অংশুমান চক্রবর্তী: সাতের দশকের বিশিষ্ট কবি বিজয় মাখাল। বসবাস হাওড়ায়। ধারাবাহিকভাবে লেখালিখির মধ্যে থাকেননি। মাঝেমধ্যেই নিয়েছেন বিরতি। আবার ফিরে এসেছেন। যতবার ফিরেছেন, জানান দিয়েছেন নিজের উপস্থিতি।
সম্প্রতি আক্ষরিক থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘শ্রমিকসাজ’। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ৫৬টি কবিতা। অতিকথনে বিশ্বাসী নন এই কবি। অল্প কথায় বুঝিয়ে দেন। মাঝেমধ্যেই আচ্ছন্ন হন স্মৃতিমেদুরতায়। কিছু কবিতা জন্ম দেয় তীব্র মনখারাপের।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ফের বিজেপিতে ভাঙন, উন্নয়নের প্রচার গ্রাম থেকে গ্রামে, বাংলা জুড়ে তৃণমূল ঝড়
প্রথম কবিতা ‘জন্মভূমি’। ফেলে আসা গ্রামের মুখ স্মরণ করেছেন কবি। লিখেছেন, ‘ঠিকানা হারিয়ে গেছে। মনে বা খাতায়/ তার কোনো অস্তিত্ব নেই।/ কে যেন বলেছিল, বাস থেকে নেমে মেঠোপথ,/ আধঘণ্টা হেঁটে যেতে হয়/ পথের দু-ধারে ফণিমনসার ঝোপ, কলাগাছের বাগান।’
মনে হতে পারে গ্রামের নির্জন পথের আটপৌরে বর্ণনা। কবিতাটি আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে যায় ওইখানে এসে, যখন বলেন, ‘হৃদয় উঠোন থেকে চিৎকার করে উঠি আমি : / দরজা খোল, দরজা খোল মা; আমি এসে গেছি— লণ্ঠনটা জ্বালো, তুলে দেখো, আমি তোমার মুখাগ্নি করা ছেলে।’
বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এই চিৎকার নীরব চিৎকার। সাধারণ থেকে কবিতাটা হয়ে ওঠে অসাধারণ। মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। যিনি বহুদিন আগেই গত। বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায় পরাবাস্তবতা। পাঠান্তে বারবার ফিরে ফিরে আসে ‘আমি তোমার মুখাগ্নি করা ছেলে’। মনখারাপের জন্ম দেয়। এই মনখারাপের পথ ধরেই পৌঁছে যাওয়া যায় অচেনা আনন্দে। মাকে হারিয়ে পাওয়ার আশ্চর্য আনন্দ।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর সভা ঘিরে উন্মাদনা কোচবিহারে, জনসভা করবেন জলপাইগুড়িতেও
এই কাব্যগ্রন্থে মাকে নিয়ে আছে আরও কিছু কবিতা। ‘মায়ের ভিটে’ কবিতার শেষে তিনি লেখেন : ‘উঠোন তারে শুখুক ফিকে জংলা শাড়ির পাড়/ ওটাই আমার মায়ের ভিটে। প্রণাম, অহংকার।’
আবারও সেই স্মৃতিমেদুরতা। সেই জন্মভূমি, ভিটে, মা। বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় অতীত।
আবার মায়ের প্রসঙ্গ দেখা যায় ‘বৃদ্ধাশ্রম’ কবিতায়। শুরুতে রেখেছেন প্রশ্ন, ‘আর কতটা উঠলে আকাশ, আরও কতটা বাড়ালে হাত,/ চাঁদ ছোঁয়া যায়?’
অসীমকে সীমার মধ্যে পাওয়ার তীব্র বাসনা। দুটো পঙ্ক্তির পর লেখেন, ‘যে মা প্রাণভর্তি করে দুধ ঢেলেছে তোমার জীবিকায়—/ শেষকালে তাকেও ফেরালে!’
প্রাণভর্তি দুধ হল জীবন, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য। একজন মা সন্তানের জন্য সমস্ত বিসর্জন দেন। অথচ পরিণতি হয় করুণ। জাগতিক সুখের জন্য সন্তান মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেই সন্তানের উদ্দেশ্যে কবি লেখেন, ‘তুমি আর কত বড় হলে মাটি থেকে, যে মাটিতে আর তোমার পা পড়ে না।’ এখানে বলা হয়েছে নিখুঁত দূরত্বের কথা। মাটি থেকে দূরত্ব। আপন শিকড় থেকে দূরত্ব। মায়ের থেকে দূরত্ব। মাটিতে পা না পড়ার অর্থ মিথ্যা অহংকার। কবিতাটি একটি সামাজিক সমস্যার দিকে আঙুল নির্দেশ করেছে।
আরও পড়ুন-মণিপুরকে কাশ্মীর বানাতে চান? তৃণমূলের প্রশ্নে ফাঁপরে শাহ
কিছু কবিতায় আছে গল্পের চলন। ‘খোঁজাখুঁজি’ কবিতায় চোখে পড়ে আশ্চর্য পঙ্ক্তি, ‘বন্ধু গেছে দীঘার সমুদ্রে আরও বড় সমুদ্রের খোঁজে।’ এই ‘আরও বড় সমুদ্র’ কী? হয়তো নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার।
‘অকারণ কবিতা’র শেষে দেখা যায় আরও একটি অনবদ্য পঙ্ক্তি— ‘প্রত্যাশায় দাঁড়ি দাও। লেখো, যে লেখা এখনও বাকি।’ সত্যিই তো, সেই লেখার অন্বেষণ চলে প্রতি মুহূর্তে। এমন পঙ্ক্তির কাছে বারবার নতজানু হতে হয়।
ভাল লাগে ‘মৃদুল’, ‘শূন্যতা’, ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘তেজস্ক্রিয়’, ‘যন্ত্রণা’ ইত্যাদি কবিতা। সন্তু দাসের প্রচ্ছদ কবিতার মতোই। রহস্যময়।
আরও পড়ুন-বিজিপিএমের দাপটে ছন্নছাড়া বিজেপি
নয়ের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি সুবীর সরকার। থাকেন কোচবিহারে। উত্তরবঙ্গের লোকজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তীব্রভাবে। কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখেন। সম্প্রতি চণ্ডাল পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘বাদ্যকরের জার্নাল’। আছে ৩০টি কবিতা।
প্রথম কবিতা ‘জীবন’। কবি লিখেছেন, ‘আমাদের জীবনে একটা দীর্ঘ ভূমিকা খুব জরুরি/ যেমন হত্যাকাণ্ডের আগে কয়েক গ্লাস জল/ কিনে নিচ্ছি জল জঙ্গল জনপদ।’
এই ‘হত্যাকাণ্ডের আগে কয়েক গ্লাস জল’ অংশে বারবার ঘুরে ফিরে আসতে হয়। ফুটে উঠেছে জীবনের নির্মম সত্য। কয়েক গ্লাস জলই তো আসলে প্রকৃত জীবন-যাপন। জঙ্গল-জীবনে পড়েছে সভ্যতার থাবা। হত্যাকাণ্ড এখানে বৃক্ষছেদন।
আরও পড়ুন-বিরোধীরা আদালতেই থাকুন মানুষ থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে
‘বাদ্যকরের জার্নাল’ এক আশ্চর্য কবিতা। ধরা পড়েছে সমকালীন সময়। সেইসঙ্গে সমাজের কিছু অসঙ্গতিও। আছে বেশকিছু চমকে দেওয়ার মতো পঙ্ ক্তি। একটি অংশে কবি বলেছেন, ‘জঙ্গলে ক্যাম্পখাট বিছিয়ে যারা গান শোনেন/ তাদের জীবনে বরাবরই বাস্তুসাপের ছায়া।’
অদ্ভুত বৈপরীত্য ধরা পড়েছে। জঙ্গল-জীবনের পাশাপাশি বসানো হয়েছে আধুনিকতাকে। উঁকি মারে ছদ্ম সবুজপ্রেম। নীরবতার ভাষা শোনার বদলে নিতে হয় গানের আশ্রয়। মাটির থেকে দূরত্ব রচনা করে ক্যাম্পখাট। ‘বাস্তুসাপের ছায়া’র মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আপাত সুখের ইঙ্গিত।
কিছু কবিতা অতি-মাত্রায় শান্ত। নির্জনতা ছড়িয়ে রয়েছে অক্ষরের ভাঁজে-ভাঁজে। একটি বিশেষ মুহূর্ত রচিত হয়েছে ‘ছায়া’ কবিতায়। কবি লিখেছেন, ‘বড় বড় পাতাওয়ালা গাছ/ বাইসনের ছবি তুলে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিচ্ছেন মা।/ বাবা ভালো বাঁশি বাজাতেন।/ বড়ই গাছের পাশে সাদাকালো বেড়াল।/ রোদের ম্যাজিক থেকে দূরে চলে যাচ্ছি/ আর নদীর পাড়ে দোলনার ছায়া।’
আরও পড়ুন-এবছর সাহিত্য অ্যাকাডেমি পেলেন বাংলার তিন লেখক
অদ্ভুত মায়া লেগে রয়েছে কবিতার ছায়া-শরীরে। আঁকা হয়েছে লোকজীবনের ছবি। বাঁশির করুণ সুর শোনা যায়। বেড়ালের রংয়ে মিশে রয়েছে ভাল-মন্দ। এই দোলনা আসলে সচল ঘড়ি। সময় নির্দেশ করে। আপাতভাবে সাধারণ মনে হলেও, কবিতাটি বহন করে গভীর অর্থ। এই কবিতা একটি সার্থক নিঃশব্দ কবিতা। ‘দাম্পত্য’ কবিতায় কবি লেখেন, ‘দাম্পত্য আসলে ঘাসের বিছানা। ম্লান হাসি পেরিয়ে/ কোথাও না কোথাও আমাদের যেতে হবে।/ বাগান ভরা ফুলগাছ।/ পথে পথে বিবাহনাচ।/ অথচ সামান্য আলপিন খুব একা করে দেয়।’
আরও পড়ুন-বুমরাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো নয়, সতর্ক করলেন শাস্ত্রী
জীবন থেকে উঠে আসা কবিতা। ভাল লেগে যায়। ‘ঘাসের বিছানা’র মধ্যে ধরা পড়ে দাম্পত্য-সুখের ছবি। এই সুখ ক্ষণস্থায়ী। ঘাস বিবর্ণ হলেই শুকিয়ে যায় প্রেম। চতুর্দিকে আনন্দ-আয়োজন। তবে সমস্ত মিথ্যে হয়ে যায় আলপিনের ছোঁয়ায়। এই কথা প্রযোজ্য যে-কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রেই।
কিছু কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহারে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন কবি। কোলাহল নেই। কবিতাগুলোয় একাকীত্ব আছে। যে কোনও কবিই আসলে একা এবং একক। ভাল লাগে ‘গ্রামার’, ‘লালশাক’, ‘হাসপাতাল’, ‘নাচ’, ‘ডুব’ ইত্যাদি কবিতাগুলো। সুভানের প্রচ্ছদ প্রশংসার দাবি রাখে।