দেবাশিস পাঠক: ‘‘ততঃ সম্প্রেষিতা দেবী দশমাং শাবরোৎসর্বেঃ’’।।
কালিকাপুরাণের ৬০তম অধ্যায়ের ৩৩ নং শ্লোক। এই শ্লোকে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, দশমীর দিন শবর উৎসবের সঙ্গে বিসর্জিতা হবেন দেবী। পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করবেন, ‘‘মমচানুগ্রহার্থায় পুনরাগমনায় চ’’। কৃপা করে আবার এসো মা। প্রার্থনা জানাবেন, ‘‘যৎ পূজিতং ময়া দেবী পরিপূর্ণং তদস্তু মে।’’ যে মনোবাঞ্ছা নিয়ে পুজো করলাম, সেই মনোবাসনা পূরণ করো মা।
আরও পড়ুন-কর্মসংস্থানের উৎসব
বিজয়া দশমীতেই যে দেবীকে বিসর্জন দিতে হবে, তিথির নড়চড় হলে চলবে না। ভগবতীচরণ কাব্যভূষণ দুর্গোৎসব পদ্ধতির কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, শ্রবণানক্ষত্রযুক্ত দশমী তিথিতে ধ্যান করে সাধ্যমতো উপচারে দেবীর পুজো সেরে ‘দ্ব্যাত্মক’ অর্থাৎ কন্যালগ্নে দেবীর বিসর্জন দেবে। এদিন সকালেই দেবীর আহ্বান, অধিষ্ঠান, পূজন ও বিসর্জন সেরে ফেলতে হবে। প্রাতয়াবাহয়েদ্দেবীং প্রাতরের প্রবেশয়েৎ। প্রাতঃ প্রাতশ্চ সম্পূজ্য প্রাতরেব বিসর্জ্জয়েৎ।।
আরও পড়ুন-স্বৈরতান্ত্রিক পথে বিজেপি, সংসদীয় কমিটি নিয়ে কেন্দ্রের নোংরা রাজনীতি
নবপত্রিকা স্নান সেরে মণ্ডপে প্রবেশ করে সপ্তমীর দিন। সেই পত্রীপ্রবেশের দিন থেকে চতুর্থদিনে দেবীর বিসর্জন সম্পন্ন করতে হবে। চারদিনের কম বা বেশি হলে রাজার রাষ্ট্রক্ষয় ও ধনক্ষয় হবে। শাস্ত্রকারের সতর্কবার্তা, ‘‘ন্যূনধিকং ন কর্তব্যং রাজ্ঞো রাষ্ট্রধনক্ষয়াৎ।’’ রাজার রাষ্ট্রক্ষয় মানে দেশের সীমান্ত রক্ষণ ব্যবস্থায় আঘাত। দেশবাসীর শান্তিভঙ্গ ও নিরাপত্তাহীনতা। আর রাজার ধনক্ষয় মানে রাজার দেওয়া অর্থানুকূল্য থেকে প্রজাবর্গের বঞ্চিত হওয়া। সোজা কথায়, বিজয়া দশমীর দিনেটিতেই দেবী বিসর্জন সম্পন্ন না হলে দেশের ও দশের, রাজার ও প্রজার, সরকারের ও জনতার সমূহ বিপত্তির আশঙ্কা।
আরও পড়ুন-স্টল নিয়ে কুৎসার কড়া জবাব তৃণমূলের, মণ্ডপের ভিড়কে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা
তা শ্রবণা নক্ষত্রযুক্ত বিজয়া দশমীর দিনটাতেই কেন এত গুরুত্ব আরোপ?
এর পেছনে দু-দুটি কারণ ব্যাখ্যাত হয়েছে কালিকাপুরাণে।
৬০ তম অধ্যায়ের ৮১তম শ্লোক বলছে, নবমীতে নানা উপহার ও উপচারে পূজিতা হওয়ার পর দশমীতে মহিষাসুরকে বধ করে শিবা দেবী অন্তর্ধান করলেন। দশম্যান্তু বিসৃষ্টান্তর্হিতা শিবা। মহিষাসুর নিহত হওয়ায় এই দিন দেবতারা বিজয় উৎসবে মাতলেন।
আবার ওই একই পুরাণে বর্ণিত হয়েছে রাবণ বধের কথা।
সাতদিন টানা দেবী দুর্গা মহামায়া রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখেছিলেন। ওই সাতদিনই দেবতারা সকলে তাঁর পূজা করেছিলেন। সপ্তরাত্র গত হলে জগন্ময়ী মহামায়া নবমীতে রামের মাধ্যমে রাবণকে বধ করলেন। নিহতে রাবণ বীর নবম্যাং সকলৈঃ সুরৈ। রাবণ বধের পর দশমীর দিন লোক-পিতামহ ব্রহ্মা সকল দেবতাদের সঙ্গে শবর উৎসবের মধ্য দিয়ে মহামায়াকে বিসর্জন করলেন। ততঃ সম্প্রেষিতা দেবী দশম্যাং শাবরোৎসবে। শাস্ত্রাচার মেনে পুজোর প্রসঙ্গ হোক কিংবা পৌরাণিক আখ্যান অনুসারী রাবণ বধের প্রসঙ্গ হোক, সব ক্ষেত্রেই বিসর্জনের সময় শবর উৎসবের কথা বলা হচ্ছে।
আরও পড়ুন-লন্ডন ম্যারাথনে মৃত্যু প্রতিযোগীর
কেন?
আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বলেছেন, এই শাবরোৎসবের মূলে আছে নববর্ষের উৎসব। তিনি লিখছেন, বিন্ধ্য পর্বতের ডান দিকে শবর জাতি বাস করত। নবরাত্র পার্বন পালনের পর শবরদের রাজা ঘট বিসর্জনে বের হতেন। সারাদিন রাজ পুরোহিত রাজার হাতিশালায় হাতিদের, আস্তাবলের ঘোড়াগুলোর আর অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্রের পুজো করতেন। বিকেলবেলা ঘট বিসর্জনের মিছিলে শামিল হত প্রজারা। নববর্ষের সূচনা সেই দিন থেকে। ‘‘নববর্ষারম্ভে হর্ষক্রীড়া স্বাভাবিক।’’ তাই ঘট বিসর্জনের সময় প্রজারা জলকাদা নিয়ে খেলায় মেতে উঠত। কৃষ্ণযজুর্বেদ অনুসারে, সারা বছর ধরে যজ্ঞ করার পর এই দিনটাতে ঋত্বিকেরা হর্ষধ্বনি করতেন। মিছিল করে সদলবলে রাজা খানিকটা দূরে মন্দির পর্যন্ত যেতেন। তারপর শমীপত্র নিয়ে ফিরে আসতেন। যোগেশচন্দ্র লিখেছেন, ‘সেদিন যাত্রা করিলে সম্বৎসর বিজয় হইবে’, এই লোক বিশ্বাসের কারণেই পাবর্ণটিতে এমন সব আচার পালন।
আরও পড়ুন-বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে ভিজল বাংলা
আর সেই পরম্পরাকে স্বীকার করে নিয়ে পরিষ্কার বলা হল, শঙ্খ, তুরী, মৃদঙ্গ, জয়ঢাক বাজাতে বাজাতে, নানা রঙের পতাকা উড়িয়ে, খই ও ফুল ছড়াতে ছড়াতে, ধুলো কাদা ছিটিয়ে নানা ধরনের ক্রীড়াকৌতুক ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সহযোগে বিসর্জন পর্ব সমাধা করতে হয়। এটাই শাস্ত্রীয় বিধান।
যে বা যাঁরা দুর্গাপ্রতিমার ভাসানে আয়োজক ক্লাবের সদস্যদের কোমর দোলানো নাচ, ব্যান্ড পার্টির বাজনা ইত্যাদি দেখে ভক্তির হ্রাসমানতায়, পূজার সঙ্গে লগ্ন শ্রদ্ধার তাৎপর্যপূর্ণভাবে ক্ষয় লক্ষ করে সদা সমালোচনায় ও বিরক্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠেন, তাঁদের সবিনয়ে জানাই, উল্লিখিত দুর্গাপুজো পদ্ধতিতে এই বিষয়ে যা বলা হয়েছে, সেই কথাটি।
আরও পড়ুন-মহানবমী উপলক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছাবার্তা
ভগলিঙ্গাভিধানৈশ্চ ভগ লিঙ্গ প্রগীকৈঃ।
ভগলিঙ্গাদিশব্দৈশ্চ ক্রীড়য়েয়ুরলং জনাঃ।
কোনও শালীন শব্দ নয় গ্রাম্য শব্দ উচ্চারণ করবে, অশ্লীল বাক্যালাপ করবে, অশালীন গান গাইবে। এটাই বিসর্জনের বিধি।
এহ বাহ্য! এরপর যা বলা হল সেটাও বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
পরৈর্ণাক্ষিপ্যতে যন্তু যঃ পরান্নাক্ষিপেদ যদি। ক্রুদ্ধা ভগবতী তষ্য শাপং দদ্যাৎ সুদারুণম্।।
অর্থাৎ, এই বিশেষ দিনটোতে যদি কেউ তার শালীনতাবোধ আঁকড়ে থেকে ‘গুডি গুডি’ ইমেজ ধরে রাখতে চায়, যদি কেউ গ্রাম্য ভাষা, অশ্লীল শব্দ, এসব পছন্দ না করে, তবে স্বয়ং ভগবতী তার ওপর ক্রুদ্ধা হয়ে তাকে শাপ দেন।
অস্যার্থ, অন্য কোনও কারণে না-হোক, স্রেফ দেবীর কোপ থেকে বাঁচার জন্যই এদিন ‘ডিক্লাস’ হওয়াটা জরুরি।
এবং এটাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন-কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোয় মুঘল-যোগ
যিনি জগজ্জননী, তিনি তো আর্য-অনার্য-ব্রাত্য, গৃহস্থ-ভবঘুরে-বাউন্ডুলে, গৃহবধূ থেকে বারঙ্গনা, সবারই পূজ্যা। তাই, তাই-ই, শরৎকালে শবরদের চণ্ডীপূজার আচার মিশে গিয়েছে দুর্গোৎসবের মহতী বৃহদায়তন পরিসরে। যে দেবীর পূজায় বারবনিতার গৃহদ্বারের মাটি লাগে বলে যৌনকর্মীও মহাপূজায় অংশগ্রহণের বৈধতা অর্জন করেন, সেই দেবীর বিসর্জনের প্রহরে আর্যদের পাশাপাশি অনার্য ভারতের লৌকিক আচারও মিশে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
দশমীর দিন নবরাত্র বা নয়টি রাত্রি শেষে দশমরাত্রির আগমন। তাই দশরাত্রির লোকায়ত উচ্চারণ দশেরা। প্রাচীন ভারতে এই দিনটাতেই নববর্ষের প্রথম সূর্য উদিত হত। বাংলায় প্রচলিত কোলাকুলি সেই নববর্ষ পালনের একটি অঙ্গ। শত্রু-মিত্র এক হয়ে যাওয়ার প্রতীকী রীতি। এদিন নাচ-গানের যে আয়োজন হয়, বিজয়ার আসর বসে নানা জায়গায়, সেটা ওই নববর্ষের আনন্দ-উৎসবেরই পরিচয় বহন করছে।
এই আনন্দ-আসরে পানীয়র সঙ্গে সিদ্ধি-ভাঙ মেশানোর প্রথা আছে। এজন্য সিদ্ধিরই আর এক নাম ‘বিজয়া’। প্রসঙ্গত বলা দরকার, পুরাণকার বলছেন, দেবী দুর্গারও একটি নাম হল বিজয়া। মহাবলপদ্ম নামে এক দৈত্যরাজকে পরাভূত করেছিলেন বলে দেবীকে ওই নামে ডাকা হয়।
পরিশেষে, বিজয়া দশমীর সঙ্গে লেপ্টে থাকা একটি মহাভারতীয় কাহিনি।
আরও পড়ুন-চিন্ময়ী রূপে কুমারী পুজো
বিজয়া দশমীর দিন বিরাট রাজার গৃহে দুর্যোধন দলবল নিয়ে গাভীহরণ করতে গিয়েছিল। শমীবৃক্ষে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন অর্জুন। সেই অস্ত্র প্রয়োগ করেই তিনি কৌরবদের সেদিন পরাস্ত করেন।
লোক সংস্কৃতির গবেষকরা বলেন, এ জন্যই পশ্চিম ও উত্তর ভারতের নানা জায়গায় দশেরা উৎসবের দিন লোকে বাবলা জাতীয় শমী গাছের পুজো করে আর পুজো হয়ে গেলে বিজয়ের চিহ্নস্বরূপ ওই গাছের ডাল ভেঙে ঘরে নিয়ে আসে।
আরও পড়ুন-পর্তুগালে এবারে প্রথম হল দুর্গাপুজো
উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার গোপালপুর গ্রামে বাস করেন হরচৌধুরি পরিবার। তাঁদের পারিবারিক দুর্গাপূজায় বিসর্জনের আগে প্রতিমার সামনে যেখানে হাড়িকাঠ পোঁতা হয়, সেখানে একটা গর্ত খোঁড়া হয়। আর সেই গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাদামাটি মেখে একে অপরকে আলিঙ্গণ করেন পরিবারের সদস্যরা।
শবর-উৎসব, বর্ষবরণ উৎসব, সবকিছু এভাবেই কালান্তরে মিলে যায় বিজয়া দশমীর শুভ লগ্নে। আপন অস্মিতায় । আকলনের স্বাভাবিকতায়।