মহাবিপ্লবী, কর্মযোগী নাকি পলাতক? শ্রী অরবিন্দের জীবন ও কর্মধারা নিয়ে বারবার এমন অবাঞ্ছিত বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তার একমাত্র কারণ হয়তো তাঁর জীবনের রূপসাগরে ডুব দেওয়ার যোগ্যতা তেমন কেউ অর্জন করতে পারেনি আজও। তাঁর নিজের সম্পর্কে শ্রী অরবিন্দ একসময় বলেছিলেন— ‘‘আমার জীবন নিয়ে কেউ লিখতে পারবে না। কারণ, আমার স্বরূপ মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়নি।’’ সুতরাং এমন ‘সোহং স্বামী’-কে নিয়ে যা কিছু লিখছি তা নিদারুণ ধৃষ্টতামাত্র।
আরও পড়ুন-নরওয়ে প্রযুক্তিতে তরল নাইট্রোজেন বউবাজারের ভূগর্ভে
১৮৭২ সালের ১৫ অগাস্ট, কলকাতায় তাঁর জন্ম। প্রথমে রংপুর, পরে দার্জিলিংয়ের লরেটো কনভেন্ট স্কুল থেকে, অবশেষে লন্ডনের সেন্ট পলস্ স্কুলে পড়াশুনা করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে আইসিএস-এ শিক্ষানবিশ; স্কলারশিপ পেয়ে কেম্ব্রিজের কিংস কলেজে ভর্তি হয়ে ১৮৯২ সালের মে মাসে ‘ক্লাসিকাল ট্রাইপস্’-এর প্রথম অংশে প্রথম বিভাগে এবং ওই বছরই অগাস্ট মাসে আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেখানে ছাত্রাবস্থায় ‘ইন্ডিয়ান মজলিস’ ও বিপ্লবী সংগঠন ‘লোটাস অ্যান্ড ড্যাগার’-এ যোগ দেন। কিন্তু অশ্বারোহণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আইসিএস হতে পারলেন না। দেশে ফিরে বরোদা এস্টেটে সার্ভে সেটেলমেন্ট বিভাগের চাকরিতে যোগ দেন।
আরও পড়ুন-চব্বিশে দিল্লিতে জাতীয় পতাকা তুলবেন ‘ইন্ডিয়া’র প্রধানমন্ত্রী
শ্রী অরবিন্দের রাজনীতিতে হাতে খড়ি বলতে ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় তাঁর লেখা কয়েকটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ। ‘নিউ ল্যাম্পস্ ফর দি ওল্ড’ শীর্ষক এই প্রবন্ধগুলিতে তিনি কংগ্রেস দলের নীতি ও কর্মপন্থার কঠোর সমালোচনা করেন। ওই পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁকে কথ্য ভাষায় বাংলা শেখাতে বরোদায় আসেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। দীনেন্দ্রবাবু শ্রী অরবিন্দের ঘরে আলমারি ভর্তি বইয়ের মধ্যে বিস্মিত হয়ে দেখলেন, রাশি রাশি ফরাসি, ল্যাটিন, জার্মান, গ্রিক, এমনকী রাশিয়ান বইও রয়েছে।
আরও পড়ুন-কোণঠাসা নিশীথ, খুশিতে মাছ ধরতে গেলেন উদয়ন
১৮৯৮-৯৯ সাল নাগাদ বরোদায় এসে পৌঁছন যতীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি (পরবর্তী সময়ের নির্লম্ব স্বামী)। শ্রী অরবিন্দের সাহায্যে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বরোদা সেনাদলে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে শ্রী অরবিন্দের নির্দেশে কলকাতায় ফিরে গিয়ে বিপ্লবী দল গড়তে ব্যারিস্টার পি মিত্র ও বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্যের সঙ্গী হন।
১৯০৬ সালে রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক ও অন্যান্য দেশপ্রেমী শিক্ষাব্রতীদের উদ্যোগে কলকাতায় গড়ে ওঠে ‘ন্যাশনাল কলেজ’। শ্রী অরবিন্দ অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। সেই সময় রাজা সুবোধের ১২ নং ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাসভবনে বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক বসত। সেই বৈঠকগুলি থেকে বাংলার দিকে দিকে বিপ্লবী তৎপরতা পরিচালনার রূপরেখা তৈরি হত। শুরু হয় বিপিনচন্দ্র পালের সম্পাদনায় ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা। শ্রী অরবিন্দ ছিলেন সহকারী সম্পাদক। রাজা সুবোধের বাড়ির পেছন দিকের অংশে ছিল পত্রিকার দফতর। পত্রিকার মূল নীতি ছিল— (১) হিংসার বিরুদ্ধে হিংসাকে সমর্থন; (২) যদি অত্যাচারের বিরোধিতা না করা হয় তাহলে স্বাধীনতার স্বপ্ন কখনওই সফল হবে না; (৩) আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলা। ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-৫ গোলে জয় ডায়মন্ড হারবারের
১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে দাদাভাই নৌরজি-র সভাপতিত্বে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে শ্রী অরবিন্দ যোগ দেন। ওই অধিবেশনে তাঁর উদ্যোগে স্বাধীনতার প্রস্তাব প্রথম স্বীকৃতি পায়। অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনও জায়গা করে নেয়। সারা বাংলায় তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চরম আকার নিয়েছে। ১৯০৭-এর ৩০ জুলাই, বন্দেমাতরম পত্রিকার দফতরে তল্লাশি চলে। শেষ পর্যন্ত মুদ্রক অপূর্ব ঘোষকে তিন মাসের কারাদণ্ড ও শ্রী অরবিন্দকে রেহাই দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ ও অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা ১২ নং ওয়েলিংটন স্কোয়ারে শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘কী মশাই, আমাদের ফাঁকি দিলেন?” (অর্থাৎ জেলে গেলেন না?)। শ্রী অরবিন্দের সপ্রতিভ উত্তর— “Not for long will you have to wait”। এই সময় শ্রী অরবিন্দের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নমস্কার’ কবিতাটি পাঠ করে শোনান।
আরও পড়ুন-‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’ মোদি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে সরব মুখ্যমন্ত্রী
১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন উপলক্ষে চরমপন্থী, নরমপন্থী গোষ্ঠীতে দল বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিন বাল গঙ্গাধর তিলক, শ্রী অরবিন্দের নেতৃত্বে চরমপন্থীরা ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, গোপালকৃষ্ণ গোখলে প্রমুখ নরমপন্থী নেতারা আলাদা বৈঠক করে দল ভারী করার চেষ্টা করেন। অধিবেশনে সুরেন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করার জন্য রাসবিহারী ঘোষের নাম প্রস্তাব করার সঙ্গে সঙ্গে তিলক উঠে দাঁড়িয়ে লালা লাজপত রায়ের নাম পাল্টা প্রস্তাব করেন। এরপর ব্যাপক হই-হট্টগোল, চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ি, শেষ পর্যন্ত পুলিশি হস্তক্ষেপের ফলে ভেস্তে যায় সুরাট অধিবেশন।
১৯০৮-এর ৪ এপ্রিল, চন্দননগরে জাতীয়তাবাদীদের সভায় শ্রী অরবিন্দের বক্তৃতা দেওয়ার কথা। কিন্তু মেয়র টার্ডেভেলের নির্দেশে তা বাতিল করা হয়। চন্দননগরের অদূরে চিতালা-তে বক্তৃতা দেন শ্রী অরবিন্দ। ১১ এপ্রিল মেয়র টার্ডেভেলের বাড়িতে বোমা পড়ে। কিন্তু তা ফাটেনি। এপ্রিলেই পাবনায় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু সুরাটের ঘটনার প্রেক্ষিতে কেউ সভাপতি হতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত শ্রী অরবিন্দের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবনা কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে সুরাটের ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘‘শুকনো কাঠ যখন ভাঙে তা চিরতরে ভেঙে যায়। কিন্তু সজীব গাছের ডাল কাটা পড়লে নতুন করে তা পল্লবিত হয়।’’
আরও পড়ুন-‘আপনি জানেন বাংলা নব জাগরণের পুন্যভূমি, সংস্কৃতির মাটি’ মোদিকে তোপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
২ মে, ১৯০৮। শ্রী অরবিন্দ তাঁর ৪৮, গ্রে স্ট্রিটের বাসভবনে বসে রয়েছেন। শুরু হল পুলিশি হানা। শ্রী অরবিন্দ গ্রেফতার হলেন। তার আগে ৩০ এপ্রিল, মজফফরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে খুন করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোমার আঘাতে ভুলবশত নিহত হন মিসেস ও মিস কেনেডি— ব্যারিস্টার প্রিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা।
২ মে মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে ধরা পড়েন বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, ইন্দ্রভূষণ, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। ওই দিনই ওয়াইনি রেল স্টেশনে প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়েন। কিন্তু তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।
আরও পড়ুন-ধসে রাস্তাজুড়ে পাথরের স্তূপ, মৃত্যু ৫ তীর্থযাত্রীর
১৮ মে, ১৯০৮। ম্যাজিস্ট্রেট বারলে-র এজলাসে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময় জেলের ভেতরে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। নরেন্দ্রনাথ গোসাঁই নামের এক অভিযুক্ত রাজসাক্ষী হওয়ায় তাকে জেল-হাসপাতালে হত্যা করেন বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত। দিনটি ছিল ৩১ অগাস্ট। এই ঘটনার পরে বিপ্লবীদের আলাদা আলাদা সেলে স্থানান্তরিত করা হয়। অরবিন্দকে একাকী বন্দি রাখা হয় একটি খুবই অল্প পরিসরের একক সেলে। ১৪ সেপ্টেম্বর কানাইলাল দত্তকে জেলের ভেতরেই ফাঁসি দেওয়া হয়। দায়রা আদালতে মামলাটি সোপর্দ করা হয় ১৯ অক্টোবর। মামলাটিতে দুটি আলাদা গোষ্ঠীর অভিযুক্তরা ছিলেন। একটিতে ৩৩ জন অপরাধী, অপরটিতে ৯ জন। ৪০০০ দস্তাবেজ ও আরও ৩০০/৪০০ প্রামাণ্য কাগজপত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে আদালতে পেশ করা হয়। ২২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার পরে ১৯০৯ সালের ১৩ এপ্রিল শুনানি শেষ হয়। দু’দিনের মধ্যে জুরিরা তাঁদের মতামত দেন। রায় বেরোয় ৬ মে, ১৯০৯-এ৷ মামলা চলাকালীন দিনে-রাতে শ্রী অরবিন্দ ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। উল্লেখ্য, সুরাট অধিবেশনের পরে শ্রী অরবিন্দ যখন বরোদায় যান, সেখানে তাঁর সঙ্গে মারাঠি সাধক বিষ্ণু ভাস্কর লেলে-র সাক্ষাৎ হয়। লেলের অনুপ্রেরণায় শ্রী অরবিন্দ সাধন মার্গে উদ্বুদ্ধ হন। তখন থেকে প্রাণায়াম, যোগসাধনা শ্রী অরবিন্দের জীবনে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বৈপ্লবিক পরিকল্পনা ও বিদ্রোহের রূপরেখা তৈরিতে নিবিষ্ট মনোনিবেশ তিনি আয়ত্ত করেন। পরবর্তীতে জেলের নীরব, নিঃসঙ্গতায় এই সাধনায় প্রতি মুহূর্তে তিনি ঋদ্ধ হন। এই সম্পর্কে তাঁর আত্মকথনে লিখেছেন—‘সবচেয়ে সাধারণ ও চিরায়ত পদ্ধতি যদি কেউ আয়ত্ত করতে পারে, তা হল নিঃসীম শূন্য থেকে তোমার মস্তিষ্কে নীরবতাকে আহ্বান কর। তারপর মন ও দেহে সঞ্চারিত কর।’ জেলের নিঃসঙ্গ লৌহকপাটের অন্তরালে শুধু নয়, মামলার শুনানি চলাকালীন অন্যান্য বিপ্লবীরা যখন দেশভক্তির গান গাইতেন তখন শ্রী অরবিন্দ প্রার্থনার ভঙ্গিতে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
আরও পড়ুন-লালফৌজের সঙ্গে ফের বৈঠক
তাঁর বন্দিজীবনের বহু অজানা লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন আত্মকথনে। তার মধ্যে এক-আধটি এই ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করা হল।
আলিপুর জেলে তিনি ১১ দিন অনশন পালন করেন। শ্রী অরবিন্দের ওজন এর ফলে দশ পাউন্ড কমে যায়। এছাড়া অন্য কোনও শারীরিক অসুবিধা হয়নি। তিনি লিখেছেন, ‘কারাগারে প্রায় পক্ষকাল ধরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আমি স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে কথোপকথনে মগ্ন থাকতাম। আধ্যাত্মিক বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ আমাকে তাঁর অপরূপ বাণীর মাধ্যমে পথনির্দেশ দিতেন। তাঁকে কারাগারে চাক্ষুষ না দেখতে পেলেও মনে হত তিনি সেখানেই বিরাজ করছেন।’ তিনি নারায়ণের দর্শনও পান কারাগারের অভ্যন্তরে। তাঁর কথায়, ‘আমি অনুভব করলাম ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। খলু ইদম ব্রহ্ম। সর্বত্র ব্রহ্ম প্রকাশমান রয়েছে। তাই কারাগার আমার কাছে আর বন্দীশালা মনে হত না। বন্দীদের মধ্যে, জেলকর্মী, গাছপালা, সবকিছুর মধ্যেই আমি পরম ব্রহ্মকে দর্শন করেছি। অনুভব করেছি, তৃপ্ত হয়েছি।’
আরও পড়ুন-চব্বিশে দিল্লিতে জাতীয় পতাকা তুলবেন ‘ইন্ডিয়া’র প্রধানমন্ত্রী
মামলায় শ্রী অরবিন্দের পক্ষে জোর সওয়াল করেন ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাস। তাঁর অন্তরাত্মার নির্দেশ পেলেন— ‘চিত্তরঞ্জনই তোকে মুক্ত করবে। তুই মানবজাতির কল্যাণের জন্য অটল সাধনায় নিমগ্ন থাক।’
আদালতের দীর্ঘ শুনানিতে নানা আইনি ব্যাখ্যা, সাক্ষ্যপ্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণের শেষে চিত্তরঞ্জন দাস বিচারক বিচক্রফ্টকে বললেন, “Your Honour! My appeal to you is this— that Aurobindo stands not only before the Bar of this Court, but before the Bar of the High Court of history. Long after this turmoil is hushed in silence, this agitation will have ceased, long after he is dead and gone, he will be looked upon as the poet of patriotism, as the prophet of nationalism and lover of humanity. Long after he is dead and gone, his words will be echoed and re-echoed not only in India but across the seas and lands…”
আরও পড়ুন-‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’ মোদি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে সরব মুখ্যমন্ত্রী
(ধর্মাবতার, আপনার প্রতি আমার নিবেদন— অরবিন্দ শুধুমাত্র এই আদালতেই নয়, ইতিহাসের উচ্চ ন্যায়ালয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই টালমাটাল অবস্থা নিঃশেষিত হওয়ার বহু যুগ পরে, এই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পরে, তাঁর মৃত্যু তথা ইহজগৎ ত্যাগ করারও বহু যুগ পরে, তাঁকে সবাই দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের অবতার এবং মানবতার প্রেমিক রূপে গণ্য করবে। তাঁর মৃত্যু ও মহাপ্রস্থানের পরেও তাঁর বাণী শুধু ভারতেই নয়, সমুদ্র ও ভূমণ্ডল পার হয়ে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হবে…)
১৯০৯ সালের ৬ মে বিচারপতি বিচক্রফ্ট রায় দেন। শ্রী অরবিন্দ নিঃশর্ত মুক্তি পান। বারীন ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় (পরে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হয়), তেরোজন বিপ্লবীকে আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তিনজন ১০ বছর, আরও তিনজন ৭ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। শ্রী অরবিন্দ সহ ১৭ জন বিপ্লবীকে নিরপরাধ ঘোষণা করা হয়।
মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অল্পদিনের মধ্যে (৩০ মে, ১৯০৯) শ্রী অরবিন্দ ঐতিহাসিক ‘উত্তরপাড়া ভাষণ’ দেন। বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য অমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি শ্রী অরবিন্দকে উত্তরপাড়ায় ধর্মরক্ষিণী সভায় বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানান। তিনি সম্মতি দেন। উত্তরপাড়া স্টেশনে নির্ধারিত দিনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান রাজা পিয়ারিমোহন মুখার্জি, তাঁর ছেলে মিছরিবাবু ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা। শোভাযাত্রা সহকারে তিনি উত্তরপাড়া লাইব্রেরির পূর্বদিকের চত্বরে সভাস্থলে এসে পৌঁছলে সমবেত হাজার দশেক জনতা হর্ষধ্বনি করে ওঠে। তাঁরা নিঃশব্দে শুনলেন শ্রী অরবিন্দের হাজতবাসের দিনগুলির কথা। কীভাবে তিনি সাধনমার্গে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। কীভাবে তিনি সমস্ত বন্দি, জেলকর্মী, গাছপালা, পাখির মধ্যে বাসুদেব তথা শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেয়েছেন, এমনকী বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলিকেও শ্রীকৃষ্ণের রূপে দেখতে পেয়েছেন। তাঁর পূর্বপরিচিত ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জনকে দেখামাত্র বুঝলেন তাঁকে নারায়ণ পাঠিয়েছেন পরিত্রাণের জন্য। ওই সময় তাঁর অন্তরাত্মা সবসময় বলত, এই মহান জাতি, এই মহাসংগ্রাম, এই গণ অভ্যুত্থান সবই নারায়ণের নির্দেশেই সমৃদ্ধ হচ্ছে। আজ তিনি যা বলছেন, সবই তাঁরই কথা। তাঁর নির্দেশেই প্রতিটি শব্দ তিনি উচ্চারণ করছেন।
বিস্মিত শ্রোতৃমণ্ডলী। শ্রী অরবিন্দ গীতা-উপনিষদের কথা বলছেন। তিনি অনন্তলোকের কথা বলছেন। অনন্ত দ্যুতির উল্লেখ করছেন। যা তিনি দর্শন করেছেন। উপলব্ধি করছেন। ধন্য ধন্য করে উঠলেন সবাই। তাহলে বিপ্লবী অরবিন্দ কি শেষ পর্যন্ত সাধনমার্গেই নিজেকে সমর্পণ করলেন। এর উত্তর সহজভাবে শ্রী অরবিন্দ লিখেছেন।
‘জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেখলাম চারপাশে সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। অনেকে তখনও জেলে, সুদূর আন্দামানে বন্দী। আমরা তবু কলেজ স্কোয়ারে নিয়মিত সভা করতাম। আগে ঐসব সভায় হাজার হাজার শ্রোতা আসতেন। এখন বড়জোর কয়েকশ’। তার মধ্যে বেশির ভাগই পথচলতি মানুষজন।’ এই সময় তিনি ‘ধর্ম’ ও ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন। প্রথমটি বাংলা, দ্বিতীয়টি ইংরেজিতে। দুটি পত্রিকাই অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।
আরও পড়ুন-অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজ্যসভা থেকে সাসপেন্ড রাঘব চাড্ডা, সরব বিরোধীরা
১৯০৯ সালের মে থেকে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শ্রী অরবিন্দ ৬, কলেজ স্কোয়ারে বসবাস করেন। ৪, শ্যামপুকুর লেনে পত্রিকার দফতরে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় যেতেন। তিনি জানতে পারলেন, পত্রিকা অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালাবে। তাঁকে আবার গ্রেফতার করতে। তাঁর সহযোগীরা তখন পুলিশি আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তিনি গোপনে নৌকায় চেপে চন্দননগরে চলে যান। সেখানে মতিলাল রায়ের সাহায্যে গোপন আস্তানায় বাস করেন। প্রায় একমাস চন্দননগরে থাকার পরে মার্চ মাসের শেষের দিকে তিনি ফরাসি উপনিবেশ পণ্ডিচেরিতে এসে পৌঁছন।
শ্রী অরবিন্দকে এখনও কেউ কেউ হয়তো ভীত, পলাতক ভাবেন। কিন্তু তাঁর নিজের কথায়— ‘আমি অন্তরাত্মার আদেশেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিভৃতে সাধনমার্গে নিজেকে সমর্পিত করেছি।’ এরপর পণ্ডিচেরিতে শ্রী অরবিন্দের সাধনমার্গের সাক্ষী হতে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ পণ্ডিচেরিতে এসেছেন। এসেছিলেন বিশ্ববরেণ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২৮ সালের ২৯ মে তিনি শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কাটান। ‘নমস্কার’ কবিতাটি পুনরাবৃত্তি করেন। ইংলন্ডে যাওয়ার আগে এটিই ছিল রবীন্দ্র-অরবিন্দের শেষ সাক্ষাৎ। সেদিনের সেই প্রবহমান জনস্রোত আজও বয়ে চলেছে দক্ষিণ ভারতের উপকূল, পণ্ডিচেরিতে।
আরও পড়ুন-মণিপুর জ্বলছে, সংসদে নির্লজ্জ মস্করা মোদির! তোপ দাগলেন রাহুল
“বন্ধন পীড়ন দুঃখ অসম্মান মাঝে
হেরিয়া তোমার মূর্তি, কর্ণে মোর বাজে
আত্মার বন্ধনহীন আনন্দের গান,
মহাতীর্থ যাত্রীর সঙ্গীত, চিরপ্রাণ।”
(নমস্কার— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)