কেঁদে ওঠে মন
জনপ্রিয় ফিল্মস্টার। ঠাণ্ডা ঘরের মানুষ। বিচরণ কল্পনার জগতে। যে জগতের সঙ্গে মিল নেই কঠিন বাস্তবতার। ঝুলিতে অসংখ্য হিট। তবে বর্তমানে তিনি কিছুটা ভগ্নপ্রায়। সাময়িক ছন্দপতন ঘটেছে কেরিয়ারে, ব্যক্তিগত জীবনে। স্ত্রী থাকেন আলাদা। মাসে মাসে আসেন। টাকা নিতে। ফিল্মস্টার হলেও মানুষ তো! সবকিছুর প্রভাব পড়ে মনে। মন থেকে শরীরে। গ্রাস করে অসুস্থতা। হসপিটালে ভর্তি হন। ফিরে আসেন চিকিৎসার পর। আবার মন বসাতে চান অভিনয়ে। তবে ছকবাঁধা শহরকেন্দ্রিক সিনেমার প্রতি আগ্রহ হারান। বিশেষ ধরনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তুলতে ক্লান্ত তিনি। নিজেকে ভাঙতে চান। তুমুলভাবে চান অন্যরকম কিছু করতে। এমন কিছু, যাতে লেগে থাকে মাটির গন্ধ। তাই শহর থেকে দূরে, প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মিশে যেতে চান সহজ-সরল গ্রামবাসীদের সঙ্গে। অর্জিত অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিতে চান নতুন ছবিতে। কিন্তু গ্রামে এসে তাঁর মোহভঙ্গ হয়। এমন কিছু বিষয় দেখেন, যা ছিল কল্পনার বাইরে। তিনি উপলব্ধি করেন গ্রামের ক্রাইসিস। তাঁর চোখে ধরা পড়ে রাজনীতির নামে নোংরামি, ধর্মের নামে হানাহানি, বাল্যবিবাহ, ডাইনি সন্দেহে গ্রামের মহিলার উপর নির্যাতনের মতো অমানবিক ঘটনা। তিনি দেখেন কীভাবে বর্গাদার-ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে বেনামে জমি ধরে রাখা হয়, শোষণ করা হয় গরিবদের। পাশাপাশি দেখেন ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং দলিতের সমস্যা। দেখতে দেখতে কলকাতার জনপ্রিয় ফিল্মস্টার অজান্তেই গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষদের দুঃখে কেঁদে ওঠেন। মনে মনে হয়ে ওঠেন তাঁদের একজন। খসে পড়ে শহুরে পোশাক, নকল মেক-আপ। বুকে জ্বলে ওঠে আগুন। তিনি শামিল হন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। নতুন জন্ম হয় তাঁর। এই ঘটনা অবলম্বনেই ‘শ্যামবাজার মুখোমুখি’র নতুন নাটক ‘জন্মান্তর’।
আরও পড়ুন-মহরমকে ঘিরে কলকাতার নিরাপত্তায় ৪ হাজার পুলিশ
পটভূমি পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল
নয়ের দশকের শুরুতে নাটকটি রচনা করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চলচ্চিত্র তাঁকে খ্যাতি দিলেও, মঞ্চ ছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি বহু নাটক পরিচালনা করেছেন। তাঁর লেখা নাটকের সংখ্যাও কম নয়। মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ করেছেন ব্রেখট, কামু, ওডেটস, জন ম্যালিংটন সিং প্রমুখ নাটককারকে। ‘জন্মান্তর’ নাটকের পটভূমি পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল। তুলে ধরা হয়েছে সমাজের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক। দেখানো হয়েছে পিছিয়ে পড়া একটি গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, শ্রেণি-বৈষম্য, দ্বন্দ্ব। বাম জমানায় লেখা নাটকটি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন। পাঁচ-ছয় বার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু সফল হননি। তিন দশক পর বাবার অপূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দিলেন পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল ‘জন্মান্তর’। প্রথম শো ছিল রবীন্দ্র সদনে। কয়েকদিন আগে মঞ্চস্থ হল মধুসূদন মঞ্চে।
আরও পড়ুন-আজ জিতলেই রোহিতদের সিরিজ
নিজস্ব ভাবনা এবং ভাষা
পরিচালক হিসেবে বহুদিন আগেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন পৌলমী। উপহার দিয়েছেন বেশকিছু উল্লেখযোগ্য নাটক। বাবা তাঁর আদর্শ। তবে তিনি সম্পূর্ণ নিজের মতো হতে চেয়েছেন। সেটাই করেছেন, যেটা মন চেয়েছে। নেননি বিশেষ সুযোগ। ‘জন্মান্তর’ যতটা নাটককারের, ততটাই হয়ে উঠেছে পরিচালকের। টেক্সট সামনে রেখে পৌলমী নিজের মতো নাটক নির্মাণ করেছেন। প্রয়োগ করেছেন নিজস্ব ভাবনা এবং ভাষা। পরিকল্পনা ও পরিচালনার পাশাপাশি মহালক্ষ্মী চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। চরিত্রটি নেগেটিভ। এই মহিলা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যতটা সম্ভব নিচে নামতে পারেন। কিছু কিছু মুহূর্তে পৌলমীর চোখের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ফুটে উঠেছে ক্রুরতা। সাবলীলভাবে উচ্চারণ করেছেন আঞ্চলিক ভাষা। অসামান্য দক্ষতায় তিনি চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।
আরও পড়ুন-স্বর্ণযুগের দুই মধুকণ্ঠী
সাধারণ থেকে অসাধারণ
শহুরে ফিল্মস্টার জ্যোতির্ময়ের চরিত্রে মার্জিত অভিনয় করেছেন দেবদূত ঘোষ। পর্দার পাশাপাশি মঞ্চেও তিনি যথেষ্ট সফল। চরিত্রটির যাত্রা শুরু হয়েছে খুব সাধারণ ভাবে। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেছে অসাধারণ উচ্চতায়। যখন তিনি ফিল্মস্টার, তখন নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন অদৃশ্য বলয়ে। যেখানে প্রবেশাধিকার নেই সাধারণের। সেই তিনি আমূল বদলে যান জঙ্গলমহলের গ্রামবাসীদের সান্নিধ্যে এসে। দুটি পর্বেই অসাধারণ। কোনও জায়গাই আরোপিত মনে হয় না। হাঁটাচলা, কথাবার্তায় যথার্থই তিনি সুপারস্টার।
আরও পড়ুন-চন্দ্রযান-৩ যেন নক্ষত্র! ধরা পড়ল টেলিস্কোপে
আলোকিত চরিত্র
অন্ধকারের মধ্যে একটি আলোকিত চরিত্র নীলিমা। তিনি প্রতিবাদী নারী। চলেন শিরদাঁড়া সোজা রেখে। গ্রামের মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সোচ্চার হন বাবা এবং জামাইবাবুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাঁর উদ্যোগেই গ্রামবাসীরা আন্দোলন সংগঠিত করেন। চরিত্রটি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সঞ্জিতা। মেধা দিয়ে অভিনয় করেছেন। আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে।
আরও পড়ুন-আজ জিতলেই রোহিতদের সিরিজ
সামনে এসেছে আসল রূপ
নাটকের প্রধান খলচরিত্র গোবিন্দ। নীলিমার জামাইবাবু। অসৎ উপায়ে তিনি ফুলেফেঁপে উঠেছেন। লাঠিয়াল দিয়ে দাবিয়ে রেখেছেন গ্রামবাসীদের। যদিও শুরুতেই তাঁকে ভয়ঙ্কর মনে হয় না। নাটক যত এগিয়েছে তত সামনে এসেছে তাঁর আসল রূপ। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মানস মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রে যোগ্য সঙ্গত করেছেন চৈতালি ঘোষ, ইন্দ্রজিৎ মিদ্দে, অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। কেউ কেউ অভিনয় করেছেন একাধিক চরিত্রে। দেবব্রত মাইতির মঞ্চ-ভাবনা, মানস মুখোপাধ্যায় ও মনোজ প্রসাদের আলো, দিশারী চক্রবর্তীর সংগীত ও আবহ, সঞ্জয় পালের মেক আপ প্রশংসার দাবি রাখে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের উন্নয়নের আসল রিপোর্ট ফাঁস করে চাকরি গেল অধিকর্তার
দুটি অবিস্মরণীয় ঘটনার উদ্যাপন
সাধারণ রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর এবং গ্রুপ থিয়েটরের ৭৫ বছর। দুটি অবিস্মরণীয় ঘটনার উদ্যাপনেই বিলু দত্ত নিবেদিত এই অনবদ্য নাট্য প্রযোজনা। ‘শ্যামবাজার মুখোমুখি’র উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।