অভিনয় জগতে এলেন কীভাবে?
অভিনয় আমার রক্তে। দাদু এবং বাবা ছিলেন যাত্রা জগতের মানুষ। সেইসময়, যখন ছেলেরা মেয়ে সাজত। দাদু বাজাতেন বেহালা। বাবা করতেন অভিনয়। সেই ধারাটাই আমি পেয়েছি। তবে আমার শিল্পী-জীবন অভিনয় দিয়ে শুরু হয়নি। আগে আমি নাচ করতাম। ছোটবেলায় রেডিওর গান শুনে তালে তালে আপনমনে নাচতাম। দাদু চাইতেন গান শিখি। বাবার পছন্দ ছিল নাচ। তিনি আমাকে নাচে ভর্তি করে দেন।
q কী ধরনের নাচ?
শুরু হয়েছিল সাধারণভাবে। তারপর বেছে নিয়েছিলাম কত্থক। আমার গুরু ছিলেন রামগোপাল মিশ্র। পরে কথাকলি এবং ভরতনাট্যমও শিখেছি। বহু উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। যেমন তানসেন সংগীত সম্মেলন, সদানন্দ সংগীত সম্মেলন, পার্কসার্কাস মিউজিক কনফারেন্স প্রভৃতি। সেটা ছয়ের দশকে। শান্তাপ্রসাদ, গোপীকিসনের সঙ্গে ডুয়েট অনুষ্ঠানও করেছি। আরও কত অনুষ্ঠান। সব মনে নেই। নৃত্যশিল্পী হিসেবে পেয়েছি বিশেষ পরিচিতি। নাচ করেছি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। তখন আমার বয়স ২৬। তারপর অভিনয়ের জগতে চলে আসি।
q কীভাবে সুযোগ এসেছিল?
অনুষ্ঠানে আমার নাচ দেখে নাটকের দলের এক ভদ্রলোক অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। আমাকে যেতে বলেন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে। তার আগে আমি কোনওদিন অভিনয় করিনি। ভয়ে ভয়ে একদিন গেলাম। আমাকে দাঁড় করানো হল নাটকের পরিচালক জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের সামনে। জ্ঞানেশদা আমার কথাবার্তা শুনে, ছোটখাটো পরীক্ষা নিয়ে আমাকে নির্বাচন করলেন। নাটকের নাম ‘অঘটন’। অনুপকুমার, গীতা দে, বাসবী নন্দীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। হরিদাস সান্যালের প্রোডাকশন। এইভাবে জড়িয়ে গেলাম অভিনয় জগতের সঙ্গে। থিয়েটারে তো ছুটি পাওয়া যেত না। বৃহস্পতি, শনি, রবি শো। তাই আর পেলাম না নাচের সময়।
q আর কোন কোন নাটকে অভিনয় করেছেন?
কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ছিলাম বহুদিন। তারপর গেলাম রঙ্গনায়। সেখানে করলাম ‘চন্দ্রনাথ’। দেবনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন পরিচালক। অভিনয় করেছিলাম বোধিসত্ত্ব মজুমদারের বিপরীতে। সেই নাটকে ছিলেন কমল মিত্র, সরযূবালা দেবী, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপদ চক্রবর্তী প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের কাছেই আমি অনেক কিছু শিখেছি। প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম। সেই ভয় ওঁরাই দূর করে দিয়েছিলেন। স্নেহ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে। আমি নতুন বলে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। বলা যায়, আমাকে তৈরি করে নিয়েছিলেন। ‘চন্দ্রনাথ’-এর পর অভিনয় করেছিলাম ‘সুন্দরী লো সুন্দরী’, ‘দম্পতি’, ‘নাবালক বাবা’, ‘রাজদ্রোহী’ প্রভৃতি নাটকে। ‘নাবালক বাবা’য় ছিলাম শমিত ভঞ্জের বিপরীতে, ‘দম্পতি’ নাটকে মনোজ মিত্র, দুলাল লাহিড়ী, গীতা দে, বাসবী নন্দীর সঙ্গে। থিয়েটারে আমি নায়িকার পাশাপাশি অভিনয় করেছি পার্শ্বচরিত্রে।
q মঞ্চ থেকে গেলেন বড়পর্দায়, তাই তো?
হ্যাঁ। থিয়েটার দেখতে আসতেন সিনেমার প্রয়োজক, পরিচালকরা। অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায় দেখতে এসেছিলেন আমার নাটক। তিনি আমাকে নিজে ডেকে সিনেমায় সুযোগ দিয়েছিলেন। প্রথম ছবি ‘বাবা তারকনাথ’। সুপারহিট হয়েছিল। অভিনয় করেছিলাম পার্বতীর ভূমিকায়। সেই ছবিতে ছিলেন সন্ধ্যা রায়। ছবিতে ছিল তাঁর কাঁধে করে বাঁকে জল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। তারপর থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে তারকেশ্বরে যাওয়ার হিড়িক বেড়ে যায়। মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গেও অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। গেছি ওঁর বাড়িতে। তবে শেষপর্যন্ত ছবিটা হয়নি। পরিচালক শক্তি সামন্তও ডেকেছিলেন। তবে সেইসময় আমার বম্বে যাওয়ার সাহস হয়নি।
q আর কোন কোন ছবি?
সুযোগ পেয়েছিলাম তরুণ মজুমদারের ‘আগমন’ ছবিতে। তাপস পাল-দেবশ্রী রায় নায়ক-নায়িকা। ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়ও। আমি অভিনয় করেছিলাম যাত্রা দলের মেয়ের চরিত্রে। তারপর করলাম ‘প্রেম পূজারী’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘কত ভালোবাসা’ প্রভৃতি ছবি। এগুলো সবই আগেকার।
q এখন?
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছি। যেমন, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, রাইমা সেন অভিনীত ‘শব্দ’, ঋত্বিক চক্রবর্তী, ঋদ্ধি সেনের সঙ্গে ‘নগরকীর্তন’, আবির চট্টোপাধ্যায়, জয়া আহসানের সঙ্গে ‘বিজয়া’ প্রভৃতি ছবিতে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘নিরন্তন’ ছবিতে অভিনয় করেছি।
q ছোট পর্দাতেও আপনাকে দেখা গেছে। প্রথম কোন সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন?
আমার প্রথম সিরিয়াল ‘জন্মভূমি’। তারপর অভিনয় করছি ‘সীমারেখা’, ‘তমসারেখা’, ‘বহ্নিশিখা’ প্রভৃতি সিরিয়ালে।
q পুরোনো এবং নতুন পরিচালকদের মধ্যে কাজের পার্থক্য কীরকম দেখেছেন?
পুরনোদের হাতে আমি তৈরি হয়েছি। তাঁরা খুঁটিনাটি সবকিছু দেখিয়ে দিতেন। অভিনয় করেও দেখাতেন। নতুন পরিচালকরা খুব একটা দেখান না। দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়ে বলেন, নিজের মতো করে নিন। আসলে এখন সময়ের খুব অভাব। সবাইকেই কম সময়ে অনেক বেশি কাজ করতে হয়।
q পরিচালনায় এলেন না কেন?
আসলে আমি খুব কম জানি। পরিচালনায় আসতে গেলে মিউজিক, ক্যামেরা সবকিছুতেই দক্ষ হতে হয়। সেই যোগ্যতা আমার ছিল না। তাই পরিচালনায় আসার কথা কোনও দিন ভাবিনি। অভিনয় করেছি। বেশিরভাগ সময় পার্শ্বচরিত্রে। সিনেমায় নায়িকার চরিত্রে সুযোগ পাইনি। সেই নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। সারাজীবনে প্রচুর অভিনয় করেছি। পেশাদার থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, অফিস ক্লাব, সিনেমা, সিরিয়ালে। পেয়েছি পরিবারের সমর্থন। যদিও সিনেমায় অভিনয় করি বলে এলাকার অনেকেই একটা সময় আমাকে বাঁকা চোখে দেখেছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। অচেনা-অজানা মানুষজন আমাকে চিনেছেন। তাঁদের ভালবাসা পেয়েছি। এটাই জীবনে মস্তবড় প্রাপ্তি। পুরস্কার।
q এই সময়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কেমন দেখছেন?
খুব ভাল। অনেকেই দারুণ অভিনয় (Actor) করছেন। প্রত্যেকেই জেনে এবং শিখে এসেছেন। আমার ভালই লাগে এঁদের সঙ্গে কাজ করতে। আসলে আমি খুব কম কাজ করি। যাঁরা ডাকেন তাঁদের সঙ্গেই। যেচে কারও কাছে কাজ চাইতে পারি না।
q নাচের প্রতি নতুনদের আগ্রহ কতটা?
আমি নাচ শেখাই। হাওড়ার বেলেপোলে আমার বাড়ি। সেখানেই আমার নাচের স্কুল। আগে প্রচুর স্টুডেন্ট ছিল। করোনার জন্য একটু কমেছে। নতুনদের শেখাতে ভালই লাগে। শেখাতে শেখাতে নিজেও অনেক কিছু শিখে ফেলি। স্টুডেন্টদের নিয়ে বছরে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। কখনও রবীন্দ্র সদনে, কখনও শিশির মঞ্চে। আমার অনেক স্টুডেন্টও এখন নাচ শেখাচ্ছে। নাচের প্রতি নতুনরা যথেষ্ট আগ্রহী। অভিনয় (Actor) এবং নাচের সঙ্গে কেটে গেল এতগুলো বছর। বাকি জীবনটা এইভাবেই সবার সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে দেব।