থাকবে। তবে এই জিনের বাহক হওয়া মানেই কিন্তু অসুস্থতা নয়। পিতা-মাতা দু’জনেই যদি এই জিনের বাহক হন তাহলে তাদের জন্ম দেওয়া ২৫ শতাংশ সন্তানই এই ব্যাধির শিকার হবে এবং ৫০ শতাংশ এই রোগের বাহক। কিন্তু যদি মা ও বাবার মধ্যে যে কোনও একজনের দেহে এই জিন অবস্থান করে সেক্ষেত্রে তাদের অপত্য কখনওই রোগী হবে না, ৫০ শতাংশ শিশু এই ধরনের জিন বহন করতে পারে। তাই সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে একটি সহজ রক্তপরীক্ষা খুব জরুরি।
আরও পড়ুন-পুরহিতদের উপহার দিয়ে পুষ্করের ব্রহ্মা মন্দিরে আরতি করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
রোগটির উপসর্গ
এই বিশেষ ধরনের জিনটি একজন ব্যক্তির শরীরে রক্তের মধ্যে উপস্থিত লোহিত রক্তকণিকা তথা হিমোগ্লোবিনকে আক্রমণ করে। এর ফলে স্বাভাবিক গোলাকার নমনীয় রক্তকোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে দৃঢ় এবং অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে যায়।
এই শক্ত অনমনীয় বিকৃত কোষসমূহ সারা শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ প্রায় বন্ধ করে দেয় ফলে সারা দেহে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়। এই অজ্ঞাত প্রচণ্ড যন্ত্রণার ঘটনাকে ডাক্তারি পরিভাষায় ‘সিকল সেল সংকট’ বলা হয়ে থাকে।
সিকল সেল হল এমন একটি রোগ যার ‘ব্যাপক উপসর্গ’ ও রোগীর ‘আশু মৃত্যু’ দেখা যায়।
এই রোগের লক্ষণ শিশুর শরীরে জন্মের এক বছরের মধ্যেই ধরা পড়ে— প্রায় পাঁচ মাস বয়সের মধ্যে।
এর মূল লক্ষণ হল রক্তাল্পতা; শরীরের লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ দারুণভাবে কমে যায়। এর ফলে সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় যখন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে সারাদেহে।
আরও পড়ুন-সাকেতের গ্রেফতারি নিয়ে বিজেপিকে আক্রমণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেকের
হাত ও পায়ের পাতার নিচে ঘাম হয়। ঘন ঘন জীবাণুর সংক্রমণ হয়, দৈহিক বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয় এবং দৃষ্টিশক্তি কমে যায় এই রোগের কারণে।
এমনকী এর ফলে দেহে কমলা রোগের প্রকোপ দেখা দেয়, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সারা মন ও শরীর, আমাদের বয়ঃসন্ধিকালের বিকাশ ব্যাহত হয় দারুণভাবে।
এই রোগ সাধারণত আমাদের শরীরের যকৃৎ, বৃক্ক, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড এবং প্লীহা নামক অঙ্গকে আক্রমণ করে।
এই ধরনের রোগীদের মূলত চরম উপসর্গের জন্য মৃত্যু হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকিটা খুব বেশি হয়— এই মাত্রাটি ২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়।
তবে প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রধান কারণ হল তীব্র বুকে ব্যথা, স্ট্রোক, ফুসফুসীয় উচ্চচাপ এবং জীবাণুর সংক্রমণ। এ রোগ বড়ই মারাত্মক।
আরও পড়ুন-আজমেঢ় দরগায় চাদর-ফুল চড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী
চিকিৎসা
এতটাই মারাত্মক যে, এই রোগের সরাসরি কোনও চিকিৎসা এ-যাবৎ নেই; কেবলমাত্র উপসর্গের চিকিৎসা ছাড়া। এই রোগের কারণে সৃষ্ট তীব্র যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে বেদনানাশক মরফিন ব্যবহার করা হয়, তবে ‘হাইড্রক্সিইউরিয়া’ নামে একটি ওষুধও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই রোগের সবচেয়ে ফলপ্রসূ চিকিৎসা হল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন যেখানে রোগীর হাড়ের মধ্যে আন্তঃধমনীয় নলের মাধ্যমে ‘স্টেম সেল’ প্রবেশ করানো হয় মৃত কোষগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে। তবে এই রোগের নির্মূলে চিকিৎসার সাফল্যের হার খুবই কম।
প্রাদুর্ভাব
আফ্রিকা, ক্যারিবিয়া, আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ এবং মধ্য পূর্বের দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আফ্রিকার প্রায় ৮-১০ শতাংশ লোক, আমেরিকার প্রায় ৩০ লক্ষ লোক, যুক্তরাজ্যের প্রতি ৭৬ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু এই রোগে আক্রান্ত। তবে ভারতবর্ষেও এই রোগের প্রভাব যথেষ্ট; মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, ওড়িশা, বিহার, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে প্রায় ১-৪০ শতাংশ এই রোগের শিকার। সচরাচর গন্ড, ভিল, পাওয়ার, পরধান, ওটকার, মাদিয়া, দোদিয়া, নাইকা, গমিত প্রভৃতি উপজাতিদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন-সাম্বা ঝড়ে উড়ে গেল কোরিয়া
কাদের হয়
আমেরিকার শিকাগো শহরের প্রেসবাইটেরিয়ান হাসপাতালে প্রশিক্ষণরত ডাক্তার আর্নেস্ট এডওয়ার্ড আইরনস আন্তর্জাতিক ভাবে এই রোগটি সম্পর্কে প্রথম বলেন ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। গবেষণায় দেখা গেছে যে যাদের রক্তের গ্রুপ ‘ও’ হয় তাদের জেনোটাইপ সিকল সেল যুক্ত হয়, এ ছাড়াও গ্রুপ ‘বি’, গ্রুপ ‘এ’ এবং গ্রুপ ‘এবি’ রক্ত-যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
‘সিকল সেল’ বা ‘সিকল সেল রক্তাল্পতা’ একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। এই রোগ সম্পর্কে সর্বজনীনস্তরে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘ এই রোগটিকে ‘সর্বাগ্রবর্তী জিনবাহিত রোগ’ বলে চিহ্নিত করে এবং ২০০৯ সালের ১৯ জুন প্রথম ‘বিশ্ব সিকল সেল দিবস’ উদযাপিত হয়।
আরও পড়ুন-হাওড়া-বর্ধমান কর্ড শাখায় টানা দু’মাস বিপত্তি ট্রেনে
তবে আত্মসচেতনতাই সবচেয়ে বড় ওষুধ। তাই নিজেরাই যদি বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটি মামুলি রক্তপরীক্ষার পর সন্তানের জন্ম দিই তাহলে একসঙ্গে অনেকগুলো ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। একটি সুস্থ সন্তানই পারে একটি সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে। একটি সুস্থ পরিবেশ পারে একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে। তাই একটি সহজ রক্তপরীক্ষা অনেকগুলো ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। তাই আসুন এ-ব্যাপারে নিজে ও অপরকে সচেতন করার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হই আমরা : ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।