শতবার্ষিকী স্মরণে শোভা সেন

পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের নন, গ্রুপ থিয়েটারের শিল্পী তিনি। গ্রুপ চালাতে বাড়ি বন্ধক পর্যন্ত রেখেছিলেন, পাশাপাশি অর্থের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক সিনেমাগুলিতে অভিনয় করেছেন। এই বৈপরীত্য নিয়ে বিরাজ করেছেন শোভা সেন। শিল্পীর বৈচিত্র্যময় জীবনকে তুলে ধরেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

গৌরচন্দ্রিকা
বাংলা থিয়েটারের গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী দাসী, তারাসুন্দরী, প্রভা দেবী প্রমুখ নায়িকারা যে অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন; বসুন্ধরা সেই জাতীয় অভিনেত্রী। বসুন্ধরা স্বীকার করেছেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি তাঁর গুরু। এই মুহূর্তে বসুন্ধরা দ্য গ্রেট বেঙ্গল অপেরার বর্ষীয়সী অভিনেত্রী। এই নাট্যশালার প্রধান দায়িত্বশীল ব্যক্তি বেণীমাধব বাবু। সকলে ডাকেন কাপ্তেন বাবু বলে। তিনি নতুন একটি মেয়েকে আবিষ্কার করেছেন— ময়না। ময়নার দিকে নজর পড়ে এই নাট্যশালার স্বত্বাধিকারী বীরকৃষ্ণ দাঁর। বীরকৃষ্ণ স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ গড়ে দেবেন লোভ দেখিয়ে বেণীমাধবের কাছে ময়নাকে চেয়ে বসেন। লোভনীয় টোপে বেণীমাধব সম্মত হন। বসুন্ধরা স্পষ্ট জানান— যাকে ময়না ঘৃণা করে তার সঙ্গে জোর করে গাঁটছড়া বেঁধে দেওয়ার চেয়ে মেয়েটাকে মেরে ফেললেই পারো! নিজের মেয়ে হলে এ-কাজ করতে পারতে না, বাবু। বেণীমাধব তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। কারণ বীরকৃষ্ণ ময়নাকে পেলে থিয়েটার গড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরূপ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় বসুন্ধরার কণ্ঠে— ‘থিয়েটার খুলছ না, খুলতে যাচ্ছ গদি, দোকান, দালালির আপিস। যেখানে ময়নার সতীত্ব বিক্রি হবে।’ এমনই প্রতিবাদী চরিত্র বসুন্ধরা। যে নাটকের প্রধান চরিত্র এই বসুন্ধরা সেই নাটকের নাম— ‘টিনের তলোয়ার’। যার রচয়িতা নির্দেশক ও কাপ্তেনবাবুর চরিত্রের অভিনেতা হলেন উৎপল দত্ত। বসুন্ধরা চরিত্রের শিল্পী শোভা সেন। একটা চরিত্রকে মঞ্চে কীভাবে জীবন্ত করে তুলতে হয় সেটা শোভা সেন দেখালেন এই ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীকে ডি’লিট সম্মান সেন্ট জেভিয়ার্সের

ব্যক্তিজীবন
সেই শোভা সেনের জন্ম ১৯২৩ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার কার্তিকপুর গ্রামে। বাবা নৃপেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত। মা কলকাতা সেন। বেথুন কলেজে বিএ পড়াকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯৪২ সালের ৪ জুলাই। কলেজে পড়াকালীন নাট্যাভিনয় শুরু। ‘শেষ রক্ষা’ নাটকে গদাইয়ের বাবা, ‘সীতা’ নাটকে বাল্মীকির চরিত্রে অভিনয় করলেন। ভাগনাস-এর সুধী প্রধান ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রধান বিজন ভট্টাচার্যের কাছে নিয়ে যান শোভা সেনকে। ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর ‘নবান্ন’ নাটকে তিনি রাধিকার চরিত্রে অবতীর্ণ হলেন। সকলে মুগ্ধ। ইতিমধ্যে ১৯৫১ সালে ভারতীয় গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত হন উৎপল দত্ত। তিনি লিটল থিয়েটার গ্রুপ খোলেন (সংক্ষেপে এলটিজি)। যখন এলটিজি নিয়মিত অভিনয়ের জন্য মিনার্ভা থিয়েটার লিজ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন শোভা সেনের দাম্পত্যজীবন চরম অশান্তি, স্বামীকে লুকিয়ে নিজের বাড়ির দলিল বন্ধক দিয়ে তিনি দলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। অভিনয়ের ব্যাপারে স্বামীর অপছন্দ ছিল ফলে সাংসারিক বিরোধ চরমে পৌঁছাল। বিবাহবিচ্ছেদ করেন ১৯৬০ সালের ১০ মার্চ। নাট্যসহকর্মী ও সহযোদ্ধা উৎপল দত্তকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেন ১৯৬১ সালের ২৯ মার্চ। প্রথম পক্ষের একটি পুত্রসন্তান— উদয়ন। দ্বিতীয় পক্ষের একটি কন্যাসন্তান— বিষ্ণুপ্রিয়া।

আরও পড়ুন-বাম আমলের চেয়ে বেশি ডিএ দিয়েছে রাজ্য, ধীরে ধীরে সবটাই মিটিয়ে দেবে রাজ্য

চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ
উৎপল দত্ত তখন সাউথ পয়েন্টের শিক্ষক। সংসার নির্বাহের জন্য শোভা সেনকে নির্বিচারে প্রচুর সিনেমায় অভিনয় করতে হয়। নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ বা ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’-এর মতো ছবিতে কাজ করলেও, পরে তিনি বাণিজ্যিক ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করা শুরু করলেন। যখন তাঁর নায়িকা হওয়ার কথা তখন উনি অবলীলায় সমবয়সিদের গুরুজনের চরিত্রে মানানসই অভিনয় করেছেন। সত্যেন বসুর ‘পরিবর্তন’ ছবিতে প্রতিবন্ধী বালকের বিধবা মায়ের চরিত্রে তিনি দর্শকের মধ্যে দাগ কাটলেন। অগ্রদূতের ‘বাবলা’ ছবিতে তিনি দরিদ্র বাবলার বিধবা মা। ‘মেজদিদি’ ছবিতে দুঃখী কেষ্টর বিধবা মা। বাণিজ্যিক ছবিতে তিনি সবার নজর কাড়লেন ‘সবার উপরে’ ছবিতে। সেখানে তিনি ছবি বিশ্বাসের স্ত্রী, উত্তমকুমারের মায়ের ভূমিকায়। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। কলকাতার সব বিখ্যাত পরিচালকদের ছবিতে তিনি অভিনয় করা শুরু করলেন। তার মধ্যে রয়েছে— চিরকুমার সভা, ত্রিযামা, শিল্পী, পথে হল দেরি, বন্ধু, সূর্যতোরণ, লালু ভুলু, আম্রপালি, সূর্য শিখা, আকাশকুসুম, নতুন জীবন, শঙ্খবেলা, কখনো মেঘ, বিলম্বিত লয়, শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন, রোদন ভরা বসন্ত, স্বয়ংসিদ্ধা, মোহনবাগানের মেয়ে, বাবুমশাই, এই পৃথিবী পান্থনিবাস প্রভৃতি। ‘ভগবান শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ’ ছবিতে তিনি সারদামণির ভূমিকায়। ঠাকুরের চরিত্রে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘ঘুম ভাঙার গান’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘ঝড়’ প্রভৃতি ছবিতেও তিনি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করলেন। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ অবলম্বনে উৎপল দত্ত যে ‘মা’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন সেখানেও শোভা সেন অভিনয় করলেন নামভূমিকায়। মৃণাল সেনের ছবি ‘রাতভোর’, ‘আকাশকুসুম’, ‘এক আধুনিক কাহানি’ ছবিতেও তিনি কাজ করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘আবহমান’ ছবিতে এবং গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তেও তিনি কাজ করেছেন।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

মঞ্চাভিনেত্রী হিসেবে মূল্যায়ন
১৯৫৩ সালে যখন তিনি অভিনেত্রী প্রভাদেবীর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর নতুন রীতির অভিনয় ও বাগ্‌ভঙ্গি আয়ত্ত করে অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি করতে শুরু করেছিলেন শোভা সেন। উৎপল দত্ত যখন শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ বাংলায় মঞ্চস্থ করেন, তখন মিসেস ম্যাকবেথ চরিত্রে অভিনয় করে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন। ছয় দশকের অভিনেত্রী জীবনে দেশ-বিদেশের থিয়েটারকে গভীরভাবে জানার প্রভূত সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। ইউরোপের থিয়েটার চষে ফেলে, আত্মস্থ করে, নিজের অভিনয়শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন বার্লিনের হেলেনে ভাইগেলের অভিনয় দেখে। নাট্যজীবনে বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত ছাড়াও যাঁদের পরিচালনায় মঞ্চে কাজ করেছেন তাঁরা হলেন— শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী প্রমুখ। ফ্রিৎস বেনেভিৎস-এর তত্ত্বাবধানে কাজ করেছেন ‘হিম্মতবাঈ’ নাটকে ১৯৮৭ সালে। ওই বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। উৎপল দত্ত প্রতিষ্ঠিত এলটিজি এবং পিএলটি-র প্রায় সব নাটকই তিনি প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যেখানে অবশ্যই নাট্যকার ও নির্দেশক হলেন উৎপল দত্ত। তেমন কিছু চরিত্রায়ন হল— ‘ছায়ানট’ নাটকে সুচরিতা, ‘অঙ্গার’ নাটকে বিনুর মা, ‘ফেরারি ফৌজ’-এ বঙ্গবাসী দেবী, ‘চৈতালি রাতের স্বপ্নে’ টিটানিয়া, ‘কল্লোল’-এ কৃষ্ণাবাঈ, ‘প্রফেসর মামলক’-এ এলেন, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’-এ কিম, ‘মানুষের অধিকার’-এ মিসেস লিভোভিৎস, ‘সূর্যশিকার’-এ ঊর্মিলা, ‘ঠিকানা’-তে নানি, ‘ব্যারিকেড’-এ ইঙ্গেবরাত, ‘টোটা’তে কস্তুরী, ‘বর্গী এলো দেশে’-তে প্রভাবতী ইত্যাদি চরিত্রগুলি। এ-ছাড়াও স্মরণীয় অভিনয় করেছেন ‘তপতী’ নাটকে রানির চরিত্রে, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে ফতিমা বিবি, ‘শোধবোধ’ নাটকে বিধুমুখী, ‘ওথেলো’তে এমিলিয়া, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ বাসন্তী চরিত্রে।

আরও পড়ুন-সংবিধান দিবসে ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন, অসহিষ্ণুতার অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর

সম্মান লাভ
‘সংগীত নাটক একাডেমী’ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৪ সালে। রাজ্য নাট্য একাডেমী তাঁর এক ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও সংরক্ষণ করেছে ১৯৯০ সালে। রাজ্য সরকার প্রদত্ত ‘দীনবন্ধু পুরস্কার’ পেয়েছেন ১৯৯৫ সালে। প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবর্ধিত হয়েছেন ১৯৯৭ সালে। লিখে গেছেন বই।

শেষের দিনগুলি
প্রথম পক্ষের সন্তান উদয়নের আকস্মিক মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের ১৯ অগাস্ট হারান উৎপল দত্তকে। শেষের দিকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন মঞ্চে নিবেদিতপ্রাণ শোভা সেন। সেই শোভা সেনকে আমরা হারাই ২০১৭ সালের ১৩ অগাস্ট। শতবর্ষের প্রাক্কালে শিল্পীর উদ্দেশে রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।

Latest article