‘বিপুল তরঙ্গ রে’ লিখেছিলেন কবি। ভারতবর্ষ এই ভাবনার একটি অংশ। পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্যকে শুধু পঁচাত্তর বছর দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ১৯৪৭ সালে ভারত নতুন করে নিজেকে খুঁজে দেখার সুযোগ পেয়েছিল। সেই সুযোগ এসেছিল অনেক আত্মত্যাগ এবং দুঃখ, কষ্টের মধ্যে দিয়ে। দেশভাগ ও মানুষের দেশান্তরী হওয়ার গল্প লিপিবদ্ধ হয়ে আছে স্মৃতিতে এবং ইতিহাসের পাতায়। তবু ‘অতীত-অনাগত’কে ‘আলোকে উজ্জ্বল’ করে তোলার ভাবনা প্রকাশ পায় সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মধ্যে। এই সংবিধান রচনার সাথে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁরা জানতেন যে এমন একটি কাঠামো নির্মাণ করতে হবে যা দেশের সামগ্রিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ, শুধু মূর্তি বানালেই চলবে না, প্রাণপ্রতিষ্ঠাও করতে হবে। সেই প্রাণের মূল্য ধরা আছে আমাদের দেশের ঐতিহ্যে।
আরও পড়ুন-বেলুড় বালিকা বিদ্যালয় পেল নতুন রূপ
ঐতিহ্যটি কেমন? বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ এখানে সহাবস্থান করেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এই মৌলিক বিষয়টির কোনও পরিবর্তন হয়নি। দেশভাগ করে নতুন দেশ তৈরি হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সেটা সেই দেশের সমস্যা। ভারতবর্ষ তার সহাবস্থানের জায়গা থেকে অন্তত সাংবিধানিক ভাবে অটল ছিল। একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনের জন্য সংবিধান নির্মাতারা ছিলেন সাংবিধানিক ভাবে দায়বদ্ধ। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠার একটি প্রধান অঙ্গ। বিশিষ্ট আইনজীবী ননী পাল্কিওয়ালা তাঁর ‘We, the Nation’ গ্রন্থে ‘Ayodhya – From Conflict to Co-operation’, অধ্যায়ে মওলানা আবুল কালাম আজাদের একটি উক্তির উল্লেখ করেছেন ভারতবর্ষের এই চিরন্তন ঐতিহ্যকে বোঝাতে গিয়ে। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কংগ্রেসের অধিবেশনে যখন তাঁকে সভাপতি করা হয় মওলানা বলেছিলেন, ‘If an angel descends from the heavens today and proclaims from the Qutub Minar that India can attain swaraj within 24 hours provided I relinquish my demand for Hindu-Muslim unity, I shall retort: ‘ No my friend, I will give up Swaraj, but not Hindu-Muslim unity, for if Swaraj is delayed, it will be a loss for India, but if Hindu-Muslim unity is lost, it will be a loss for the whole of mankind.’
আরও পড়ুন-সুবর্ণরৈখিক
স্বাধীন ভারতের সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সনদের প্রতিফলন দেখা যায়। এই অধ্যায়টি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত। সাম্য, স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পাশাপাশি জীবনের অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় অনাচারকে প্রতিহত করার অধিকারও এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে। একটি রাজনৈতিক সমাজ কতটা আদর্শ হতে পারে তার সবকিছুই লুকিয়ে আছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর। এমনকী রাষ্ট্র কোনও নাগরিককে অযথা হয়রান করতে পারবে না— তার নিশ্চয়তাও সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে আছে। ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারে যা বলা হয়েছে তা সারা বিশ্বে আদর্শস্বরূপ। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেকুলার’ শব্দটি যুক্ত ছিল না। এটি যোগ করেন ইন্দিরা গান্ধী, সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৭৬ সালে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে তবে কি তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার যথেষ্ট নয়? এর উত্তরে একটা কথাই বলা যায় যে প্রস্তাবনা হল সংবিধানের মৌলিক অবস্থান। অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে তার একটি সারাংশ। সেখানে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্যগুলি উল্লেখ করতে হয়। যেমন, চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্দেশমূলক নীতিগুলি দেশে আর্থ-সামাজিক পরিচালন ব্যবস্থার প্রকৃতিকে নির্দেশ করে। যদিও মৌলিক অধিকার আবশ্যক এবং তা আদালত কর্তৃক বলবৎ যোগ্য বিষয় হলেও নির্দেশমূলক নীতিগুলি তা নয়। এগুলো হল সাধারণ কতগুলি নীতি যা দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। এই নীতিগুলি পড়লে বোঝা যায় যে সংবিধান নির্মাতারা একটি সমাজবাদী ভাবনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সোশ্যালিস্ট’ শব্দটি ছিল না। এটিও এসেছে এই ৪২তম সংবিধানের হাত ধরে। অনেক টা সেই সূত্রেই ১৯৭৮ সালে মৌলিক অধিকারও পরিবর্তন করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার’ ছিল ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের অংশ। সেটি বাতিল হয়েছিল ৪৪তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন-স্বাধীনতা-৭৫ আর জাতীয় পতাকা
আজ সারাদেশে অসংখ্য স্কুল পড়ুয়া যে ‘মিড-ডে মিল’ পায় তা এই নির্দেশমূলক নীতির কল্যাণেই। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রকল্পনা আমাদের সংবিধান নির্মাতাদের মধ্যে ছিল। সেই কথাটা প্রস্তাবনায় উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন।
এখানেই আসে সংবিধান সংশোধন এবং মৌলিক কাঠামোর প্রসঙ্গ। একটি দেশের সংবিধান যখন প্রস্তুত করা হয় তখন নির্মাতারা একরকম ভাবে বিভিন্ন ধারা, উপাধারায় পুরোটা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। কিন্তু আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনাদি অনন্তকাল একইরকম থাকে না। তবুও ‘অতীত-অনাগত’র মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। তাই সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। এই সংশোধনের পদ্ধতি একেক দেশে একেকরকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা অত্যন্ত কঠিন। চিনে তো নেতৃত্বের ধরণ বদলের সাথে সাথে সমগ্র সংবিধানটিই পাল্টে যায়। ব্রিটেনে কোনও লিখিত সংবিধান নেই। সাধারণ আইন এবং সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রথা দিয়েই সবটা পরিচালিত হয়। কিন্তু ভারতের সংবিধান আংশিক সুপরিবর্তনীয়, আংশিক দুষ্পরিবর্তনীয়। অর্থাৎ কিছু অংশকে অনায়াসেই পাল্টে ফেলা যায় আবার কিছু অংশকে পাল্টানোর জন্য অত্যন্ত জটিল পদ্ধতির অনুসন্ধান করতে হয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের নির্দেশ ছিল যে কোনও অবস্থাতেই সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে পরিবর্তন করা যাবে না। এই মৌলিক কাঠামোর উপাদানগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত থাকলেও যা নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই তা হল ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, জনপ্রতিনিধিত্ব এবং মৌলিক অধিকার। অর্থাৎ সংবিধানের এই মৌলিক কাঠামোটিকে অপরিবর্তিত রেখে সংশোধনের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা অনেকসময়েই লঙ্ঘিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কিছু আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও এই প্রবণতা রোধ করা যায়নি।
আরও পড়ুন-সীমান্তে শক্তি বাড়াতে অত্যাধুনিক রুশ বোমারু বিমান কিনছে ভারত
তার দায় রাজনীতিকদের। ননী পাল্কিওয়ালা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘Let us never forget that it is not the Constitution which has failed the people; it is our chosen representatives who have failed the Constitution. Our Constitution is not a structure of fossils like a coral reef, and is not intended merely to enable politicians to play their unending game of power. What is needed is not a change in the Constitution but a change of heart in our unworthy politicians.’
পাল্কিওয়ালা এটা লিখছেন ১৯৮৪ সালের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী এন টি রামা রাওয়ের সরকারকে বরখাস্ত করেন রাজ্যপাল রাম লাল। সম্পূর্ণ অনৈতিক ভাবে একটি নির্বাচিত সরকারকে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে বরখাস্ত করা হয়। পাল্কিওয়ালা অত্যন্ত তীব্রভাবে একথা জানান যে আমরা যে ক’টা সাংবিধানিক সংস্থাকে বিনষ্ট করেছি তার মধ্যে প্রধান হল রাজ্যপালের পদ। রাজ্যপাল সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক তল্পিবাহক হয়ে পড়েছেন যা আদৌ সংবিধানের নির্মাতাদের চিন্তার মধ্যে ছিল না।
১৯৮০-র দশকের প্রথমার্ধে এন টি রামা রাও, ফারুক আবদুল্লা, জ্যোতি বসু, এম জি রামচন্দ্রনেরা কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে কনক্লেভ করেছিলেন বিজয়ওয়াড়া, শ্রীনগর, কলকাতায়। রাজ্যপাল নিয়োগ এবং কেন্দ্র রাজ্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। এরই ফলস্বরূপ এন টি আর এবং ফারুক আবদুল্লার সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রতিরোধের কারণে পশ্চিমবঙ্গে তা সম্ভব হয়নি। সেটিং-এর প্রশ্ন অবশ্য তখন কেউ তুলতেন না! এম জি রামচন্দ্রনের মৃত্যুর পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং বিধায়কদের দোলাচলের কারণ দেখিয়ে তামিলনাড়ুর সরকারও ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু গোল বাধে কর্নাটকে। সেখানে এস আর বোম্মাই-এর সরকার ফেলে দিলেও তিনি আদালতে যান। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয় যে এভাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়া একান্তই সাংবিধানিক রীতিনীতির বিরোধী। সাংবিধানিক অচলাবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি একই বিষয় নয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে সতর্ক করা যেতে পারে কিন্তু তা রাষ্ট্রপতি শাসন জারির কারণ হতে পারে না। এই রায়ের পর দেশ জুড়েই নির্বাচিত রাজ্য সরকারের পতন ঘটানোর প্রবণতা কমেছে।
আরও পড়ুন-ট্রাম্পের বাড়ি থেকে পরমাণু অস্ত্রের নথি উদ্ধার, দাবি সংবাদমাধ্যমের
এর সবচেয়ে বড় মাশুল দিতে হয়েছিল কাশ্মীরে। ফারুক আবদুল্লার নির্বাচিত সরকার ভেঙে দেওয়ার ফলে যে নাগরিক অসন্তোষ এবং রাজ্যপাল জগমোহনের অগণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া সারা দেশ দেখেছিল তার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল কাশ্মীর সমস্যা। হিংসার অবারিত প্রসার। বহু নিরীহ প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা হয়তো একটু শ্মশানের শান্তি দেখতে পাচ্ছি।
এখন আর রাজ্যপালকে দিয়ে সরকার ভেঙে দেওয়া হয় না। সরকার নিজেই পাল্টে যায়। জনগণ ভোট দেন একজন নেতাকে দেখে। পরে দেখা যাচ্ছে বিধায়করা দলবদল করছেন। কোথাও নেতা পাল্টাচ্ছে, কোথাও আবার জোট পাল্টাচ্ছে।
যাঁরা সংবিধানের এই অবমাননা করছেন সেই রাজনীতিকদের কি হৃদয় পরিবর্তন হবে? অন্তত ‘অমৃত মহোৎসবে’ গরল ছুঁড়ে ফেলে ‘হৃদয়বিহঙ্গে’র সংগীতের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া যাক।